দি আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক এফেয়ার্স কমিটি (এইপেক) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ৪-৬ মার্চ তাদের বার্ষিক সভার আয়োজন করেছিল। তথ অনুযায়ী এইপেক-এর উদ্দেশ্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী, সুরক্ষিত এবং ওই সম্পর্কের যথাযথ প্রচার করা যাতে এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ হারে নিশ্চিত করা যায়। তাদের কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টদের কাজ হলো এসব ব্যাপার নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের অবগত করা। একই সঙ্গে তাদের জানানো, ইসরায়েলকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কত বেশি লাভজনক। ওই বৈঠক শেষে সারা বিশ্বে এসব কথা ছড়িয়ে দেয়ার কাজও রয়েছে ওই তালিকায়।
অবশ্যই সংগঠনটির ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে ব্যয়সাধ্য দাবির লম্বা ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়েছে। দাবির মধ্যে আছে, ওবামার সরকারে শেষের দিনগুলোয় ইসরায়েলকে ১০ বছরের জন্য ৩৮ বিলিয়ন ডলার প্রদানের যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছিল সেটিতে কংগ্রেস-এর অনুমতি নিতে হবে। ইরানের ওপর অবরোধ বাড়াতে হবে। ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে পর্যবেক্ষক প্রেরণের শর্ত শিথিল করতে হবে এবং সারা দুনিয়ায় ইসরায়েল-বিরোধী সব আন্দোলন নজরে রাখার যে আইন মার্কিন হাউস ও সিনেটে আনা হয়েছে সেটিকেও সমর্থন জানায় এইপেক।
এইপেকের ওইসব নিঃসন্দেহে কোনাে মশকারা নয়। তারা যখন ধনী ব্যবসায়ীদের ওপর টাকা খাটায় তখন তা মার্কিন কংগ্রেসে তাদের প্রভাব কিনতে কাজে লাগে। কিন্তু দাবি মতে, ওই প্রভাব এখন আর কংগ্রেসে পর্যন্ত নেই, খোদ হোয়াইট হাউসে চলে গেছে। আসলে কি তাদের এত ক্ষমতা আছে যতটা তারা প্রদর্শন করে?
আসলে এইপেকের ওই সম্মেলনে আলোর ঝলকানি তার দাবি ও মিশনকে ছাড়িয়ে গেছে। সম্মেলনের মঞ্চই যেন বলে দেয়, ক্ষমতা প্রদর্শনকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তারা।
সম্মেলনে মঞ্চের দিকে ভালাে করে লক্ষ্য করলেই এইপেকের আসল বার্তার আঁচ পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র যেন ইহুদিবাদীরাই নিয়ন্ত্রণ করে- বক্তা যেই হোন। হোন তিনি সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, রাষ্ট্রদূত বা খোদ প্রেসিডেন্ট– আমেরিকা ও ইসরায়েলের যৌথ পতাকার সামনে যেন তারা ভীষণ ক্ষুদ্র। আর পতাকার দিকে চোখ দিলেই ইসরায়লের সমান যুক্তরাষ্ট্র যেন যুক্তরাষ্ট্র মানেই ইসরায়েল।
অবশ্য ওই সম্মেলনের এটি সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে সম্পূরক হিসেবে রয়েছে আরেকটি বিষয়। আমেরিকান কোনাে উচ্চ পদধারী প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রমুখ যখন ওই মঞ্চে দাঁড়ান তখন বড় করে এইপেক লেখাটির আলো তাদের বুক বরাবর এসে থামায় যা প্রমাণ করে ওই সংগঠন কতটাই না শক্তিশালী!
ওই দাঁড়ানোয় ক্যামেরার যে কারিগরি থাকে এতে চোখ পড়লেই মনে হয়, সংগঠনটির সামনে মানে, ইহুদিবাদীদের সামনে মানে, ইসরায়েলের সামনে দাঁড়ানো ক্ষমতাসীন সবাই খুব ক্ষুদ্র।
জোসেফ গোয়েবেলস ও লেনি রিয়েফেন্সতাহ তাদের বৈশ্বিক ক্ষমতার ধার বােঝানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন ওই সম্মেলনে। কিন্তু সংগঠনটির গর্জন যতটা শোনা যায় ততটা বর্ষণ তাদের হয় না, বরং এতে ক্ষতিই বেশি।
সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রে ওই জায়নিস্ট লবির ক্ষমতা ব্যাপক। তবে তারা এখন আর পেরে উঠছেন না, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনতাকে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা মার্কিন শাসক শ্রেণির দিকে ঝুঁকছেন।
আরো নিশ্চিত হতে তারা তাদের অর্থে পরিচালিত হাসবারা প্রপাগান্ডার যন্ত্র সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইহুদিবাদ বিরোধী যে কোনাে ব্যাপারের পরিপ্রেক্ষিতে নানানভাবে ঘৃণা ছড়ায়।
তাদের ধনী মুরুব্বিদের মধ্যে আছে শেলডন এডেলসন যিনি ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট করতে খরচ করেছিলেন ৫০ লাখ ডলার। এমনকি ফিলিস্তিনের বুকে মার্কিন দূতাবাস বসানোর টাকাও দিতে পারেন তিনি। আরেক মুরুব্বি আছেন হাইম সাবান যার বিখ্যাত কথা হলাে, ‘আমার জীবনে একটাই ইস্যু। তা হলাে ইসরায়েল।’ হিলারি ক্লিনটনের হাজার দুর্নীতির পরও ক্ষমতায় আসার যে হালকা সম্ভাবনা ছিল এতে ভরসা রেখে নানান সময়ে টাকা দিয়েছেন তিনি। সর্বোচ্চ প্রভাবের খাতিরে ইসরায়েলের ওই দুই মুরুব্বি দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে রেখেছেন। ওই দু’জনের বাইরে আরো মুরুব্বি আছেন। তাদের জন্য ইহুদিবাদীরা নতুন শব্দ চালু করেছে ওই ইসরায়ল সমর্থক জায়নিস্ট বিলিয়নারদের (ধনী) তারা বলেন, ‘জায়নিয়ার’।
নিঃসন্দেহে এটিই ক্ষমতা। এরপরও তারা খুব বেশি হুঙ্কার ছাড়েন। কিন্তু তাদের ওই হুঙ্কারের সমান ক্ষমতাশীল তারা নন। কিন্তু ভাব ধরেন, তারা মার্কিন ক্ষমতার আসল দেহ। তারা দেহ হতে পারলেও আমেরিকার রাজনীতির প্রাণ হতে পারার সম্ভাবনা তাদের নেই।
এইপেকের সম্মেলনে ওই জাঁকজমক অনুষ্ঠান ও হুঙ্কারই প্রমাণ করেছে, তারা কতটা নিরাপত্তাহীন ও অবৈধ। ইহুদিবাদীরা সবার চেয়ে ভালাে জানে, তারা ভেতরে ভেতরে কতটা ফাঁপা। তাদের ওই হুঙ্কার ও লম্ফ-ঝম্প উদাম করেছে, তারা চৌর্যবৃত্তি করছে এবং অন্যের দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত দখলদার। এসব সভা-সমিতি প্রমাণ করে, ইহুদিবাদীরা কতটা সাম্রাজ্যবাদী লুটপাটকারী।
মার্কিন সমাজ একটি জটিল সমাজ। নানান বাধাধরা নিয়ম ও আবেগের বিভিন্ন ব্যাপার সেখানে থাকে। সাদা চোখে দেখলে মনে হয়, তারা গোঁড়া, বহু রাজনৈতিক দল ও আদর্শে অনুপ্রাণিত। এ কারণে তাদের নিজ কাজে লাগানো সহজ। তাই ইহুদিবাদীরা নিজেদের ভুল পর্যবেক্ষণে বিশ্বাস করে অযাচিত ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
তারা সব সময় ওই দুর্বল প্রচারণা চালায়, ‘ইহুদিরা মার্কিন মুল্লুক নিয়ন্ত্রণ করে।’ তারা সব সময় এমন সব ক্ষমতার উদাহরণ হাজির করে, যতটা তারা নয়। তবে অনেক বিখ্যাত চিন্তক, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ওই ইহুদিবাদী প্রজেক্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন- আলবার্ট আইনস্টাইন থেকে হান্না আরেন্ডট, এমনকি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের অনেক ছাত্র পর্যন্ত।
কোনাে বিশেষ কমিউনিটি যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে না- না মুসলিম, না ক্রিশ্চিয়ান অথবা অন্য কেউ। ইহুদিবাদীরা অবশ্য নিয়ন্ত্রণের খায়েশ রাখে। তবে এ মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করছে না। করলে তা প্রদর্শনের এত আকাঙ্ক্ষা তাদের থাকতাে না।
এইপেক, শেলডন এডেলসন ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ অনেক ইহুদিবাদী নেতা সর্বশক্তি দিয়েও ওবামার সঙ্গে ইরানের পারমানবিক চুক্তি থামাতে পারেননি। যদি এসবের কোনাে ক্ষমতা তাদের থাকতাে তাহলে ইরান এতদিনে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেনের পরিণতি বরণ করতাে।
কেবল ওয়াশিংটনের ক্ষমতালোভী কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ইহুদিরা তাদের প্রভাব খাটাতে পারে। এর বাইরে এসবের কোনাে প্রভাব নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে আমরা সবাই জানি, টিকে থাকার লড়াইয়ে হাল ছেড়ে না দিলে কী অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক ভিডিওতে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেছেন বিখ্যাত বহু আমেরিকান। তারা কি ওই এইপেকের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন? কিন্তু মার্কিন মুল্লুকের ওই পবিত্র হৃদয়গুলোর আওয়াজ আমাদের কানে পৌঁছায় না।
মূলত আমেরিকা এমন একটি দেশ যেখানে প্রজন্ম ধরে জায়নিস্ট প্রপাগান্ডা সেখানের গণমাধ্যম, লবি ও কংগ্রেসের বহুবিধ প্রভাব নাগরিকদের নীরব থাকতে প্ররোচিত করতাে। কিন্তু ওই ভিডিওটি যেন অনেক হিসাব বদলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
আমেরিকায় আছি প্রায় ৪০ বছর এবং প্রতিনিয়ত ইহুদিবাদীদের নানান আক্রমণের মধ্যেই দিনাতিপাত করছি। ফলে কখনো ভাবিনি, আমেরিকা থেকে এ রকম ভিডিও প্রকাশ পেতে পারে। অথচ প্রপাগান্ডায় তাদের লাখ লাখ ডলার খরচ করে ইহুদিরা ওই দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টাকে দলে ভেড়াতে পারলেও সাধারণ মানুষজনের ক্ষেত্রে তারা বেশ ব্যর্থ।
বলা যায়, ফিলিস্তিন প্রশ্ন এখন আর দুনিয়ার এক-দুই জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি এরিক রেসনিক-এর মতাে মার্কিন ইহুদি ওই এইপেকের সম্মেলনের বাইরে শখানেক মানুষের সঙ্গে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। আলজাজিরা-কে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার পিতা-মাতা ইহুদি হওয়ায় হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তা নির্দোষ ফিলিস্তিনিদের হত্যা জায়েজ করার জন্য কোনাে কারণ হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের সঙ্গে আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই যে রকমটি হাজার বছর আগে ছিলাম।’
মার্কিন আদিবাসীদের গণহত্যা, আফ্রিকার দাস প্রথা, ইহুদি হলোকাস্ট থেকেও ফিলিস্তিনের মুক্তি আদায়ের আন্দোলন সব দিকে জোরদার হচ্ছে। এটি মুসলিম থেকে ক্রিশ্চিয়ান ও ইহুদি- সব জায়গায়।
সবশেষে বলতে চাই, এইপেকের ওই সম্মেলন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাওয়া অস্কার পুরস্কার অনুষ্ঠান থেকেও নিরস ও বস্তা পচা লেগেছে সব দিক দিয়ে।