এমসিসি তে বাংলাদেশের প্রথম সভায় সাকিব আল হাসান তার প্রথম বক্তব্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন টি-টোয়েন্টির অর্থের প্রভাবের কারণে শঙ্কার মুখে পরতে পারে টেস্ট ক্রিকেট। তার সে কথায় সুর মিলিয়েছিলেন সাবেক অজি কিংবদন্তি রিকি পন্টিংসহ সভার বাকি সদস্যরা। সর্বশেষ একই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন সীমিত ওভার ক্রিকেটে ইংরেজ দলপতি এউইন মরগান। অনেকে বলছে টেস্টের আবেদন ধরে রাখতে নানাবিধ চেষ্টা চালাচ্ছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। যেমন, দিবা রাত্রির টেস্টসহ আরো কিছু। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কেমন যেন ভিন্ন রকম ঠেকে। যতটা বলা হচ্ছে, আইসিসি কি সত্যই এতটা আন্তরিক ক্রিকেটের মূল ফরম্যাটের আবেদন-আকর্ষন বাড়ানোর ক্ষেত্রে?
আপনি খুব বেশি দিন না, এ বছরে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচগুলোর দিকেই লক্ষ্য করুন। ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা; প্রত্যেকটি সিরিজেই মূল আলোচনায় ছিলো পিচ। আপনি বাকি সিরিজগুলোর কথা বাদ দিন, শুধু যদি বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজ টেস্টের দুটি ম্যাচকেই আমলে নেই, দেখা যায় যে প্রথম টেস্টটি হয়েছে একদমই মরা উইকেটে। যেখানে বোলারদের প্রার্থনা ছাড়া করবার মতো কিছুই ছিলো না। আর দ্বিতীয় টেস্ট ছিলো ব্যাটম্যানদের জন্য বধ্যভূমি। যেখানে যদি কারো উপর ওপরওয়ালার ইনায়াত বর্ষিত না হয়, রান করা তার জন্য খড়ের গাদায় সূচ খোজার মতই কঠিন। মানুষ ব্যাটে বলে সমান লড়াই দেখতে চায়। টানা বোলারকে মার খেতে দেখাটা যেমন ক্লান্তিকর, একইভাবে উইকেটে টিকে থাকতেই ব্যাটম্যানের জীবন দিয়ে দেয়া দৃশ্যটা দেখাও বিরক্তিকর। এ সমস্যার বড় সহজ পথে বের করেছে আইসিসি। ম্যাচ শেষে মাঠের নামের পাশে ডিমেরিট পয়েন্ট বসিয়ে দিয়ে। ডিমেরিট পয়েন্ট বসান, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পিচের একটা নির্দিষ্ট মানদন্ড তো ঠিক করা উচিত। সেটা কি আইসিসি করেছে? কখনোই না। এটা সত্য যে, উপমহাদেশের পিচের সাথে বাইরের দেশের পিচগুলো মিলবে না। এর সাথে পরিবেশগত, ভৌগলিকসহ বহু কারণ বিদ্যমান। কিন্তু তাই বলে উপমহাদেশের দেশগুলো প্রথম দিন থেকেই বল ঘুরবে এমন পিচ বানিয়ে বাইরের দেশগুলোকে নাচিয়ে কোমরের শক্তির পরীক্ষা নেবে আর নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ঘাসের আচ্ছাদন বসিয়ে উপমহাদেশের দলগুলোকে হাসপাতালের সেবার মান সম্পর্কে ধারণা দেয়া প্রচেষ্টা চালাবে, এটা তো হতে পারে না। আর এমনটা হলে আর যাই হোক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টেস্ট দেখার আশা করা যায় না। ইদানিং তো অনেক টেস্টের ফল নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে টস জয়ের মধ্য দিয়েই। শুধু মাত্র ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ বিয়োগ করে আর যাই হোক জমজমাট টেস্ট উপহার দেয়া সম্ভব না।
আরো একটি বিষয়, যেটি নিয়ে প্রায়শঃ সাবেকরা মন্তব্য করে থাকেন, সেটি হলো ছোট দেশগুলো টেস্ট খেলার উপযোগী না। কেভিন পিটারসেন তো বলেই দিয়েছেন যে, দশ বছর পর পাঁচটি বাদে আর কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশ থাকবে না। এই যে কথিত ছোট দেশগুলো কেন টেস্টে উন্নতি করতে পারছে না; সেদিকটায় কি কখনো নজর দিয়েছে আইসিসি? এ প্রশ্নটি উঠতে বাধ্য। আপনি বাংলাদেশকেই উদাহারণ ধরুন। পুর্নাঙ্গ প্রথম শ্রেণীর অবকাঠামো গড়ে ওঠার আগেই টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায় বাংলাদেশ। তো, একটি দলের খেলোয়াড়; যারা বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচের সাথে অভ্যস্তই না তাদের সরাসরি টেস্টের ময়দানে নামিয়ে দিয়ে ফলের আশা করাটাও তো অন্যায়। বাংলাদেশ টেস্ট খেলছে প্রায় আঠারো বছর। এখনো কি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট প্রতিযোগিতার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌছেছে? সরাসরিই বলে দেয়া যায় যে, না। ঘরোয়া আসরগুলোতে ফরহাদ রেজার মতন ব্যাটসম্যানকেও আমরা ডাবল সেঞ্চুরি করতে দেখেছি। অথচ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে ব্যাটের সাথে বলের সংযোগ ঘটাতেই তিনি হিমশিম খান। এমন মানের আসর থেকে বের হয়ে আসা ক্রিকেটাররা টেস্টে নেমেই কল্পনাতীত কিছু করে ফেলবে এটা কল্পনাপ্রবণ মনের প্রবোধ ছাড়া কিছুই না। এ ব্যাপারে আইসিসি কি কখনো জিজ্ঞাসা করেছে যে, এত বছর পার হবার পরেও ঘরোয়া আসরের এমন বেহাল দশা কেন? যেখান থেকে শিখে এসে টেস্টে নিজেকে প্রমাণ করার কথা, সে জায়গায় হালতই যদি এমন হয় তাহলে টেস্টে ভালো করা কি করে সম্ভব?
এবার আসুন টি টোয়েন্টিতে। টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট্ট সংস্করনের খেলা। টেস্টে যা স্কিল লাগে তার অর্ধেক দিয়েই আপনি উৎরে যেতে পারবেন টি টোয়েন্টিতে। কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বেশি টাকার ছড়াছড়ি। এখানে আইসিসির ভূমিকাটা কোথায়? মাত্র বিশ দিন খেলেই আপনি কাড়িকাড়ি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ, আইসিসি নীরব। আপনি যদি বলেন যে, এখানে আইসিসির কি করার আছে? তাহলে পাল্টা জিজ্ঞেস করা যায় যে, বিসিসিআই এর চাপে পরে আইসিএল এ খেলা খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, তখন আইসিসি নীরব ছিলো কেন? হ্যা, এটা সত্য যে কাজটি আইসিসি নিজে করেনি, কিন্তু বাঁধাও তো দেয়নি। অর্থাৎ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নীতির সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব বেশ নগ্নভাবেই প্রকাশ করেছিলো ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই যে, এত এত টাকার মচ্ছবে অনুষ্ঠিত হওয়া টি টোয়েন্টি লিগ গুলি, এগুলোর আয়ের উৎসও কি কখনো জানতে চেয়েছে আইসিসি? টি টোয়েন্টি প্রতিযোগিতার নামে মানি লন্ডারিং এর অভিযোগও বেশ পুরোনো। সেটির ব্যাপারেও কি কখনো বড় ধরণের তদন্ত হয়েছে? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে আইসিসি কতটা জিম্মি তা বোঝা যায় যখন আইপিএল চলাকালীন সময়টাতে আন্তর্জাতিক কোনো সিরিজ আয়োজন না করার সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। একটি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের আসরের সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেন বন্ধ থাকবে, সে প্রশ্ন করাই বাতুলতা। কারণ, যে জবাবটা আইসিসির কর্তারা দিবে সেটা শুধুই প্রহসনের জন্ম দিবে।
এখন, এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে সব দায়ই কি আইসিসির? অবশ্যই না। কিন্তু ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করার কথা, সেটাও যখন আইসিসি করতে ব্যর্থ হয়, তখন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। প্রসঙ্গক্রমে একটু ফুটবলের দিকে নজর দেই। তাও মূল অভিভাবক সংস্থা ফিফা না, আঞ্চলিক সংস্থা ইউয়েফার দিকে। চলতি মৌসুমেই চড়া মূল্যে পিএসজি যখন নেইমারকে বার্সা থেকে প্যারিসে নিয়ে আসলো, তখনই নড়চড়ে বসেছে ইউয়েফা। পেট্রো ডলারের জোড়ে বাকি ক্লাবগুলোও যখন যথেচ্ছা খরচ শুরু করলো তখন ইউয়েফা কর্তারা এ খরচে লাগাম পরাবার জন্য একত্রিত হয়ে একটি খসড়া দাড় করালেন। যাতে অনেকগুলো ধারার মধ্যে একটি হচ্ছে আয় এবং ব্যায়ের মধ্যে একশ মিলিওন এর বেশি ফারাক থাকতে পারবে না। অর্থাৎ আপনি তিনশ মিলিওন দিয়ে যদি কাউকে কেনেন তাহলে কমপক্ষে দুইশ মিলিওন মূল্যের খেলোয়াড় আপনাকে বিক্রি করতে হবে। এটা তো ইউয়েফার নজির। সম্প্রতি এএফসি বাফুফেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে শুধু মাত্র ঢাকাতেই লিগ চালিয়ে সেটিকে পেশাদার দাবী করাটা তারা মানবে না। কমপক্ষে ছয়টি আলাদা ভেন্যুতে খেলা হতে হবে। ফুটবলের আঞ্চলিক সংস্থাগুলোই যখন মানের ব্যাপারে, এবং দলগুলোর ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে এতটা সচেতন সেখানে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থার টি টিয়োন্টি লিগ গুলোতে লাগামহীন টাকার ছড়াছড়ি বন্ধে কিছুই করণীয় নেই, এটা বিশ্বাসযোগ্য না।
বাস্তবতা হচ্ছে সত্যিকারের ক্রিকেট ভক্তদের কাছে টেস্ট এখনো মূল আবেদনের নাম। লারার চার’শ, আশরাফুলের অভিষেকেই সেঞ্চুরি, ওয়ার্নের শতাব্দি শ্রেষ্ঠ ডেলিভারি, সবই কিন্তু টেস্টেরই উপহার। আপনি এমন মনে রাখার মতন কয়টা কীর্তির কথা উল্লেখ করতে পারবেন টি-টোয়েন্টিতে? আমরা টি টোয়েন্টি বিরোধী না। ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাওয়ায় এটি অস্বীকার করার জো ও নেই। কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট বোর্ডের আয় বাড়াতে গিয়ে মূল খেলা টেস্টকে বিসর্জন দেয়া চিন্তা আখেরে কোনো লাভ তো বয়ে আনবেই, বরং একসময় খেলাটাকেই বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে। স্কিল, টেম্পার সহ মৌলিক সব পরীক্ষায় পাশ করলেই টেস্টে আপনি সফল হতে পারবেন। আর যার টেস্ট খেলার স্কিল আছে, সে বাকি সব ফরম্যাটে বিশাল কিছু করে ফেলতে না পারলেও অন্তত খেলতে পারবে। কিন্তু শুধুই টি টোয়েন্টি দিয়ে কখনো খেলোয়াড় বের হয়নি, হবেও না।
টেস্টের ভবিষ্যত শঙ্কার মুখে, সাকিব-মরগানের সাথে এ বিষয় দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। বরং, যেটি বলতে বাধ্য হচ্ছি তা হলো, এ শঙ্কার জনমদাতা টি-টোয়েন্টি না, খোদ আইসিসি নিজে। একটি নির্দিষ্ট বোর্ডের ইচ্ছা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে খেলাটার কতবড় ক্ষতি আইসিসি করছে, তা যত দ্রুত তারা অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল। নতুবা, খুব বেশি দিন নেই, যেখন এটা শুনতে হবে যে ক্রিকেটের ভবিষ্যতই শঙ্কার মুখে। একটা ছোট্ট তথ্য দেই, সদ্য সমাপ্ত অ্যাশেজ সিরিজটি দেখেছেন সাড়ে আট লাখেরও বেশী মানুষ। যা ১৯৩৬-৩৭ মৌসুমের পর সর্বোচ্চ। সুতারাং, মানুষ টেস্ট দেখতে আগ্রহী না কথা; কথাটি নির্ভেজাল অসত্য। এখন, এ তথ্যটিকে গুরুত্ব দিয়ে আইসিসি টেস্টের প্রতি মনোযোগী হবে নাকি বিসিসিআই এর মুনাফা আগে নীতির কাছে জিম্মি হয়ে টেস্ট এখন চালসে বলে টি টোয়েন্টি নিয়েই মেতে থাকবে, সিদ্ধান্তটি তাদেরই। কারণ, ইতিহাসই বলে অধিক মুনাফার লোভ আখেরে ক্ষতিই বৈ কিছুই করেনি।
বর্তমান বাস্তবতায় , টি-টোয়েন্টির আবেদনে আকর্ষণ হারাচ্ছে টেস্ট, এ অদ্ভুৎ যুক্তি থেকে সরে এসে টেস্টে পিছিয়ে থাকা দলগুলোর মানোন্নয়ে যদি আইসিসি মনোযোগী হয় আখেড়ে লাভ ক্রিকেটরই। কিন্তু তা না করে যদি শুধুই টি টোয়েন্টিকে প্রাধাণ্য দিতে গিয়ে ক্রিকেটটাই শেষ করে দেয়া হয় তখন কিন্তু কপাল চাপড়াবেন এই আইসিসির কর্তারাই, যারা সার্বিক উন্নয়নের বদলে শুধুই একটি নির্দিষ্ট বোর্ডের তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছে। এখনো সময় আছে, আইসিসিকে সার্বজনীন রুপ দেয়ার। সেটি করতে না পারলে টেস্ট না ক্রিকেটটাই বরং বিরাট সংকটে পড়ে যেতে পারে।