দিল্লিতে নাকি এক তবলা বাদক ছিলেন যিনি কিনা তার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে ৫০০ মৌলিক কম্পোজিশন উপহার দিয়েছিলেন। এই উপমহাদেশে এক সময় এভাবেই তবলার বাদ্যের প্রসার ঘটেছে বলে শোনা যায়।
সারা জাহানের শ্রেষ্ঠ তবলা বাদক ওস্তাদ জাকির হুসাইন সেই ধারারই একজন পথিক। তবলাই যার সুখ দুখ। তবলা নিয়ে বলে থাকেন, এই যন্ত্রটা কাছে থাকলে নিজেকে শক্তিশালী মনে হয়, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তাকে পেয়ে বসতে পারে না।
এই তবলা সম্রাটের বংশধর পাকিস্তানে পড়ে থাকলেও তেমনটা যাওয়া হয়ে উঠতো না সেদেশে। ৯০ সালের দিকে প্রথমবারের মত তবলা পরিবেশন করতে লাহোরে যান, সেই অনুষ্ঠানে গায়ক হিসেবে হাজির ছিলেন তরুণ আদনান সামি। ওই অনুষ্ঠানেই প্রথম দেখা হয় দুজনের মাঝে, তারা একসাথে পারফর্মও করেন সেদিন। সেবারকার সফরে তিনি লাহোরসহ ইসলামাবাদ ও করাচিতে তখনকার চলতি সংগীতের জগতে পা রাখা আদনান সামির সঙ্গে বেশ কয়েকটি কনসার্ট করেন, এ কারণে তাকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়। ততদিনে অবশ্য যদিও তিনি জর্জ হ্যারিসন, ভ্যান মরিসন ও স্টি ওন্ডারের মতো দুনিয়াখ্যাত শিল্পীদের সাথে কাজ করেছেন।
এর পরপরই সাংবাদিক ফাহিমেহ ফিফি হারুন দুজনের এই মূল্যবান সাক্ষাৎকারটি নেন, পরে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের দৈনিক ডন পত্রিকার সাময়িকী হেরাল্ডেে এটি প্রকাশিত হয়। ৯ মার্চ ওস্তাদ জাকির হুসাইনের জন্মদিন উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি জবানের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল। এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহমুদা প্রিয়তী।
ফাহিমেহ ফিফি হারুন : আপনারা দুজনে (আদনান সামি ও জাকির হুসাইন) একসাথে পাকিস্তান ভ্রমণের সিদ্ধান্তে কিভাবে পৌঁছুলেন?
জাকির হুসাইন : দোষটা আসলে আমাদের একজন কমন ফ্রেন্ডের বলা যায়। তার সাথে লন্ডনের এক কনসার্টে দেখা হয়েছিল আমার। তখন সে-ই বলেছিল যে আদনানের সাথে কাজ করা উচিত। লোক পটাতে বেশ পটু সে, সুতরাং তখন আমি তাকে বলেছিলাম যে আপনি ব্যবস্থা করুন, কি হয় তা পরে দেখা যাবে। আর তারপরেই একদিন, ভোর চারটায় আমার ফোন বেজে উঠলো, যার অপরপাশে থাকা হাশিখুশি প্রাণবন্ত কন্ঠটা সাথে সাথেই বলে উঠলো, “হাই, আমি পাকিস্তান থেকে আদনান বলছি।” উত্তরে আমি কোনমতে একটা হ্যালো বলতে পেরেছিলাম। তো, সেখান থেকেই আমাদের পরিচয়, এবং, একসাথে আজ পাকিস্তানে থাকা।”
আপনাদের দুজনের সম্ভবত কনসার্ট ভেন্যুতেই প্রথম সামনাসামনি দেখা হয়েছে। আর সেজন্যেই মনে হয় কী বাজাবেন সে বিষয়ে একমত হতে পারছিলেন না দুজন?
হুসাইন : আমাদের আসলেই কোন পরিকল্পনা করা হয়নি আগে। সত্যি বলতে, করাচির অনুষ্ঠান প্রায় একটা অনুশীলন সেশনের মত ছিল। ওই রাতের আগে আদনানের সাথে আমার দেখা হয়নি কখনো। ড্রেসিং রুমেও একে অপরের উদ্দেশ্যে হাই হ্যালোর চাইতে বেশি কিছু বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিল, “হাই, আদনান। কেমন আছো? আর তুমি টাক্সুডো কেন পরেছো?”
আসলেই, আপনি টাক্সুডো কেন পরেছিলেন?”
হুসাইন : তাও আবার এত গরম ছিল সেসময়…
আদনান সামি খান : আসলে, আমি ভেবেছিলাম টাক্সুডোয় আমাকে অন্যরকম দেখাবে।
হুসাইন : আসলে ও বুঝাতে চাচ্ছে যে ও এমন কিছু পরতে চাইছিল যা ওর স্বর্ণের রোলাক্স ঘড়িটার সাথে বেশ মানাতো।
খান : আমি জাকির সাহেবের কাজের ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলাম, কিন্তু আমার সামর্থ্যের বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই ওনার কোন ধারণা ছিল না। অথচ সেবারে প্রায় হাজার খানেক লোকের সামনে একসাথে তখন মুখোমুখি হতে হইয়েছিল আমাদেরকে…
হুসাইন : যারা কিনা আবার প্রায় দুঘন্টা ধরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সত্যি বলতে, ব্যাপারটা অনেকটা ব্লাইণ্ড ডেটিং মত আর কি।
এজন্যেই সম্ভবত অপেক্ষাকৃত মৌলিক-সাধারণ কিন্তু সত্যিই আবেদনময়ী একটি বাজনা দিয়ে শুরু করে তূলনামূলক বেশি জটিলগুলো অনুষ্ঠানের শেষভাগের জন্যে হাতে রেখেছিলেন।
হুসাইন : আমার মনে হয়, সেমুহূর্তে বাজনা শুরুর আগে আমাদের দুজনেরই মূল লক্ষ ছিল দর্শকদের একটু গরম করে তোলা। আমরা ভেবেছিলাম জটিল ঘরানায় ঢুকবার আগে দর্শকদের বরং হালকা উপভোগ্য কিছু উপহার দেয়া যাক।
অনুষ্ঠানে আমাদের পরিবেশনাগুলোর সবকিছুই আসলে কম-বেশি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল– আর করাচির অনুষ্ঠানটির বিশেষ দিক সম্ভবত এটিই ছিল। দর্শকদের জন্যে, এবং একই সাথে আমাদের দুজনের জন্যেও বিশেষ ব্যাপার ছিল সেটা। আমাদের জন্যে তারা যেমন নতুন ছিলেন, একে অপরের কাছে আমরাও নতুন অভিজ্ঞতাই ছিলাম।
নতুন একজন সংগীতজ্ঞের সাথে কাজ করার মাঝে বিশেষ একধরণের উত্তেজনা আর সতেজভাব কাজ করে। কয়েকবার এমন হয়েছে যে মঞ্চের অপর পাশ থেকে আদনান ফিসফিস করে আমাকে জানিয়েছে যে এরপরে ও কি বাজাতে যাচ্ছে, আমিও বুঝে তখন সায় দিতে মাথা ঝাঁকিয়েছি। ও বুঝতেই পারেনি যে ওর বলা কিছুই আমি শুনতে পাইনি।
সেবার আপনাদের কনসার্টটা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গিয়েছিল, দর্শকরা চেয়েছিলেন যেন আপনারা আরো অনেকক্ষণ বাজান।
খান : আসলে, অনুষ্ঠানের আয়োজকরা আমাদের কেবল দেড় ঘন্টা পরিবেশনার কথা বলেছিলেন, কেননা তারপরে একটা নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন তারা।
হুসাইন : কারো ডিনারের অনুরোধ রক্ষার্থে সম্ভবত সেদিনই প্রথম গোটা একটা কনসার্টের সমাপ্তি ঘোষণা হয়েছিল।
পাকিস্তানি দর্শকদের সামনে পরিবেশনার সময় কি কোন উত্তেজনা কাজ করছিল আপনার মাঝে?
হুসাইন : আমার জন্যে পাকিস্তানই এই সফরের সবচাইতে বড় আকর্ষণ ছিল। বেশ দীর্ঘ একটা সময় ধরেই এখানে আসবার এবং বাজনা অনুষ্ঠানে পরিবেশনা পেশ করার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আমার পূর্বপুরুষদের দেশ এটা। এমনকি, আমার চাচারা এখনো লাহোরেই থাকেন। আর শেষবার যখন আমি এখানে এসেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। এরপর অনেক দীর্ঘ একটা সময় কেটে গেছে।
প্রথমবার পাকিস্তান ভ্রমণের কোন স্মৃতি কি আপনার মনে আছে?
হুসাইন : সেবার ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে একটা বেড়ার উপর গড়িয়ে পড়বার কথা এখনো মনে আছে আমার, সেই ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন এখনো হাটুতে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আমার দুখানা পা– ভীষণ চিকন, ছোটবেলা থেকেই। সেবারে ভাট্টি গেটের সামনে হারিয়ে যাবার কথাও মনে আছে। আমার আব্বার এক বন্ধুর মালিকানাধীন এক নোংরা সিনেমাহলে যেয়ে হারকিউলিসও দেখেছিলাম সেবার।
পুরোনো সেই লাহোরে ঘুরে ঘুরে ছোলা আর হালুয়া খেয়েছিলাম। আমার জন্যে পাকিস্তান একটি সুন্দর স্মৃতির নাম। ভারতে নানা অনুষ্ঠানে দেখা হওয়া পাকিস্তানি সংগীতজ্ঞদের কাছেও এই দেশটা সম্পর্কে অনেককিছু শুনেছি আমি। সুতরাং, এদেশে আবারো আসার, নিজ চোখে ঘুরে দেখার অপেক্ষাটা আসলেই অনেক দিনের। এখানকার আলাদা বিশেষ ব্যাপারগুলো কি তা জানবার ইচ্ছাও ছিল আমার।
তো আলাদা বিশেষ কি দেখতে পেলেন এখানে?
হুসাইন : কিছুই না! যেমন করাচির কনসার্টটির কথাই ধরা যাক, মনে হচ্ছিল যেন খুব পরিচিত একদল দর্শকের সামনেই তবলা বাজাচ্ছিলাম আমি, যদিও সত্যি বলতে তাদের যেকারো সাথে সেটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাত। ব্যাপারটা দিল্লী বা লক্ষ্নৌ কিংবা ভারতের অন্য যেকোন জায়গার অনুষ্ঠানের মতই ছিল।
সত্যি বলতে, এখানে আসবার আগে ভেবেছিলাম যে প্রচন্ড রক্ষণশীল একটা দেশে পা রাখতে যাচ্ছি– আর সেটা হয়তো একারণেই যে এদেশ সম্পর্কে আমার অতীতে অর্জিত জ্ঞানটুকু সেরকমই ছিল। কিন্তু করাচিতে আমার বাজনা উপভোগ করা দর্শকদেরকে আমি যেরকম গোঁড়া ভেবেছিলাম, তারা মোটেও সেরকমটা ছিলেন না।
আমি ধারণা করেছিলাম হয়তো কিছু কড়া নিয়ম-কানুন থাকবে, আচার-ব্যবহারের নির্দিষ্ট তরিকা থাকবে। ভেবেছিলাম লোকজনের মধ্যে হয়তো খুব শান্ত আর সুস্থির থাকার একটা প্রবণতা থাকবে।
আসলে, বাইরের নানা দেশে পাকিস্তানি দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত অনেক অনুষ্ঠানে এমনই দেখেছি আমি, সেকারণেই ভেবেছিলাম এখানে এসেও হয়তো সেরকম গুরুগম্ভীর কিছুর সম্মুখীন হতে হবে আমাকে। কিন্তু করাচির ব্যাপারটা মোটেও সেরকম ছিল না। সেখানকার দর্শকদের জন্যে তবলা পরিবেশন করাটা আমিও বেশ উপভোগ করেছি। পুরো অনুষ্ঠানটায় একটা আরামদায়ক উষ্ণতা, একটা সন্তুষ্টি অনুভব করেছি আমি।
দর্শকদের মধ্যকার উত্তেজনা, আগ্রহও সত্যিকারের ছিল, টের পাচ্ছিলাম। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা। অনুষ্ঠান শুরুর মিনিট দশেকের মধ্যেই আমার সমস্ত সংশয় উবে গিয়েছিল। সত্যিই উপভোগ্য ছিল কনসার্টটা।
পাকিস্তানের সাথে সাংস্কৃতিক কোন টান কি টের পেয়েছেন আপনি?
হুসাইন : পাকিস্তানের ব্যাপারে সবসময়ই একটা আকর্ষণ ছিল আমার। সংস্কৃতি-কৃষ্টিগত দিক থেকে বলতে গেলে, আমি আমার সংগীত সাধনায় যা যা করি, তার অনেক কিছুর শিকড়ই এখানে এই পাঞ্জাবে প্রোথিত। বর্তমানে, তবলা বাজানো শেখার পাঁচটি স্কুল আছে– বানারস, লক্ষ্নৌ, দিল্লী, ফারুকাবাদ আর পাঞ্জাব।
সময়ের সাথে সাথে, এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে তবলা বাজানো শিক্ষায় অনেক উন্নতি হয়েছে। পাঞ্জাবের তবলা স্কুলটায় আমি নিজেই সংযুক্ত আছি। আমার পিতা, যিনি আমার গুরুও ছিলেন, তিনিও আমাকে এই রীতিতেই শিখিয়েছিলেন, আর তার গুরুও এখানে এই লাহোরেই বসবাস করতেন এবং এখানেই ইন্তেকাল করেছিলেন। আমার জন্যে তাই লাহোর প্রায় একটা তীর্থভূমির মতই ছিল। লাহোর আর সেখানকার মানুষের সাথে অদ্ভূত একটা আবেগের জায়গা আছে আমার।
জীবনে নিজেদের পেশা বেছে নেবার পেছনে সবারই কোন না কোন কারণ থাকে। আপনার ক্ষেত্রে তবলা বাজানো বেছে নেয়ার কী কারণ ছিল?
হুসাইন : ছোটবেলা থেকেই তবলা বাজানোয় যে সুখ, যে আনন্দ তা আর অন্য কিছুতে পেতাম না আমি। আমার জন্যে, তবলাই ছিল জীবন। এখনো আছে। কারো কারো আনন্দ পেতে কোকেইন নিতে হয়– আমি সেই একই কারণে তবলা বাজাই। কখনো দুঃখ পেলে, আমি তবলা বাজাই। কখনো খুব খুশি খুশি লাগলেও, আমি তবলা বাজাই।
জীবনে যত অনুভূতিই টের পেয়েছি, যা কিছু অনুভব করেছি, সবই এই যন্ত্রটার সাথে জড়িয়ে আছে। এটার কাছে থাকলেই সবচাইতে বেশি স্বস্তিতে থাকি। মনে হয় যেন সবকিছু আমার আয়ত্ত্বে আছে, আমার দিকে ছুটে আসা ভাল-খারাপ যেকোন কিছুর দারুণ মোকাবেলা আমি করতে পারবো। তবলা বাজানোর সময়েই মানুষের সাথে সবচাইতে বেশি সংযুক্ত মনে হয় নিজেকে। অথচ এমনিতে একদল মানুষের মাঝে ছেড়ে দিলে তার অর্ধেক আত্মবিশ্বাসও থাকবে না আমার মাঝে। কিন্তু তবলাটা আমার জন্যে অন্যরকম কিছু, খুব বিশেষ কিছু, এর মাধ্যমেই আমি মানুষকে আনন্দ দিতে পারি। আর তাতে আমারও ভাল লাগে।
হিট এন্ড ডাস্ট কি আপনার প্রথম সিনেমা ছিল?
হুসাইন : আমি বেশ কিছু টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তার মধ্যে এমনকি একটা সিগারেট ব্র্যান্ডও আছে, যদিও আমি নিজে ধূমপান করি না। কিন্তু হ্যাঁ, হিট এন্ড ডাস্টই আমার প্রথম সিনেমা। একদম শেষমুহুর্তে নাসিরউদ্দিন শাহের পরিবর্তে আমাকে চরিত্রটি প্রস্তাব করা হয়। উনার মনে হয়েছিল, চরিত্রটায় তেমন কারিশমা বা ক্ষমতা নেই, যেটা শশী কাপুরের চরিত্রে ছিল।
যে কারণে মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশনের কর্তাব্যক্তিদের শুটিং শুরুর মাত্র দশদিন আগে একটা কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্যে থেমে যাবার উপক্রম হয়েছিল। তো, শেষ রক্ষা হিসেবে উনারা আমার সাথে যোগাযোগ করে ডিনারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ইসমাইল এবং জিম’কে আমি অনেকদিন ধরে চিনতাম, তো ভাবলাম হয়তো সিনেমার কোন সংগীতায়োজনের জন্যে দেখা করতে চেয়েছেন, কিন্তু সাক্ষাতে উনারা আমাকে চরিত্রটা প্রস্তাব করে বসলেন। আর আমিও যেন প্রস্তুতই ছিলাম। তখন তারা জানালেন যে আমি জুলি ক্রিস্টির বিপরীতে অভিনয় করবো। আর আমার জন্যে সেটা সত্যি লোভনীয় ছিল।
তবে ভয়ও পাচ্ছিলাম। শেষপর্যন্ত শূটিং শুরুর একদিন আগে, ইসমাইল আমার বাড়িতে এলেন, আমার মামাকে দিয়ে একটা ব্যাগ গুছালেন এবং রীতিমতো ধাক্কিয়ে গাড়িতে ওঠালেন। এরপরে হায়দারাবাদের উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়লাম। সে রাতে আমার হাতে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে বলা হয়েছিল পরের দিনের শুটিংয়ের জন্যে ভোর সাড়ে ছয়টায় উঠে যেতে। এমনকি আমার মাপের কাপড়ও তৈরি ছিল না তখনো। ফলে কিছুদিন আমাকে অন্যদের কাপড় ধার করেই কাজ চালাতে হয়েছিল। ওটা সত্যিই বেশ মজার একটা অভিজ্ঞতা ছিল।
এবং স্বাভাবিক ভাবেই নিজের চরিত্রটাকে বুঝে উঠার জন্যে খুব বেশি সময় আমি পাইনি। কিন্তু জুলি খুব সহযোগিতা করেছিলেন। আমার জন্যে জেমস আইভরিকে বেশ হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল, কারণ আমার হাত দুটোর নড়াচড়াই থামাতে পারছিলাম না– যত যাই হোক আমি তো একজন জাত তবলাবাদক।
তাই সিনেমায় এমন অনেকগুলো দৃশ্য আছে যেখানে উনাদেরকে আমাদের অর্ধেক অবয়বের দৃশ্যধারণ করতে হয়েছিল, সেসব দৃশ্যে জুলি আমার হাত দুটোকে শটের নিচে নামিয়ে ধরে রাখতো, যাতে আমার হাত নাড়ানো ক্যামেরায় না আসে। অবশ্য তাতে আমি একটুও কষ্ট পাইনি!
আপনার জীবনের প্রথম সিনেমা হিট এন্ড ডাস্ট এর প্রধান একটি চরিত্রে কাজ করার পুরোটা সময়ে জুলি ক্রিস্টির কথা ভেবে কাটিয়েছেন আপনি! সত্যি বলতে, একজন নবীণের জন্যে মোটেও খারাপ না!
হুসাইন : আহ, এ ব্যাপারে আমাকে একমত হতেই হবে। কিন্তু সত্যিই, জুলি ক্রিস্টির সাথে কাজ করাটা ছিল একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন চমৎকার, এবং অবশ্যই একজন আবেদনময়ী ও বিখ্যাত অভিনেত্রী। হিট এন্ড ডাস্ট-এ কাজ করবার সময়ে মূলত ডি-হলিউডিং দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
ভবিষ্যতে অভিনয় নিয়ে কোন পরিকল্পনা আছে?
হুসাইন : এ মুহুর্তে আমি দুটি সিনেমার সংগীতায়োজনে কাজ করছি, যার একটিতে একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছি। আমার অভিনীত শেষ কাজটা ছিল কোয়েশ্চেন্স, সেখানে একজন সন্ত্রসবাদীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম আমি– কারণ সম্ভবত আমাকে দেখতেও সেরকম একজনের মতই লাগে!
আদনান, কনসার্টের রাতে রাগ গাইবার চাইতে বরং জ্যাজ বাজাতেই বেশি তুষ্ট দেখাচ্ছিল আপনাকে। আপনার কি মনে হয়, জ্যাজই আপনার ফোর্তে?
খান : আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই কেটেছে এ পর্যন্ত, তাই ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের সাথে আমার পরিচয়টাও এখনো অনেক নতুন। হয়তো দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার জন্যেই জ্যাজে বেশি স্বস্তি পাই আমি। তাছাড়া ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতে এটি অনেক বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ ঘরানাও বটে।
ছ’বছর বয়স থেকে সংগীত সাধনায় আছি আমি, কিন্তু পনেরোতে পা দেয়ার আগে ভারতীয় সংগীত জগতের সাথে আমার পরিচয় হয়নি। সুতরাং, খুব স্বাভাবিকভাবেই, আমাকে আরো অনেক জানতে হবে। আমি যখন পনেরো বছর বয়সের ছিলাম, মনে আছে একদিন আমার বাবা আমার জন্যে একটা ক্যাসেট বাজিয়েছিলেন– আমজাদ আলী’র দূর্গা।
তিনি তখন বলেছিলেন, এটা আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির একটা অঙ্গ, বলেছিলেন যে আমার উচিত সেটা মনোযোগ দিয়ে শোনা। আমিও বারবার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সেটা শুনেছিলাম, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অব্দি। শেষদিকে আমার চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এতগুলো বছর ধরে এত আপন কিন্তু এত বিশেষ একটা জিনিসের সাথে পরিচয়ও হয়নি আমার।
মনে হয়েছিল যেন আমি ভাঙ্গাচোরা চেয়ারে বসে থাকা সেই দুঃখী দরিদ্র লোকটার মত যে কখনো বুঝতেই পারেনি তার ভাঙ্গা সেই চেয়ারেই নিচেই অসাধারণ একটা ধনরত্নের সিন্দুক রাখা, কেননা সে কখনো জানবার চেষ্টাই করেনি।
জাকির, আপনি সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে বিশ্বসংগীতে একটা ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি, পাশ্চাত্যে পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা ধরণের সংগীতের জন্যে অবারিত সুিযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন, এই ওয়ার্ল্ড বিট- যে নামে নতুন এই ব্যাপারটাকে ডাকা হয়– এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা সংগীত বিপ্লব হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারবে?
হুসাইন : আমার মনে হয় এখনকার তরুণ সমাজ নানা ঘরানার সংগীতে অনুশীলন করার জন্যে অনেক বেশি সামর্থ্য রাখে। তাছাড়া, পৃথিবীর নানা প্রান্তের সংগীতগুলোকে রেকর্ড করা, সেগুলো থেকে অভিজ্ঞতা লব্ধের সুযোগ এখন অনেক। প্যারিসে থাকাকালীন সময়ে ওস্তাদ ফতেহ আলী খানকে দেখার জন্যে কনসার্টে গিয়েছিলাম আমি। বেশ ব্যয়বহুল ছিল সেটা। উনার কনসার্টে দর্শকরা সব উত্তেজিত হয়ে যেত, যদিও গানের কথাবার্তা কিছুই বুঝতো না তারা।
ওয়ার্ল্ড বিট দারুণ কাজ করছে, কারণ এর তাল-লয়-ছন্দ। শব্দ এখানে মূল ভূমিকা পালন করে না– এটা আপনাকে যেকোন জায়গায় নাচিয়ে তুলতে পারে। এমনকি যদি গানের বিষয়বস্তু আপনি কিছু নাও বুঝতে পারেন। শাস্ত্রীয় সংগীত– ভারতীয় কিংবা অন্য যেকোনটাই হোক– এতো বাধাহীন কোনটাই না।
এটা বরং আপনার ভেতরে ঢুকে যায়, আপনাকে উপলব্ধি করায় আসলে আপনি কে– আপনাকে আপনার সম্পর্কে জানায়, সেই অনুভূতি দেয়, আপনার মগজে সেটা গেঁথে দেয়। শাস্ত্রীয় সংগীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ গাম্ভীর্য্য, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রতিশ্রুতিশীল থাকাটা খুবই দরকার।
শাস্ত্রীয় সংগীত আপনাকে আপনার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আপনার স্নায়ুকে আরো সতেজ, আরো শক্তিশালী করে তোলে। নানা ধরণের বিষয়ে আপনার সামর্থ্য, আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। শাস্ত্রীয় সংগীতই আমাকে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যেয়ে আমার বাজনা পরিবেশনের আত্মবিশ্বাস দেয়। আমি জানি কাউকে বোকার মত অনুসরণ করার কোন প্রয়োজন নেই আমার।
আমি যদি হার্বি হ্যানককের সাথে কাজ করি, তাহলে তিনিও তো আমার সাথেই কাজ করছেন। কর জোড়ে হাটু ভেঙ্গে তাকে পূজো দেয়ার তো কোন দরকার নেই আমার। কেননা তার থেকে যেমন আমার শেখার আছে, তেমনি আমার থেকেও নিশ্চয় কিছু শিখতে পারবেন তিনি। শাস্ত্রীয় সংগীতে আমার চর্চাই নিজের নিজস্বতা না হারিয়ে বাকি নানা ঘরানার সংগীতের স্বাদ আর অভিজ্ঞতা গ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে, একই সাথে সেসব ঘরানার কদর করতেও শিখিয়েছে।
আমি জ্যাজ বা ব্লুজ ঘরানার সাথে আমার ঘরানার মেলবন্ধন ঘটাতেই পারি, কিন্তু তার পরেও আমার নিজের ভিত্তি কিন্তু অটুট থেকে যাবে। অন্যভাবে বললে, আমার একটা শিকড় আছে। আর তরুণদেরও আমি সবসময় এটাই বলি। নিজের শিকড়কে ভুলে যেয়ো না। নিজস্বতাকে ভুলে যেয়ো না। তুমি যেকোন কাপড়ই পরতে পারো চাইলে, যেকোন অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে পার, কিন্তু দিনশেষে ঘুমানোর আগে শোবার ঘরের বাতি নিভিয়ে নিজের মতো করে একটু আরামে ঘুমাতে চাইবে তুমি, কেননা সকলেরই নিজের বলে একটা ব্যাপার থাকে, সেটাই নিজস্বতা।
আপনি যদি কাক হয়ে ময়ূরের মত আভিজাত্য নিয়ে হাঁটতে চান, একসময় হয়তো নিজের আসল হাঁটার ভঙ্গিই বেমালুম ভুলে বসবেন। জীবনে ক্ষনিক সময়ের জন্যে ময়ূরের হাঁটা নকল করে মেকি প্রশংসা কুড়ানোর চাইতে হয়তো কাক হয়ে আত্মতুষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকাই ভাল।