মানুষ সব সময় অজানার সন্ধানে থাকে এবং ওই অজানাকে জানতে ও জীবনের গতিপথ আরো মসৃণ করতে মানুষ বিভিন্ন সময় নানান বস্তু আবিষ্কার করেছে। সব আবিষ্কারেরই কমবেশি প্রভাব রয়েছে মানব ইতিহাসে। কোনোটার প্রভাব ছিল ক্ষণস্থায়ী আবার কোনো দ্রব্যের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মানব ইতিহাসে খুব কম দ্রব্যই আছে যা মানব জীবনকে শুধু প্রভাবিতই করেনি, বদলে দিয়েছে ইতিহাওি। এর মধ্যে একটা আবিষ্কার হচ্ছে গানপাউডার।
গান পাউডারের রঙ কালো। রঙের কারণে এবং আধুনিক ধোঁয়াবিহীন প্রপেলান্টের থেকে আলাদা করতে এটিকে ‘ব্ল্যাক পাউডার’ও বলা হয়ে থাকে। রসায়ন শাস্ত্রে ওই কালো পাউডারের রয়েছে ব্যাপক গুরুত্ব। প্রধানত প্রপেলেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ওই গানপাউডার অল্পতেই বিস্ফোরিত হয়। নবম শতকে চীনের বিজ্ঞানীরা গানপাউডার আবিষ্কার করেন। এটিই হচ্ছে ইতিহাসের প্রথম বিস্ফোর দ্রব্য বলে জানা যায়। এছাড়া গানপাউডার ব্যবহার করে বিপুল ধোঁয়া উৎপাদন করা যায়। গানপাউডার আগুনের দহন ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়।
গানপাউডার আবিষ্কারের নেপথ্যে?
মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষের অন্যতম আরাধ্য বস্তু ছিল অমরত্ব। চীনের রসায়নবিদরাও এর বিপরীত ছিলেন না। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা খুঁজে গেছেন অমর হওয়ার ওষুধ। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই ছিল ব্যর্থ। আর তাদের বেশিরভাগ ব্যর্থ প্রচেষ্টাতেই একটা উপকরণের উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব ছিল। তা হচ্ছে সল্ট পিটার বা পটাশিয়াম নাইট্রেট।
চীনের স্বর্ণযুগ ছিল ত্যাং শাসন আমল। ওই সময় ৮৫০ খৃস্টাব্দে এক নাম না জানা রসায়নবিদ ৭৫ শতাংশ সল্ট পিটার, ১৫ শতাংশ কাঠকয়লা ও ১০ শতাংশ সালফার বা গন্ধকের মিশ্রণে এক নতুন দ্রব্য উৎপাদন করেন। ওই দ্রব্যের জীবন বর্ধিত করার ক্ষমতা না থাকলেও ছিল বিস্ফোরণের ক্ষমতা। খোলা আগুনের সামনে রাখলে এটা শব্দ করে বিস্ফোরিত হয়। ওই সময়ের একটা লেখা থেকে পাওয়া যায়, দুর্ঘটনাক্রমে এই আবিষ্কারের মাধ্যমে আবিষ্কারক রসায়নবিদের হাত ও মুখ পুড়ে যায় এবং তার বাড়িতেও আগুন লেগে যায়।
চীনে গানপাউডারের ব্যবহার
বলা হয়ে থাকে, গানপাউডার আসলে দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হয় এবং শুধু আতশবাজির জন্যই এর ব্যবহার করা হতাে চীনে। কিন্তু আসলে শুরু থেকেই গানপাউডার যুদ্ধক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসের অনেক বইয়েই এটা পাওয়া যায়, চায়নিজরা ওই আবিষ্কারটি শুধু আতশবাজির জন্যই ব্যবহার করেছিল। এটা একটা মিথ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘সং’ শাসকের আমলে আনুমানিক ৯০৪ খৃস্টাব্দে সং সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মঙ্গোলিয়ানদের বিপক্ষে গানপাউডার ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সং সেনাবাহিনীর অন্যতম একটা অস্ত্র ছিল ‘ফ্লাইং ফায়ার’ বা উড়ন্ত আগুন। তীরের মাথায় গানপাউডার ভর্তি একটা টিউব লাগানো থকেতো এবং ওই টিউবে আগুন ধরিয়ে তীর ছোঁড়া হতো প্রতিপক্ষ শিবির লক্ষ্য করে।
উড়ন্ত প্রজ্বলিত ওই তীরগুলোকে ক্ষুদ্র রকেট বলা যায়। কারণ এটা উড়ে গিয়ে শত্রুপক্ষের তাঁবুতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়ে শত্রুদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করতো। এছাড়া তখন ওই উড়ন্ত আগুন দেখে অবশ্যই সবাই এটাকে কোনো ভয়ানক কালো জাদু বলে মনে করতাে যেহেতু তারা এর আগে এমন কিছু দেখেনি।
ওই উড়ন্ত অগ্নিবস্তু ছাড়াও সং সেনাবাহিনী আরো কিছু অস্ত্রে গানপাউডারের ব্যবহার করে। যেমন- প্রাচীন হ্যান্ড গ্রেনেড, অগ্নিনিক্ষেপণ যন্ত্র ও ল্যান্ডমাইন।
এছাড়া ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবিন ইয়াটস-এর মতে, ১২২৭ খৃস্টাব্দের একটা তৈলচিত্রে সং সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রথম কামানের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সময়কালের হিসেবে ওই চিত্রায়ণ করা হয় ইউরোপে কামান তৈরির প্রায় দেড়শ’ বছর আগে। চীনে ব্যবহৃত প্রথম কামানের তোপ ছিল বাঁশের তৈরি টিউব। পরে ঢালাই করা ধাতু দিয়ে তোপ বানানো হয়।
গানপাউডারের গোপনীয়তা ফাঁস
একবিংশ শতকের মাঝের দিকে সং সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে গানপাউডারের উৎপাদন প্রণালি তার রাজ্যের বাইরে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এবং তা ঠেকাতে ১০৭৬ খৃস্টাব্দে সং শাসক সল্ট পিটার রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ওই পদার্থের রেসিপি গোপন থাকেনি বেশিদিন। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। ১২৮০ খৃস্টাব্দে পশ্চিমে প্রথমবারের মতাে ওই বিস্ফোরকের উৎপাদন প্রণালি প্রকাশ হয় এবং গানপাউডারে গোপনীয়তা ইউরোপজুড়ে প্রকাশ পেয়ে যায়।
গানপাউডারের রাসায়নিক বিক্রিয়া
কীভাবে মাত্র তিনটি পদার্থের মিশ্রণেই হয়ে যায় অভূতপূর্ব ওই আবিষ্কার? তা জানতে হলে দেখতে হবে এর রাসায়নিক বিক্রিয়া। গানপাউডারে জ্বালানি হিসেবে থাকে চারকোল (কাঠকয়লা), অক্সিডাইজার হিসেবে সল্ট পিটার (পটাশিয়াম নাইট্রেট), থাকে সালফার (গন্ধক)। অক্সিজেনের সঙ্গে চারকোলের কার্বন বিক্রিয়া করে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও শক্তি উৎপন্ন করে। আগুন জ্বালালেবাতাস থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করে কার্বন এবং সল্ট পিটার অতিরিক্ত অক্সিজেনের জােগান দেয়। পটাশিয়াম নাইট্রেট, সালফার ও কার্বন পরস্পর বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং পটাশিয়াম সালফাইড তৈরি করে। এছাড়া নাইট্রোজেনের বিস্ফোরণী ক্ষমতা বিস্ফোরণ ঘটাতে সাহায্য করে। উল্লেখ্য, নাইট্রোজেনকে বিস্ফোরক গ্যাস বলা হয়। ডিনামাইট তৈরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহৃত হয়।
মানব ইতিহাস ও সংস্কৃতির উন্নয়নে চীনের অনেক আবিষ্কারের গভীর প্রভাব রয়েছে। কাগজ, ম্যাগনেটিক কম্পাস ও রেশমের আবিষ্কার প্রথমে চীনেই হয়। পরে ওইসব দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পরে। কিন্তু চীনের অন্যান্য কোনো আবিষ্কারের প্রভাবই এতটা ছিল না যতটা প্রভাব ছিল গানপাউডার আবিষ্কারের- হোক সেটি আশীর্বাদ হিসেবে অথবা অভিশাপ আকারে।