বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের নীতি-নির্ধারকরা প্রায়ই বলে থাকেন, দু’দেশের সম্পর্ক বর্তমানে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। উভয়পক্ষ তাদের সম্পর্ককে ‘অবিশ্বাস্য উচ্চতা’য় নিতে পেরে সুখী। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, কথিত ওই সুখী সুখী সম্পর্কের মধ্যেই দু’দেশের যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)-র বৈঠক হয় না আট বছর হলো। সর্বশেষ ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে জেআরসি-র ৩৭তম বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকেই তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে এসেছিল দুই দেশ। কিন্তু ওই চুক্তিটিও অজ্ঞাত কারণে আজও স্বাক্ষরিত হয়নি।
যদিও আন্তর্জাতিক নদীতে অববাহিকা সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের পানির হিস্যা রয়েছে তবুও তিস্তা চুক্তির পটভূমি হিসেবে এরূপ অনানুষ্ঠানিক বোঝাপড়াও ছিল যে, ভারত ট্রানজিট (করিডোর?) সুবিধা পেলে বাংলাদেশ পানি পাবে। ওই আলোকে ইতোমধ্যে বৃহৎ প্রতিবেশীকে বাংলাদেশ স্থল ও নৌ করিডাের এবং তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিলেও বৃহত্তর রংপুরের মানুষ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। পাশাপাশি যৌথ নদী কমিশনকেন্দ্রিক সব আলোচনাও বন্ধ হয়ে গেছে। বলা যায়, দুই দেশের নেতৃবৃন্দ পর্যায়ে নিয়মিত নিরাপত্তা, বাণিজ্য, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হলেও পানি থাকছে আলোচ্য বিষয়ের বাইরে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন, ভাঙন রোধ, জেগে ওঠা চরের মালিকানা নির্ধারণসহ বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ জেআরসি গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর আগ পর্যন্ত ওই বিষয়ে বাংলাদেশকে সম্মত করতে ভারতের তাগিদেই মাত্র দুই বছরে ৭টি বৈঠক হয়েছিল জেআরসির। ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর গত ৪৪ বছরে সব মিলিয়ে বৈঠক হয়েছে হয়েছে মাত্র ৩০টি। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যৌথ কমিশনের বছরে ৪টি বৈঠক হওয়ার কথা। সর্বশেষ গত আট বছরে বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমও ভুলে গেছে, পানি বিবাদ নিরসনের লক্ষ্যে এরূপ একটা কাঠামো ছিল বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে।
এদিকে নতুন আরেকটি শুকনো মৌসুম চলে এলো বাংলাদেশে। শুকনাে মৌসুম মানেই উত্তর অঞ্চলে মানুষের জন্য চরম দুঃসংবাদ। তিস্তার প্রবাহ নিয়ে ভারতের সঙ্গে কোনাে চুক্তি না থাকায় আসন্ন চাষাবাদে সেচের নিশ্চয়তা থাকছে না।
এটা অনেকেরই জানা, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী তিস্তা।নীলফামারী দিয়ে এ দেশে ঢুকে কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা অঞ্চলে যমুনার সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিস্তা প্রায় ৮৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে। তিস্তার অববাহিকার আয়তন প্রায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এর প্রায় ১৭ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু মানুষের হিসাবে চিত্রটি অন্য রকম। পুরো তিস্তা অববাহিকায় বসবাসরতদের ৫০ শতাংশই বাংলাদেশের মানুষ।
বাংলাদেশের বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা দু’বছর আগে ঢাকায় একটি কনভেনশনে নিজস্ব তদন্তের ফল তুলে ধরে জানিয়েছিল, কেবল এক মৌসুমে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে ওই অববাহিকার ১২টি উপজেলায় চাষিদের ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। যদিও বহু বছর থেকেই ভারত এভাবে পানি প্রত্যাহার করছে তবুও উপরোক্ত হিসাবে কেবল সর্বশেষ আট বছরে ভারতের পানি নীতির কারণে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার চাষিদের ক্ষতি প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
সাধারণত সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি না পেলে কৃষক গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তোলেন। এ জন্য বিঘাপ্রতি ধান আবাদে খরচ বেড়ে যায় ৩-৪ হাজার টাকা। অথচ তিস্তায় পানি থাকলে দিতে হয় বিঘাপ্রতি মাত্র ১৬০ টাকা। উত্তরের জনপদে চাষিদের ওই সংকটের কথা সমকালীন বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি বা নীতি-নির্ধারণী পরিসরে কখনো গুরুত্ব পেয়েছে বলেও দেখা যায়নি।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত আট বছরে বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে যখনই মৃদুস্বরে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে এতে ভারত শুরুতে রাজি হলেও নির্ধারিত তারিখের পূর্বক্ষণে গিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ওই বৈঠক বাতিল করেছে। যেমন- পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২০১৪ সালের জুনে জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে ভারতের তখনকার পানি সম্পদ ও নদী উন্নয়ন মন্ত্রী উমা ভারতির কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। পরে বাজেট অধিবেশনের কথা বলে বৈঠকটি বাতিল করেন তিনি।
এদিকে গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ভারত শুকনো মৌসুমে এক পর্যায়ে তিস্তা দিয়ে মাত্র ৪০০-৫০০ কিউসেক (কিউসেক = প্রতি সেকেন্ডে এক ঘনফুট) পানি ছাড় করছে বাংলাদেশের জন্য। অথচ বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প এলাকার কেবল প্রথম পর্যায়ের ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের জন্য ৫ হাজার কিউসেক পানি দরকার।
অন্যদিকে তিস্তার প্রবাহে সীমান্ত গলিয়ে পানি না এলেত্রিপুরার সাবভ্রুম দিয়ে ফেনী নদী থেকে বাংলাদেশের ‘সম্মতি’তেই প্রতিদিন পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখেছে ভারত। ওই নদীটি প্রচলিত অর্থে দ্বিপক্ষীয় নদী নয়। অথচ ওই নদী থেকে পানি নেয়ার জন্য নদীর তীরে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে অনেক পাম্পও বসিয়েছে ভারত।