আল্লাহর অনুগ্রহই মুসলমানদের মূল শক্তি

আল্লাহর অনুগ্রহই মুসলমানদের মূল শক্তি

আমর ইবনুল আস রা. কাইসারিয়াহ (Caesarea, আধুনিক ফিলিস্তিনের প্রাচীন নগর) বিজয়ের পর মাত্র ৪ হাজার সৈন্য নিয়ে ৬৪১ খৃস্টাব্দ বিশাল মিসর বিজয় সম্পন্ন করেন। এরপর ৬৪২ (ভিন্ন মতে ৬৪৩) খৃস্টাব্দে লিবিয়ার বারকাহ প্রদেশ বিজয় করেন। কিছু সৈন্য দিয়ে উকবা ইবনে নাফি রা.-কে লিবিয়ার সর্বদক্ষিণের যাওয়াইলাহ অভিমুখে প্রেরণ করেন যা ওয়াদ্দান প্রদেশের একটি অঞ্চল। ইফ্রিকিয়ার পূর্বাংশ ও সুদানের মধ্যে এটি অবস্থিত।

একই সময়ে আমর রা. লিবিয়ার প্রধান বন্দর ও রাজধানী তারাবুলুস আল গার্ব অর্থাৎ গ্রিক ভাষায় যা ত্রিপোলি (Tripoli) অভিযানে বেরিয়ে তা বিজয় করেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. সারাবাহ, যাওয়াগাহ ও ওয়াদ্দান জয় করেন। এত প্রখ্যাত বীর সাহাবি সেনাপতির করতলে আশ্রয় নেয়া লিবিয়া ৬৪৪ খৃস্টাব্দে উমার রা. শহীদ হওয়ার সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহ করে বসে। পরে ৬৪৮ খৃস্টাব্দে পুনরায় উসমান রা.-এর খিলাফতকালে লিবিয়ার রোমান শাসক গ্রেগরি জিজিয়া প্রদানের শর্তে পুনরায় মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে।

এরপর ফের উসমান রা. শহীদ হলে গ্রেগরি বিদ্রোহ করে বসে। উসমান রা.-এর পিতা আফফান কোরাইশদের মধ্যে উমাইয়া শাখার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পিতার মৃত্যুকালে একেবারেই তরুণ ছিলেন উসমান রা.। পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত করেন ব্যাপকতরভাবে।

অল্পকালেই হয়ে ওঠেন বিজনেস আইকন। বিশাল সোনার মজুদ গড়ে তোলেন। গবাদিপশু, কাপড় ইত্যাদি ছাড়াও আমদানি-রফতানি নির্ভর বহুবিধ ব্যবসা ছিল তার। সেকালেও তার স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রার মালিকানা মিলিয়নে হিসাবযোগ্য ছিল।

উসমান রা. ছিলেন সেসব মানুষের একজন যারা জাহিলিয়াতের যুগেও ছিলেন পবিত্র। তিনি ওই সময় কখনো মদ পান করেননি, কোনো জিনায় লিপ্ত হননি, এমনকি তার নিজের ভাষায়- ‘তার ডান হাত কখনো কোনাে দেহের কোনাে গোপন অংশ ছোঁয়নি।’

কখনো গানের (ওই সময়কার প্রচলিত) মজসিলে যাননি। অন্যদের মতাে তিনি বিনোদনের জন্য জুয়াও খেলতেন না। তিনি সিরিয়ান ও আবিসিনিয়ান সভ্যতা স্বচক্ষে দেখেছেন যার অভিজ্ঞতা আরবে ছিল তখন অদ্বিতীয়। তিনি আরবি কবিতায় পারদর্শী ছিলেন।

সেকালেও তিনি ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাস বর্ণনাকারী, বংশধারা বিশেষজ্ঞ, প্রবচনবিদ, সুবক্তা। এত গুণ ও সমৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো লোকদের নীচু চোখে দেখেননি। কারো প্রতি তুচ্ছ সম্বোধন করেননি এবঙ বিবাদে লিপ্ত হননি।

যাবতীয় মানবিক গুণে এত উত্তমরূপে গুণান্বিত ছিলেন যে, তিনি ছিলেন লোকদের মধ্যে প্রবাদপ্রতিম ভালোবাসার প্রতীক। আরবের নারীরা তাদের সন্তানদের আবৃত্তি করে শোনাতেন, ‘আমি তোকে ততটাই ভালোবাসি যতটা বাসে কুরাইশরা উসমানকে।’

অথচ ইসলামকে আলিঙ্গন করা মাত্রই তার ওপর লোকজন অত্যাচার শুরু করলো। দুই হাত, দুই পা বেঁধে, স্যাঁতসেঁতে বদ্ধ, অন্ধকার কুঠুরিতে তাঁকে আবদ্ধ করে রাখতাে। অত্যাচার চরমে পৌঁছালে ইথোপিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হন তিনি।

যে মানুষ ইসলামে ছোঁয়ার আগেই এত উত্তম ছিলেন তিনি ইসলামের স্পর্শে এসে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছান। আবু বকর আর উমার ছাড়া কেউই আর তাকে অতিক্রম করতে পারেনি। তিনি ইসলামের জন্য অকাতর দান করেছেন।

প্রতি জুমায় তিনি ক্রীতদাসদের ক্রয় করে মুক্ত করতেন। কেবল তাবুক যুদ্ধে তিনি যে স্বর্ণ ও স্বর্ণমুদ্রা দান করেছিলেন এর ওজন ছিল ১০ কেজি পরিমাণ। এছাড়া তিনি এতে যুদ্ধ সাজে সুসজ্জিত ৯০০ উট দান করেছিলেন।

তার গৃহ ছিল পাথরের সর্বোচ্চ সজ্জায় সজ্জিত। দরজা ছিল স্যান্ডাল উডের। তা থেকে বের হতো সুগন্ধি। অথচ ওই মানুষই ৬৪৪ খৃস্টাব্দের ৭ নভেম্বর দায়িত্ব নিয়ে খেলাফতের ১২টি বছর শাসন করলেন। একটি টাকাও রাজকোষ থেকে নেননি।

জনগণের সেবায় নিজেকে ধূলির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। লোকদের দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হয়ে তাদের খোঁজ নিতেন। ইরবিয়ান পেনিনসুয়ার প্রান্ত থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত মুসলিম ভূমির বিস্তৃতি রচনা করেন।

আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবি সারহ একবার সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানকালে গ্রেগরি নিহত হয় ও তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর আর কখনো খ্রিস্টশক্তি হাজার বছর লিবিয়া ছুঁতে পারেনি। লিবিয়ার খ্রিস্ট শাসকরা ভেবেছিল সম্ভবত প্রতাপশালী শাসকের মৃত্যুই বোধহয় ইসলামের বিজয় স্তিমিত করে দেবে।

অথচ চূড়ান্ত দমনের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক খলিফার মৃত্যুর পর বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ ব্যক্তির যোগ্যতায় ইসলাম বিজয় লাভ করেনি, বরং মুসলমান বিজয় এনেছে আল্লাহর অনুগ্রহে। যেদিন থেকে ওই অনুগ্রহের তালাশ বন্ধ হয়ে গেছে সেদিন থেকেই মার খাওয়ার ইতিহাসের শুরু। ওই অনুগ্রহই মূলত মুসলমানের শক্তির উৎস।

সহায়ক গ্রন্থসূত্র

১। মাওসুয়াত আল তারিখ আল ইসলামি, আহমাদ শালাবি।

২। আল তাহমিদ ওয়াল বায়িন ফি মাক্বতাল আল শহীদ উসমান

৩। The Biography of ‘Uthman ibn ‘Affan Dhun-Noorayn
By: Dr. Ali Muhammad as-Sallabi (Translated by: Nasir Khattab)

৪। Atlas of Islamic Conquest by Ahmad Adil Kamal.

৫। তারিখ আল তাবারি, ইমাম তাবারি (تاريخ الرسل والملوك)।

৬। আল-কামিল ফিত-তারিখ , ইবনে আসীর (الكامل في التاريخ)।