রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকেই নানান সময় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে। গত ২৭ ও ২৮ আগস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর পুনরায় একাধিক হেলিকপ্টার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে। এ ঘটনা একবারই ভুল করে ঘটেনি, বরং ছিল ইচ্ছাকৃত ও বার বার ঘটেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ওই ঘটনার কেবল ‘কঠোর প্রতিবাদ’ করেই নিভৃত থেকেছে। মিয়ানমার-এর সেনাবাহিনী আর উগ্রবাদী বৌদ্ধদের নির্যাতনের মুখে লাখো লাখো অসহায় রোহিঙ্গা যখন দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তখন মিয়ানমারের ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ স্পষ্টভাবেই আমাদের সামনে আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন বার্তা হাজির করেছে। কিন্তু রক্তের ছোপ পেরিয়ে বাংলাদেশের চাল কেনার রাজনীতি আর ফুল বিনিময়ের কূটনীতিতে ওইসব প্রশ্ন দ্রুতই হারিয়ে গেছে। এরপরের ঘটনাগুলো তো সবারই জানা। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও কীভাবে রোহিঙ্গা জনগােষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে এর চিত্র রয়টার্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্ব দেখেছে। তবুও দমেনি মিয়ানমারের ঔদ্ধত্য, বরং বেড়েছে বহুগুণে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার খবর প্রকাশের দায়ে রয়টার্স-এর দুই সাংবাদিকে গ্রেফতার করে বন্দি করে রেখেছে মিয়ানমার সরকার।
গত ১ সেপ্টেম্বর আবারও বাংলাদেশ সীমান্তের দেড়শ’ গজের মধ্যে মিয়ানমার তাদের সেনা সমাবেশ ঘটায় এবং মাইকিং করে ওই নো ম্যান্স ল্যান্ড এলাকা থেকে সবাইকে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। ওই ঘটনাটি তখন ঘটে যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতায় বিস্মিত হয়ে শান্তিতে তিন নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশ সফর করছেন। তাদের মধ্যে আছেন ইরান-এর শিরিন এবাদি, আয়ারল্যান্ড-এর মারেইড ম্যাগুয়ার ও ইয়েমেন-এর তাওয়াক্কুল কারমান। ওই তিনজনই মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সফরের প্রথমেই তারা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। কথা বলেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এবং এই পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সু চি-কে দায়ী দাবি করে এটিকে স্পষ্ট গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেন তারা। রোহিঙ্গা-দের ওপর অত্যাচারের জন্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন।
এদিকে সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড-এ মিয়ানমারের সৈন্য সমাবেশ করার পর বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত-কে তলব করেছে বাংলাদেশ। অবশ্য ওই সামরিক উস্কানির ব্যাপারটিকে বিভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের ওই সামরিক তৎপরতাটিকে কেউ কেউ দেখছেন শুধু রোহিঙ্গাদের আরো ভীত করার প্রক্রিয়া হিসেবে।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক ডিফেন্স এটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে-কে বলেন, ‘মিয়ানমার যে সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে এর টার্গেট বাংলাদেশ নয় বলেই মনে মনে করি৷’ তিনি দাবি করেন, নো ম্যান্স ল্যান্ড-এ আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভয়-ভীতি দেখানোর জন্যই এটি করেছে মিয়ানমার৷
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসান চুক্তির পর গত মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সফর করেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর ঠিক পরই এ ধরনের সামরিক উত্তেজনা ওই চুক্তি বাস্তনায়নের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার ওই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে-এ ফিরে যেতে আগ্রহী হবনি কি না সেটিও বড় বিষয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির এক জায়গায় বলা আছে, শুধু যারা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন করতে চান, মিয়ানমার কেবল তাদের ফেরত নেবে। কিন্তু সীমান্তে ওই ধরেন সামরিক মহড়া দিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের পর স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। ফলে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার জন্যই তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবেন না। এতে খোদ প্রত্যাবাসন চুক্তি কার্যত ব্যর্থ হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা অনেকের।
এতকিছুর পরও বাংলাদেশ যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার তাগিদ অনুভব করছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ওইসব ঘটনার বিপরীতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে নজর দিলে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত বাংলাদেশের ওই অতি নমনীয় আচরণের ফলেই মিয়ানমার ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পাচ্ছে। তা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অগ্রগতির বড় দুর্বলতা হিসেবেই সামনে আসবে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ সরকার কেন মিয়ানমারের ওই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরে আওয়াজ তুলতে পারছে না কিংবা কেন মিয়ানমারের সামরিক উস্কানির সমুচিত জবাব দিতে পারছে না। এক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকার বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। মিয়ানমারের ওই ঘটনায় এ কথাই ঘুরে-ফিরে আবার যেন সামনে চলে এসেছে।