খতমে তারাবি-র নামাজে ইমামতিতে বেতন গ্রহণ জায়েজ কি না এ প্রসঙ্গে একটি ফতোয়ার আবেদন করা হয় দেশের অন্যতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা-য়। ঢাকার মিরপুরের এক ব্যক্তি ওই আবেদনটি করেন। গবেষণামূলক উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা-র মুখপত্র মাসিক ‘আল-কাওসার’-এ ২০০৯ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ফতোয়াটি প্রকাশ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ওই ফতোয়াটি ‘জবান’ পাঠকদের জন্য নিচে প্রকাশ করা হলাে।
খতম তারাবির বিনিময় দেয়া-নেয়া দুটিই নাজায়েজ। হাদিয়া-র নামে দিলেও জায়জে হবে না। এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন হিসেবে দিলেও জায়েজ নয়। এক্ষেত্রেও প্রদেয় বেতন তারাবি ও খতম-এর বিনিময় হওয়া স্বীকৃত। মোট কথা, খতম তারাবির বিনিময় গ্রহণের জন্য হিলা অবলম্বন করলেও তা জায়েজ হবে না। কারণ খতমে তারাবি খালেস একটি ইবাদত। তা নামাজ ও রোজার মতো ‘ইবাদতে মাকসুদা’র অন্তর্ভুক্ত। এমন ইবাদতের বিনিময় বা বেতন দেয়া-নেয়া উম্মতে মুসলিমার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েজ। এতে না কোনো মাজহাব-এর মত পার্থক্য আছে, না পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ফকিহদের মধ্যে কোনো মতভেদ আছে।
ইমামতির বেতন ঠিক করা এবং তা আদায় করা যদিও পরবর্তী ফকিহদের দৃষ্টিতে জায়েজ তবুও খতম তারাবির বিনিময়টি ইমামতির জন্য হয় না, বরং তা মূলত খতমের বিনিময়ে হয়ে থাকে। আর তেলাওয়াতের বিনিময় গ্রহণ করা সব ফকিহ-এর কাছে হারাম। অধিকন্তু পরবর্তী ফকিহরা যে ইমামতির বেতন জায়েজ বলেছেন তা হলাে ফরজের ইমামতি। সুন্নাত জামাত ইমামতির অন্তর্ভুক্ত নয়।
আর হাফেজদের দেয়া বিনিময়কে জায়েজ করার জন্য ওই হিলা অবলম্বন করা যে শুধু রমজান মাসের জন্য তার ওপর দু’এক ওয়াক্ত নামাজের দায়িত্ব দেয়া হবে এটি একটি বাহানা মাত্র। তা পরিহার করা জরুরি। কারণ ওই হিলার যে বিনিময়য়টি তাকে ফরজের ইমামতির জন্য দেয়া হচ্ছে আর তারাবির খতম তিনি বিনিময়হীনভাবেই করে দিচ্ছেন। কিন্তু আপনার মনকে একটু প্রশ্ন করে দেখুন, যদি ওই হাফেজ সাহেব তার দায়িত্বে অর্পিত ফরজ নামাজের ইমামতি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গেও আদায় করেন আর খতম তারাবিতে অংশগ্রহণ না করেন তাহলে কি তাকে ওই বিনিময় দেয়া হবে যা খতম তারাবি পড়ালে দেয়া হতো? এ কথা সুস্পষ্ট, কখনো তা দেয়া হবে না। বোঝা গেল, বিনিময়টি মূলত খতম তারাবির, ফরজের ইমামতির নয়। এ জন্যই আকাবিরের অনেকে ওই হিলা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর দলিলের ভিত্তিতেও তাদের ফতোয়াই সহিহ (দেখুন ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৩২২; ইমদাদুল আহকাম ১/৬৬৪)।
সার কথা হলাে, কােরআন তেলাওয়াত, বিশেষত যখন এটি নামেজে পড়া হয় তখন তা একটি খালেস ইবাদত যা একমাত্র আল্লাহতাআলার সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই। এতে কোনো দুনিয়াবি উদ্দেশ্য শামিল করা গুনাহ। নিচে এ বিষয়ে কিছু হাদিস, আছারের অনুবাদ ও ফিকহের উদ্ধৃতি পেশ করা হলাে-
• হযরত আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা. থেকে বর্ণিত, “তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কােরআন পড়াে। তবে এতে বাড়াবাড়ি করো না এবং এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। কােরআন-এর বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না।”
মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৪০; কিতাবুত তারাবিহ
• ইমরান ইবনে হোসাইন রা. থেকে বর্ণিত, “তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কােরআন পড়াে এবং আল্লাহতাআলার কাছে প্রার্থনা করাে। তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে যারা কােরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে।”
মুসনাদে আহমদ ৪/৪৩৭; জামে তিরমিযী ২/১১৯
• হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মা’কিল রা. থেকে বর্ণিত, “তিনি এক রমজান মাসে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়লেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ রাহ. তার কাছে এক জোড়া কাপড় ও পাঁচশ’ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া ও দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন যে, আমরা কােরআনের বিনিময় গ্রহণ করি না।”
মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৩৭
আরো দেখুন : ফাতাওয়া শামী ৬/৫৭; তানকীহুল ফাতাওয়া হামীদিয়া ২/১৩৭-১৩৮; আলইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার ২/৬২; শিফাউল আলীল ওয়াবাল্লুল গালীল (রাসায়েলে ইবনে ইবনে আবেদীন) ১/১৫৪-১৫৫; ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৩১৫-৩১৯ ও ৩২২; রাফেউল ইশকালাত আনহুরমাতিল ইসি-জার আলাত্তাআত, মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতি ফয়যুল্লাহ রাহ.।