প্রথম লেগের পূর্বে ম্যাচটি আক্ষরিক অর্থেই পেয়েছিল যুদ্ধের মর্যাদা। পেট্র ডলার ঢেলে অভিজাতের আঙিনায় প্রবেশ করার অভিপ্রায় নিয়ে ফুটবল জগতে আসা কাতারি ধনকুবের নাসের খেলাইফির উড়ন্ত পিএসজির লড়াইটা ছিল রয়াল ক্লাবের তকমা পাওয়া রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে। ফর্মের সঙ্গে যুঝতে থাকা রিয়াল এর বদলে অনেকে পিএসজি-কেই ঘোষণা করেছিলেন ফেভারিট হিসেবে। কিন্তু বার্নাব্যুতে ৩-১-এ বধ্বেস্ত হয়ে পিএসজি প্যারিসে ফিরে আসায় ওই যুদ্ধাভাবে লাগে ভাটার টান। এমনটা সাধারণে ভাবনা থাকলেও পিএসজির সমর্থকদের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তারা বার্নাব্যুর লজ্জাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যা দিয়ে পার্ক দি প্রিন্সেসে রিয়ালকে আহ্বান জানিয়েছিল আসল যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার। কিন্তু বিধিবাম। যুদ্ধ শুরুর আগেই পিএসজি হারিয়ে বসলো নিজেদের সবচেয়ে শানিত অস্ত্র নেইমারকে। তার অভাব পূরণ করে স্প্যানিশ গ্ল্যাডিয়েটরদের স্বপ্নভঙ্গ করাটা স্বপ্ন রয়ে গেল প্যারিসবাসীর। এতে বরং বেশ সহজেই পরবর্তী পর্বে উৎরে গেল জিদানের রিয়াল।
প্রথমার্ধে দু’দলই খেলেছে গতিশীল ও আক্রমণাত্মক ফুটবল। কিন্তু উভয়ের প্রচেষ্টাই বার বার প্রতিহত হয়েছে প্রতিপক্ষের রক্ষণবুহ্যের সামনে। মৌসুমে সম্ভবত প্রথমবার রিয়ালের রক্ষণকে মনে হয়েছে একটি চ্যাম্পিয়ন দলের রক্ষণভাগ। কম যায়নি পিএসজিও। থিয়াগো সিলভার নেতৃত্বে তারাও ছিলেন চমৎকার। ম্যাচে গোলের প্রথম সুযোগটি পায় রিয়াল কর্নার থেকে নেয়া রামোসের চমৎকার ভলিতে। সেটি চমৎকারভাবেই রুখে দেন পিএসজি গোলরক্ষক আরেওলা। আরেকটি পেয়েছিলেন করিম বেনজেমা। আরেওলাকে একা পেয়ে যে দক্ষতার সঙ্গে তিনি গোলটি মিস করেছেন সেটি আসলে ব্যাখ্যা করা কঠিনই। প্রথমার্ধে দু’দলের খেলোয়াড়দের পায়েই দেখা গেছে চমৎকার কারুকাজ। একই সঙ্গে দেখা গেছে শারীরিক শক্তি প্রয়োগের দক্ষতাও। দু’দলের বিপক্ষে মোট ১৪ বার বাঁশি বাজাতে বাধ্য হয়েছেন রেফারি। প্রথমার্ধ শেষ হয় ০-০-তে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গ্যালারির একপ্রান্তে আগুন জ্বেলে কলোসিয়ামের আবহ সৃষ্টির চেষ্টা চালায় পিএসজি সমর্থকরা। তাদের ওই প্রচেষ্টা ব্যুমেরাং হয়ে পড়ে যখন একক নৈপুণ্যে অনেকটা পথ দৌড়ে অ্যাসেন্সিও চমৎকার একটি বল থেকে লুকাসের মাপা ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে রিয়ালকে এগিয়ে নেন রোনালদো। বিমর্ষ পিএসজির যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনার সমাপ্তিরেখার প্রাথমিক ইতি ওই গোলেই টানা হয়ে যায়। বিষয়টি একদম নিশ্চিত করে দেন মার্কো ভারেত্তি দ্বিতীয় হলুদ কার্ড খেয়ে মাঠ ছেড়ে। এরপরও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া পিএসজি অবশেষে পায় কাঙ্ক্ষিত গোল। তবে এটি ছিল পুরোটাই ভাগ্য প্রসূত। কর্নার থেকে পাওয়া বলে আলভেসের হেড ডি মারিয়া হয়ে পাস্তোরের মাথায় পৌঁছালে তিনি যে দুর্বল হেডটি নেন এতে আর যাই হোক, গোল হওয়র সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু ওই হেডটিই রিয়ালের রক্ষণভাগের গায়ে লেগে ফিরে আসে কাভানির কাছে এবং তার গায়ে লেগে বলটি জড়ায় জালে। অসহায়ভাবে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না নাভাসের। এরই ঠিক দেজা ভ্যু যেন ছিল রিয়ালের জয়সূচক গোলটি। রোনালদো-কার্ভাহাল হয়ে কাসেমিরোর পায়ে বল পৌঁছানোর পর তিনি যে দুর্বল শুটটি নেন সেটি রেবিওটের গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে জালে জড়ালে নিশ্চিত হয়ে যায় যুদ্ধের যে হুঙ্কার পিএসজি দিয়েছিল তা নেহাত ফাঁকা বুলি। এরপর উভয়পক্ষই চেষ্টা চালালেও গোলের দেখা পায়নি কেউই।
ওই ম্যাচে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করেই দেখা গেছে। তা হলো রোনালদোর সঙ্গে লুকাসের চমৎকার বোঝাপড়াটা। রোনালদোর গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন বলেই নয়, বরং দু’জন যেভাবে দু’জনকে খুঁজে নিচ্ছিলেন এবং একে অপরের মুভমেন্টগুলো পড়তে পারছিলেন এতে এটা স্পষ্ট, পরবর্তী ম্যাচে লুকাসকে বেঞ্চে বসানোর আগে একাধিকবার ভাবতে হবে জিদানকে।
আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, ফুটবলে পেট্র ডলার আগমনের পর খেলোয়াড়দের দামে যেন আগুন লেগেছে। এক এমবাপ্পের জন্যই মোনাকো দাবি করেছে ১৮০ মিলিয়ন ডলার। কৌশলে তাকে ধারে দলে ভিড়িয়ে ওই মূল্য পরিশোধে পিএসজি প্রস্তুত থাকলেও এই ম্যাচ শেষে এ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, তিনি আসলেই ওই মূল্যের যোগ্য কি না। কেননা এমন কোনো ঝলক তিনি দেখাতে পারেননি যা ম্যাচের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। বরং লুকাস ও অ্যাসেন্সিও যাদের যৌথ মূল্যও এমবাপ্পের অর্ধেকেরও কম তারাই পুরো মাঠ কাঁপিয়েছেন, গড়ে দিয়েছেন দু’দলের মধ্যে পার্থক্য। এই পেট্র ডলারের আগমন দলবদলের বাজারটি করেছে অস্থির। প্রাপ্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বিকালেও কাজের সময় কতটা অসহায় ওই ‘কথিত’ তারকা সেটি যেন নতুন করে আবার দেখলো সবাই।
ওই ম্যাচে একজনের জিকির তো অপরিহার্য। তিনি হলেন করিম মোস্তফা বেনজেমা। গত দু’ম্যাচের নৈপুণ্যে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রায়। কিন্তু এ ম্যাচে তিনি যা খেলেছেন এর প্রশংসা বা সমালোচনা- কোনোটির জন্যই সঠিক শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গোলরক্ষককে একা পেয়ে মিস, ডি বক্স থেকে সুবিধাজনক স্থান থেকে বাইরে মারা। ফুটবলে নোবেল দেয়ার রেওয়াজ নেই। তবে ফেয়ার প্লে ট্রফিটা তিনি এবার দাবি করতেই পারেন। এতবার সুযোগ পাওয়ার পরও প্রতিপক্ষের মন না ভাঙার উদারতাটিকে এছাড়া আর কী বলবেন আপনি?

ম্যাচ শেষে অনেক ইতিবাচক দিকই খুঁজে পাবেন জিদান। মৌসুমে প্রথমবারের মতাে জমাট রক্ষণ, এগিয়ে থাকার পরও তীব্র গোল ক্ষুধা, তরুণদের দায়িত্ব নিতে শেখার দৃশ্যগুলো নিঃসন্দেহে আনন্দিত করেছে তাকে। একই সঙ্গে যোগ করুন দশজন নিয়েও পিএসজিকে হারানোর কৃতিত্ব। না, কেউ মার্চিং অর্ডার পেয়ে মাঠ ছাড়েনি। কিন্তু বেনজেমা যা খেলেছেন এতে এমনটা বলাই যায়। এ মৌসুমে ওই একটিই শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা এখনো বেঁচে আছে রিয়ালের। পিএসজির বিপক্ষের ওই জয় নিঃসন্দেহে আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া লাগাবে। লিগে ব্যর্থ রিয়ালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বাজিমাতের রেকর্ড আগেও রয়েছে। এমন রাতের পর আবার তেমন কিছুর স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়?