তুরস্কে লেখক-চিন্তকদের গ্রেফতার-কারাদণ্ডের প্রতিবাদে এবার ওই দেশের রাষ্ট্রপতি বরাবর খোলা চিঠি লিখেছেন সারা দুনিয়ার প্রখ্যাত ৩৮ নোবেল বিজয়ী। তারা তুরস্কে ঘটে যাওয়া ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর নানান সময় আটককৃত সাংবাদিক-কলামিস্টদের মুক্তির দাবিতে ওই পত্র প্রকাশ করেন। ‘দি গার্ডিয়ান’-এর মতামত বিভাগে প্রকাশিত ওই চিঠিতে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইপ এরদোগান-কে ওই দেশের মুক্তকণ্ঠ ও প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার আহ্বান জানান তারা। ভিএস নাইপল, কাজুও ইশিগুরো, জে এম কোয়েতজি, জোসেফ স্টিগলিটজসহ বিশ্বনন্দিত নোবেল জয়ীরা ওই মুক্তপত্র সমর্থনে স্বাক্ষর করেন। ডয়েচে ভেলে-র মতে, মূলত ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এরদোগান বিরোধী ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর প্রায় হাজারখানেক বিরোধী মতের মানুষকে কারাগারে পাঠিয়েছে ওই দেশের সরকার। নোবেল জয়ীদের ওই চিঠি এখানে পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করে প্রকাশ করা হলাে—

সম্মানিত রাষ্ট্রপতি,
আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই সূত্রে যে, তুরস্কের বেশ কয়েক লেখক ও চিন্তককে নানান সময় বেআইনি গ্রেফতার এবং অন্যায় দণ্ড দেয়ার যে অভিযোগ উঠেছে তা তুরস্কের সুনাম, মর্যাদার ও সেখানকার জনগণের প্রগাঢ় উদারতাকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।যেমন- ২০১৭ সালে তুরস্কে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক এক স্মারকলিপিতে নিলস কাউন্সিল অফ ইউরোপ কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস-এর নিলস মিউজিয়েক্স সতর্ক করে বলেন, ‘তুরস্কে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমন- সাংবাদিক, সংসদ সদস্য, শিক্ষক, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের ওপর নানান সময় সরকারি খড়্গ নেমে আসায় সেখানে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংকট একটি আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ ওই দেশের বহুত্ববাদকে ধ্বংস করে এক ধরনের সেন্সরশিপের আওতায় নিয়ে এসেছে। এ রকম অবনতির পেছনে হয়তােওেই দেশের পরিস্থিতির প্রভাবও থাকতে পারে। কিন্তু কোনাে অভ্যুত্থানের চেষ্টা অথবা জঙ্গি হামলার কারণ দেখিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও যথাযথ আইন প্রয়োগে অনীহা চলতে পারে না।’
তুরস্কের কর্তৃপক্ষের উচিত প্রয়োগকৃত আইন ও এর চর্চায় সংস্কার আনা, বিচারিক স্বাধীনতাকে আরো মজবুত করা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে কার্যকর করে তোলা।
কমিশনারের উদ্বেগের কয়েকটা উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে। যেমন- তুরস্কে ২০১৬ সালের ব্যর্থ ক্যু-র পর সেখানে সেপ্টেম্বরে আটক হন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও কলামিস্ট আহমেত আলতান। একই সঙ্গে গ্রেফতার হন তার ভাই অর্থনীতির অধ্যাপক ও প্রবন্ধকার মেহমেত মেলতান। আবার গ্রেফতার হন নাজলি ইলিচাক-এর মতাে প্রখ্যাত সাংবাদিক। এসব লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে সংবিধানবহির্ভূত কাজ করতে চেষ্টা করেছিলেন। সরকারিপক্ষের অভিযোগের তীর মূলত অভ্যুত্থানপন্থীদের প্রতি, গ্রেফতারকৃতদের সুতীক্ষ্ণ সমর্থনের দিকে। এমনকি ওই অভ্যুত্থানকে উসকে দেয়ার অভিযোগও তাদের দিকে। ফলে তুরস্কের সরকারি খবরমাধ্যম এটিকে ‘অভ্যুত্থান উসকে দেয়ার বিচার” বলে সম্বোধন করছে।
কমিশনারের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, আহমেত আলতান-এর মামলায় প্রমাণ বলতে কেবল ২০১০ সালের ‘তারাফ’ পত্রিকার যেটির প্রধান সম্পাদক ছিলেন আলতান সেখানে প্রকাশিত তিনটি কলাম ও একটি টিভিতে প্রদত্ত একটি বক্তব্য। অন্যদের ক্ষেত্রে ওই তথ্য-প্রমাণাদি পর্যন্ত নেই। ওই লেখকদের সবাই কাজকর্ম ও লেখায় সব সময় অভ্যুত্থান বিরোধী অবস্থান নেয়া হয়েছে। তবুও তাদের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র গ্রুপকে মদদসহ অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
কমিশনার আলতান ভাতৃদ্বয়ের বিচারকে সরকার বিরোধী সমালোচকদের দমন করার একটি বিশাল চিত্র হিসেবে দেখেছেন। তিনি মনে করেন, এ ধরনের গ্রেফতার মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও আইনের শাসনবহির্ভূত। জাতিসংঘের বিশেষ দূত, ডেভিড ক্যাই ওই বিচার প্রক্রিয়াকে এক ধরনের ‘প্রদর্শনের বিচার’ বলে দাবি করেছেন।
তুরস্কের নিজস্ব সাংবিধানিক আদালত ওই সমালোচনার সঙ্গে একমত। ওই অনুযায়ী গত ১১ জানুয়ারি মেহমেত আলতান ও সাংবাদিক সাহিন আলপ-এর আটকাদেশ আইনবহির্ভূত বলে রুল জারি করে আদালত এবং তাদের মুক্তির আদেশ পর্যন্ত হয়। ওই সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আদেশটি পরে বাতিল হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট, আপনার জানা উচিত নিম্ন আদালতের এসব অবাধ্যতা ও বেআইনি সিদ্ধান্তগুলো সরকারের মুখপাত্র পর্যন্ত সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আলতান ভাতৃদ্বয় ও ইলিচাক-কে ভবিষ্যতে কোনাে সুযোগ না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান, আমরা যারা নিচে স্বাক্ষর করেছি তারা ডেভিড ক্যাই-এর সঙ্গে সহমত যে, ‘সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানে যুক্ত থাকার যথাযথ প্রমাণাদি না থাকার পরও সাংবাদিকদের এভাবে যাবজ্জীবন দেয়া তুরস্কের গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি ব্যাপক হুমকি ছাড়া কিছু নয়।’
১৯৯৮ সালের এপ্রিলে ইস্তান্বুল-এর মেয়র থাকা অবস্থায় সামান্য সরকার বিরোধী কবিতা পাঠ করার কারণে আপনি রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হন, দশ মাসের কারাদণ্ডেও দণ্ডিত হন। আজকের মামলা এবং ওই দিনের আপনার মামলার ধারা একই- পেনাল কোডের ৩১২ ধারা। ওই বিচার ছিল অন্যায়, বেআইনি ও নিষ্ঠুর। তখন নানান মানবাধিকার সংগঠন আপনার ওপর চাপিয়ে দেয়া ওই রায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঠিক আজকের মতােই। ফলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেয়া আদালতের ওই রায়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পেন ইন্টারন্যাশনাল, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট, আর্টিকল ১৯ ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সসহ বেশকিছু সংগঠন গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আলতান-এর সম্মানে আয়োজিত এক বৈঠকে আপনি দাবি করেছিলেন, ‘ওই তুরস্ক এখন আর সেখানে নেই যখন তুরস্ক-এর বিখ্যাত লেখকদের জেলে যেতে হয়েছিল। ওই যুগের বিদায় হয়েছে।’ ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সেতিন আলতানের দুই সন্তান আহমেত ও মেহমেত। আজ ৯ বছর পর তারাই জেলে আছেন। এটিকে আপনার ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সাঙ্গে ধোঁকা মনে হয় না প্রেসিডেন্ট? তাই এসব ব্যাপার সামনে রেখে তুরস্কের জনতার ভেতরেই, এমনকি তার মিত্র ও নানান সংগঠনের বিভিন্ন সময় প্রকাশিত শঙ্কা থেকেই আমরা এসব বলছি।
সরকারের বিরোধী মতের প্রতি আমরা কঠোর অবস্থার অবসান চাই এবং সরকারকে আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার রাস্তায় হাঁটার আহবান জানাই। এর মধ্য দিয়ে যেন আটককৃত সাংবাদিক ও লেখকদের আশু মুক্তি মেলে। এভাবেই যেন তুরস্ক মুক্ত পৃথিবীর গর্বিত সদস্য হিসেবে আবার দাঁড়াতে পারে।স্বাক্ষরকারীদের তালিকা
সেভেটলানা এলক্সিয়াভিচ, ফিলিপ এইচ এণ্ডারসন, এরন চিয়াকানোভার, জেএম কোয়েতজি, ক্লাউদ কোহেন তানৌজি, ইলিয়াস জে কোরে, গেরহার্ড এটেল, আলবার্ট ফার্ট, এডমন্ড এইচ ফিশ্চার, এন্ড্রু জে ফায়ার, আন্দ্রে গিম, শেলডন গ্লাসগো, সার্জ হারুছে, লেলান্ড এইচ হার্টওয়েল, অলিভার হার্ট, রিচার্ড হেন্ডারসন, ডুডলে হার্শবাচ, আভ্রাম হার্শকো, রোয়াল্ড হোফম্যান, রবার্ট হুবার, টিম হান্ট, কাজুও ইশিগুরো, এলফ্রিদে জেলিন্যাক, এরিক এস মাসকিন, হার্টমুট মাইকেল, হার্তা মুলার, ভিএস নাইপল, উইলিয়াম ডি ফিলিপ্স, জন সি পলানউই, রিচার্ড জে রবার্টস, র্যানডি ডব্লিউ শ্যাকমেন, ওলে সোয়িনকা, জোসেফ স্টিগ্লিটজ, টমাস সি সুঢোফ, জ্যাক ডব্লিউ জোস্তাক, মারিও বোর্হেস লোসা, জে রবিন ওয়ারেন ও এরিক এফ উইশাউজ।