যে সহজ একটি প্রশ্ন কমবেশি সবার জীবনে একবার হলেও জ্বালাতন করেছে সেটি হলো এই, ইনসানের জীবন, এর আসলে অর্থ কী? বহু বিজ্ঞ বহুভাবে চেষ্টা করেছেন বিষয়টি ব্যাখ্যা করার। কিন্তু উপসংহারে কেউই আসতে পারেননি।
কোনো এক অজানা রাতে মদের বোতল হাতে বসা অ্যালেক্স আতালা। মদের ঘোরে বেঘোর আতালা-র মনেও একই প্রশ্ন জন্ম নিল, এই যে জীবন, তার আসল মানে কী? রাত কেটে ভোর হয়, কেটে যায় কড়া মদের নেশা। কিন্তু তার মন থেকে সরে না ওই প্রশ্ন। রাতের পর রাত কেটে যায়, জওয়াব আর মেলে না। এর কিছুদিন পর ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি। প্রথমেই যে দৃশ্যটি দেখলেন সেটি একটি ফুলের দৃশ্য। দৃশ্যটি মনে গেঁথে যাওয়ার আগেই দেখলেন তিনি ফিরে গেছেন কৈশরে। দু’পাশ থেকে দু’হাত ধরে রেখেছেন তার মা-বাবা। অস্পষ্ট স্বর ভেসে আসে যেন বহুদূর থেকে। আতালার সুকুন যে সাওয়াল কেড়ে নিয়েছিল এরই জবাব দিচ্ছেন তার বাবা। জীবনটা একটা বৃত্ত তথা গাছের মতো। প্রথমে চারা, সেখান থেকে গাছ, গাছ থেকে ফুল, ফুল থেকে ফল। এরপর আবার ওই শূন্যে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ চারায়। কৌতূহলী মনের তৃষ্ণা মেটে না এতেও। এটিই যদি জীবন হয় তাহলে প্রথমে ফুলের দৃশ্য কেন দেখলেন তিনি? ওই উত্তরটিও পেয়ে যান মুহূর্তেই। ফুল হচ্ছে জীবনের ওই মুহূর্ত যেটিতে আমরা বাঁচি তথা জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্ত। এবার মিললো সুকুন আর তিনিও পা বাড়ালেন আতালা হয়ে ওঠার পথে।
মাদক এই জন্য নিষিদ্ধ না যে এটি খারাপ। মাদক এই জন্য নিষিদ্ধ যে চমৎকার… এটি এমন চমৎকার যে, আপনাকে শেষ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট (হাসি)
এমন উক্তি যিনি অনায়াসেই করতে পারেন, সহজেই আঁচ করা যায় মনের কথা মুখে প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি কতটা অকপট। অবলীলায় স্বীকার করেন নিজের জীবনের আঁধারে ঢাকা সময়ের। তার জীবনকে তিনি কোনো রহস্য উপন্যাসে পরিণত করার চেষ্টা করেননি, বরং তার জীবনটা যেন একটি খোলা জানালা। এখানে যে কেউই ঢুঁ মেরে জেনে নিতে পারেন অমিত প্রতিভাবান ওই ইনসান সম্পর্কে।
আতালা জন্ম থেকেই আলাদা। তার মা-বাবা, ভাইয়েরা কেউই সাদা চামড়া বা লাল চুলের ছিলেন না। ফলে শুরু থেকেই নিজেকে অবাঞ্ছিত ভাবার এক প্রবণতা পেয়ে বসে তার মধ্যে। তার বয়স তখন ১৩ কি ১৪বছর। নেহায়েত কৌতূহল বশেই চলে গেলেন একটি রক কনসার্টে। সেখান থেকে প্রথমে ভাবনাবদল। ওই বদল থেকে নেয়া অপ্রত্যাশিত বাঁকের পরিণতি আজকের অ্যালেক্স আতালা। তাকে রান্নার জগতে বলা হয় ব্রাজিলের রোল মডেল। কনসার্টে গিয়ে দেখেন স্টেজে পারফর্ম করা অনেকেই দেখতে তার মতাে। বদলে গেল ভাবনা। আচমকাই ভালেবাসা জন্মালো রক মিউজিকের প্রতি। বাড়ি ছেড়ে যোগ দিলেন একটি ব্যান্ডে। সাধারণ আতালা-র স্বাভাবিক চেহারা ততদিনে বদলে গেছে। পাংক রকারদের মতো কানে দুল, পুরাে শরীরে উল্কি। কিন্তু ব্রাজিলে বাজিয়ে মনের তৃপ্তি মিটলো না। ঠিক করলেন ইউরোপ চলে যাবেন। কিছু টাকা জমিয়ে চলেও গেলেন। পাংক রকার আতালার ঠাঁই তো হলো বিদেশ-বিভুঁইয়ে। শুধুই মাথা গোঁজার ঠাঁই মিললে তো হবে না, পেটেরও যে চাহিদা আছে। সেটি মেটানোর জন্য শুরু করলেন দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার কাজ। এটুকুতে না হয় উদর শান্ত হলো। কিন্তু ভিসা? একের পর এক প্রশ্ন আসতেই থাকে সামনে। তার সঙ্গে গ্রাফিতি আঁকার কাজ করতেন এক ভদ্রলোক। তিনিই প্রস্তাব দিলেন রেস্টুরেন্টে কাজ করার। এতে পয়সার পাশাপাশি ভিসার সমস্যটাও মিটে যাবে।
কিশোর বয়সে নিজের উপার্জিত অর্থে ড্রাগ, সেক্স- এসব ছিল নিত্যকার ব্যাপার। আঁধারে ডুবতে বসা জীবনে আলো হয়ে এলো ওই প্রস্তাবটি। ওই যে হেঁসেলে ঢুকলেন আর বের হওয়ার নাম নিলেন না, বরং আঁধারের পথ থেকে ধীরে ধীরে পা বাড়াতে লাগলেন আলোর পথে। মানুষের তকদির লেখাই থাকে। সময়মতাে যিনি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন তিনিই হয়ে ওঠেন সফল। আতালাও পেরেছিলেন বলে আজ এক নামে বিশ্বে পরিচিত। আমাজনের অববাহিকায় শৈশব কাটানো আতালার জন্য পশুপাখি জবাই করে খাবারের জন্য প্রস্তুত করে তোলা তেমন কঠিন কিছু ছিল না। বাপ-দাদার সঙ্গে বহুবার শিকারে বের হওয়া আতালার জন্য এটি অভ্যস্ত কিছুই একটু পারফেকশনে করার মতো ব্যাপার ছিল। মাছ-মাংসের ডিশের ব্যাপারে তার একটি অদ্ভুত মন্তব্য রয়েছে। তিনি বলেন-
‘প্রতিটা ডিশের পেছনেই থাকে একটি মৃত্যু। কিন্তু আমরা যখন চোখ বুজে খাবারটি মুখে দিই তখন মুহূর্তেই বিষয়টি ভুলে যাই।’
প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি আতালার ওই মমত্ববোধ বহু পুরনো। কোনো ফ্যান্সি হেঁসেলের চেয়ে আমাজানের খোলা প্রান্তর বা কোনো ঝরনার পাশে বসে একমনে রান্না করতে দেখা যায় তাকে। তার জীবনে প্রকৃতির প্রভাব ব্যাপক। যাহোক, ইটালির মিলান-এ ব্রাজিলিয়ান কন্যা ক্রিশ্চিনার সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই প্রণয়ের প্রমাণ হিসেবে জন্ম নেয় জুনিয়র আতালা। তখনই আবার ভাবনার জগতে পরিবর্তন আসে তার। আচমকাই ধমনিতে অনুভব করেন বহমান ব্রাজিলিয়ান রক্তের স্পন্দন। প্রেমিকাকে নিয়ে মিলান ছেড়ে ফিরে আসেন সাও পাওলো-তে। এবার কোনো পাংক রকার নন, মানুষ অ্যালেক্স আতালা হয়ে। তিনি চেয়েছেন তার সন্তান বেড়ে উঠুক আট-দশ ব্রাজিলিয়ান শিশুর মতোই, বেড়ে উঠুক আমাজানের আবেশ গায়ে নিয়ে।
সাও পাওলোতে এসে আতালা চাকরি নেন একটি ফরাসি রেস্তোরাঁয়। রান্নার হাত দিয়ে ততদিনে মুগ্ধ করে দিয়েছেন সবাইকে। এক রাতে তাকে ডেকে তার মূল শেফ বলেন, ‘অ্যালেক্স, তোমার প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু তুমি কখনোই আমার মতাে করে কোনো ফ্রেঞ্চ ডিশ তৈরি করতে পারবে না। কারণ তোমার শিকড় এখানে গাঁথা।’ বিমর্ষ আতালার মাথায় প্রাথমিকভাবে কী এসেছিল তা তিনিই বলতে পারবেন। কিন্তু ওই ফরাসি শেফের একটি বাক্যেই বদলে যায় ব্রাজিলিয়নে ক্যুজিন-এর ইতিহাস। ব্রাজিলে তথন ফরাসি শেফরা ছিলেন রীতিমতো স্রষ্টার মতো। এর বাইরেও কদর ছিল ইটালিয়ানসহ অন্যান্য ক্যুজিনের। ব্রাজিলিয়ান ক্যুজিন ছিল অবহেলার এক নাম। পয়সা খরচ করে ব্রাজিলিয়ান রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া? না, ভাবনাটি তখনো কেমন যেন! আতালা ওই অসম্ভবকেই সম্ভব করলেন। একজন ফরাসি শেফ যদি ফরাসি রান্নাটা তার চেয়ে ভালো করতে পারেন তাহলে ভালো ব্রাজিলিয়ান রান্না কে করতে পারবেন? এ ভাবনা থেকেই সৃষ্টি ডি.ও.এম-এর। এর ডেকোরেশন থেকে শুরু করে প্রতিটা কোণে আপনি পাবেন ব্রাজিলিয়ান ঐতিহ্যের ছোঁয়া। ডি.ও.এম নেহায়েত কোনো সাদা-মাটা রেস্টুরেন্ট নয়। দুটি মিশেলিন স্টার পাওয়া ওই রেস্টুরেন্টটি ২০১২ সালের মে মাসে ‘রেস্টুরেন্ট’ ম্যাগাজিন কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছিল বিশ্বের চতুর্থ সেরা হিসেবে।
ডি.ও.এমের খাবারগুলোতে আপনি পাবেন খাঁটি ব্রাজিলিয়ান স্বাদ। একই সঙ্গে পাবেন আমাজানের অদ্ভুত এক সংযোগ। যেমন- পিঁপড়ার ডিশ যেটি আতালা আবিষ্কার করেছিলেন আমাজানের এক ছোট্ট ট্রাইবের মহিলার কাথ থেকে। এটি যেমন চমৎকৃত করবে তেমনি একইভাবে চমকে দেবে পাম গাছের শাসমূল থেকে তৈরি করা ডিশও। কালো চাল যা সবাই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এটিও ডি.ও.এম এর মেনুতে স্থান দিয়েছেন তিনি। যদি মনে করে থাকেন আমাজানের অজানা উপাদান দিয়ে রান্না করে চমক দেখিয়েই তিনি দায় সেরেছেন তাহলে বলতেই হয়, তাকে চিনতে এখনো বাকি আছে আপনার।
ডিওএমের যে সিগনেচার ডিশগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে তা হলো ‘অ্যান্ট অ্যান্ড পাইন অ্যাপলস’, ‘ব্ল্যাক রাইস উইথ গ্রিন ভেজিটেবলস অ্যান্ড ব্রাজিলিয়ান নাটস’, ‘পিরারুকু (আমাজানের মাছ) উইথ ম্যানিওক ফ্লাওয়ার’, ‘তুকুপি অ্যান্ড তেপিওকা’, ‘ব্রাজিলিয়ান ওয়ার্কার্স ফুড’, ‘লাইম অ্যান্ড রেভিওলি’, ‘অনিয়ন উইথ তুপিকা’ এবং অবশ্যই ‘দি আমাজনিক অ্যান্ট’।
শুধু খাবারের ধরনই নয়, উপাদানের বিষয়েও আতালার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের চেয়েই ভিন্ন। বিশ্বের অন্যতম ফেন্সি উপাদান ক্যাভিয়ার-এর স্বাদ নেয়ার পর আতালা বলেছিলেন, ‘আমি আসলে ঠিক নিশ্চিত নই এর স্বাদটি কেমন।’ এর কিছুদিন পর তার পরিচয় হয় আমাজানের লোকাল আইটেম তুকুপির সঙ্গে এবং প্রথমবারেই এর প্রেমে পড়ে যান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যেদিন প্রথম ক্যাভিয়ার টেস্ট করলাম সেদিন সত্যিই বুঝিনি এর স্বাদ কেমন। কিন্তু যেদিন প্রথম তুকুপির স্বাদ নিলাম সেদিন এটি ছিল অন্য রকম, এক কথায় অসাধারণ। তুকুপি ফেন্সি নয় ক্যাভিয়ার ফেন্সি। কারণ আমাকে মানুষ এটিই বলে এসেছে এতদিন।’ মানুষের ওই কথাটি যে তিনি গ্রাহ্য করেননি তা তার রান্নাতেই স্পষ্ট। তার প্রায় সব সিগনেচার ডিশেই তুকুপির ব্যবহার চোখে পড়ার মতাে। প্রচলিত মতামতকে চ্যালেঞ্জ জানানোর একটি প্রবণতাও বলা যায় এটিকে। আমাজানের ওপর অতুলনীয় দখল এবং একই সঙ্গে ক্ল্যাসিক ফ্রেঞ্চ টেকনিক তার রান্নায় যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।
২০০৩ সালে আমাজানের ভেতরেই একটি পশুর খামার কেনেন আতালা। উদ্দেশ্য আমাজানের অগ্রসর মানুষকে সাহায্য করা। এর কিছুদিন পর নিজের কেনা পশুর খামারে ফিরে গিয়ে যে দৃশ্যটি তিনি দেখেন সেটি প্রত্যাশা করেননি। চারদিকে প্লাস্টিকের ব্যাগ, বিয়ারের ক্যান। হতাশা থেকে তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তখন তার দিকে ইঙ্গিত করে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘এ অবস্থার দায় পুরোটাই তোমার।’ চুপ থেকে কথাটির সারবার্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন আতালা এবং ওই বৃদ্ধের সঙ্গে একমত হন। শুধু টাকা দিয়েই জীবনের মান উন্নয়ন সম্ভব নয়, মানুষের প্রয়োজন কাজ। আর ওই উপলব্ধি থেকেই জন্ম ‘অাতা’ বা ‘এটিএ’র। পশুর খামারটির চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে মরিচের বাগান। এক-দুই প্রজাতির নয়, প্রায় ৭০ প্রজাতির মরিচ পাওয়া যায় সেখানে। ওই বেনুয়া ট্রাইবের মানুষের কাছে মরিচের গুরুত্বও আলাদা। বিয়ের সময় মা তার কন্যকে উপহার হিসেবে দেন মরিচের বীজ যা সে চাষ করে। আতালার গল্পটাই এমন- আপনাকে এমন সব জায়গায় তিনি নিয়ে যাবেন যেটি আপনার ভাবনারও অতীত।
ব্রাজিলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ওই মানুষের জীবনটাই এক বিস্ময়। হাতের একপাশে আঁকা ছিল ক্ষেপাটে এক তরণের মুখ যা তরুণ আতালাকে চেনাতো। এর ঠিক পাশেই এখন আরো একটি উল্কি স্থান পাচ্ছে- হাসিমুখের এক শেফের ছবি। পাশাপাশি ওই দুটি ছবিই বলে দেয় কতটা বাঁক নিয়েছে আতালার জীবন। মানুষ আতালার একটি অংশ মাত্র শেফ আতালা। রান্নাটিকে জীবনের অংশ করে নিলেও রান্নাই তার জীবন নয়, বরং আমাজানের গহিন কোনো কোণে বসে থাকা আতালাকেই যেন মনে হয় আসল আতালা।