শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং লেখক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা গণমাধ্যমের কল্যাণে সবাই জেনেছেন। সর্বশেষ খবর মতে, তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে। হামলার পর পরই হামলাকারীদের একজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, ওই হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সুনামগঞ্জ কৃষক লীগের এক নেতাকেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবুও হামলার ঘটনা ঘিরে উঠে আসছে নানান প্রশ্ন, চলছে দোষারোপের রাজনীতি।
প্রথমত. অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনাটি তখন ঘটলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপ-সহকারী লিসা কার্টিস তিন দিনের সফরে গতকাল শুক্রবার (২ মার্চ) ঢাকায় এসেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত. গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শদাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ‘কাউন্টারিং জিহাদিস্ট মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এখানে ইউরোপের ওই প্রভাবশালী নীতি-নির্ধারণী সংস্থাটি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনীতিতে বিভক্তির সুযোগে বাংলাদেশে ‘ইসলামি উগ্রবাদ’ প্রসারের আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে। তাছাড়া ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন নিয়েও আলাপ উঠেছে সেখানে।
এখানে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হলো, জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর হামলাকারীর পরিচয় সংক্রান্ত যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে সেটি নিয়েও আছে বিভিন্ন মত। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই হামলাকারীকে মাদ্রাসার ছাত্র বলে পরিচয় দেয়া হলেও মাদ্রাসার নাম কিংবা সেটির অবস্থান জানাতে পারেননি কেউ কিংবা এত ঘণ্ট পরও হামলার কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কেও কোনো খবর জানাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশের এক বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের ওপর হামলার উদ্দেশ্য নিয়েও এক রকমের ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে।
অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই ঘটনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রবিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ (এনএসটি) ও গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা সম্পর্কে বলেন, ‘যারা ওই ঘটনাগুলো ঘটায় তারা ধর্মান্ধ। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল একটি অনুষ্ঠানে বসে ছিলেন। সেখানে তাকে ছুরি মারা হয়েছে। হামলাকারী কারা- এটা হামলার ধরন থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ হামলাকারী ফয়জুরের কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা আছে কি না এ সম্পর্কে কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে এ ধরনের বক্তব্য বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
আবার ওই হামলার ঘটনায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যও পাওয়া গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ওই হামলায় বিএনপিকে পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করেছেন দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউ কেউ। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ হামলার সঙ্গে সরকারই জড়িত। ফলে রাজনীতিবিদদের ওই ধরনের পাল্টাপাল্টি মন্তব্য বিচারাধীন বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
নানান সময়ে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশে ‘উগ্রবাদ’-এর উত্থান হয়েছে বলে দাবি করে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একজন সফরে থাকা অবস্থায় এ ধরনের হামলা নতুন কোনাে সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের শাহবাগে আন্দোলনের পর নানান সময়ে ‘প্রগতিশীল ব্লগার’দের ওপর হামলার ঘটনায় আসল দোষীদের বিরুদ্ধে বিচার শেষ করে চিহ্নিত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়া এখনো শেষ করা যায়নি। ফলে স্বভাবতই ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীর পরিচয় নিয়ে রাজনীনি আগের বিচারগুলোর মতাে পরিণতি বরণ করবে কি না সেটিই দেখার অপেক্ষায় সবাই।