অদ্ভুৎ সব মন্তব্যের জন্য জগৎখ্যাত সাবেক এক ইংলিশ তারকা থেকে শুরু করে নিজের ঘর বার্নাব্যু-র একাংশের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। মাঠে থাকুন বা মাঠের বাইরে, তার বদন নজরে আসা মাত্রই শুরু হয়ে যেত দুয়োধ্বনি। নিয়মিত ঢাল হিসেবে দাঁড়ানোয় জিদান-কে শুনতে হয়েছে স্বদেশির প্রতি অন্ধ প্রেমের অপবাদ। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনায় পা দুটোও কেমন যেন বিরূপ আচরণ করা শুরু করলো। ফাঁকা পোস্টে নেয়া শুটও ব্যঙ্গ করে আশ্রয় নিল দর্শকের হাতে। কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। ঠিক তখনই এগিয়ে এলেন রিয়াল-এর অঘোষিত রাজা রোনালদো। বেনজেমার সঙ্গে রোনালদোর রাবতা বহু পুরনো। একত্রে খেলেছেন সবচেয়ে বেশি ম্যাচ। তাই নিজে গোল উদযাপনের বদলে বার্নাব্যুবাসীকে আহ্বান জানালেন দুয়ো নয়, বরং বেঞ্জু-কে সমর্থন জানাতে। না, এতেও খুব একটা কাজ হলো না।
আলাভেস-এর বিপক্ষে ম্যাচের শুরুতে সহজ কিছু সুযোগ হাতছাড়া করে নিজেই যেন নিজেকে শঁপে দিচ্ছিলেন সমালোচকদের শানিত জিহ্বার নিচে। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তেই বদলে গেল দৃশ্যপট। ডি-বক্সের জটলায় অসাধারণ এক ব্যাকহিল-এ রোনালদো-কে দিয়ে করালেন দলের প্রথম গোল। গোলের আনন্দ উদযাপনের চেয়ে রোনালদোকে বেশি আগ্রহী দেখা গেল বেনজেমা-র প্রতি দর্শকের আচরণ বদলানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হতে। বেঞ্জু জাদু এখানেই শেষ হলো না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বেল-কে দিয়ে করানো গোল, শেষটা পেনাল্টি থেকে নিজের করা গোলের মধ্য দিয়ে। ম্যাচ রেটিং প্রায় ১০ ছুঁই ছুঁই। এই বেনজেমাকে যেন নতুন করে চিনলো সবাই। তলানিতে ঠেকা আত্মবিশ্বাসও যেন মুহূর্তেই বদলে গেল।
লিঁও থেকে রিয়াল-এ এসেছিলেন নিরেট স্ট্রাইকার হিসেবে। কালক্রমে পরিণত হয়েছেন শ্যাডো স্ট্রাইকারে। তার ভূমিকা এখন আর গোল করা নয়, বরং করানো। ট্যাক্টিসে অভিজ্ঞদের কাছে বেনজেমার এই বদল ঠেকেছে নিঃস্বার্থ চরিত্রের চমৎকার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। কিন্তু সমালোচকরা তা মানতে নারাজ। গায়ে যেহেতু ৯ নম্বর জার্সি সেহেতু গোল করাই যেন তার মুখ্য কাজ। কিন্তু রিয়ালের কৌশল নির্ধারক থেকে শুরু করে খেলোয়াড়রা সবাই জানেন বেনজেমার অবদান ও অবস্থান সম্পর্কে। তাই রোনালদো নিজের ৫০তম হ্যাট্রিকের সুযোগ উপেক্ষা করে বেনজেমাকে সুযোগ করে দিলেন পেনাল্টি থেকে গোল করে সমালোচকদের জবাব দেয়ার। আবেগের আতিশয্যে ভাস্কুয়েজ তো বেনজেমাকে বলে বসলেন ফেনামেননই। বেনজেমা ফেনামেনন নন নিশ্চিত। কিন্তু ফেলনাও নন। কালদেরনের কালো যুগের পর রিয়ালের এই সুসময়ে বেনজেমার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দেপোর্তিভোর সঙ্গে রিয়ালের জয়ের পর গণমাধ্যম ‘মার্কা’র মুখোমুখি হয়েছিলেন বেনজেমার এজেন্ট করিম জাজিরি। ইনজুরি থেকে ফিরে মাত্র ২৬ মিনিট মাঠে থাকা অবস্থাতেও শুনেছেন দর্শকের দুয়ো। এটিসহ রিয়ালের প্রতি বেনজেমার ভালোবাসা, সমর্থকদের এমন আচরণ এবং আরো বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
• আপনি কত বছর ধরে বেনজেমাকে চেনেন?
বেনজেমার বয়স যখন ১৫ বছর তখন থেকেই। যখন তিনি সবে পেশাদার হিসাবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছে তখন থেকেই।
• তিনি কেমন বোধ করছিলেন রবিবারের (দেপোর্তিভোর বিপক্ষে) ম্যাচটির পর?
এটি একটি কঠিন সময়। কিন্তু কৈশোর থেকেই তিনি মানসিকভাবে শক্ত এবং রিয়ালে পুরোটা সময় শক্তই ছিলেন। ৯ বছর ধরে তার স্বপ্নের ক্লাবে খেলছেন। এটা অবশ্যই অসম্মানজনক যখন রিয়াল ম্যাচটি জিতছে এবং তিনি মাত্রই ইনজুরি থেকে ফিরেছেন তখন তাকে উদ্দেশ করে দুয়ো দেয়াটা। করিম অনুকরণীয় নিবেদন দেখিয়েছে নদলের প্রতি এবং সব সময় নিজের চেয়ে দলকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই এমন কিছু কোনোভাবেই তার প্রাপ্য নয়।
• তিনি কি আহত বোধ করেছেন?
কেন করবেন না বলুন? তিনি এটা বুঝতেই পারেন না। এটি ক্লাবের ইতিহাসের সপ্তম সর্বোচ্চ গোলদাতার প্রতি চরম অসম্মান। বিশ্বের সেরা ক্লাবটির এমন একটি সময়ের তিনি সদস্য যখন ক্লাবটি অসাধারণ সময় পার করছে। আপনি চাইলে যে কাউকেই দুয়ো দিতে পারেন। কিন্তু এমন কাউকে না যিনি ওই সময় মাঠেই নেই। এটা অগ্রহণযোগ্য।
• আপনি কি মনে করেন, বার্নাব্যুর সমর্থকরা আরো একটি পরিবর্তন চাইছেন এবং ওই আচরণ এরই বহিঃপ্রকাশ?
ঠিক জানি না। যেটি বলতে পারি তা হলো, মাদ্রিদ তখন জিতছিল এবং করিম মাঠেই ছিলেন না। যদি তিনি কোনো ভুল করতেন এবং এ জন্য তাকে দুয়ো দেয়া হতো তাহলে সেটি নিজেই বুঝতেন। কিন্তু এটা কোনো ফুটবলারের জন্য মানা কঠিন যিনি এখানে ৯ বছর ধরে রয়েছেন এবং নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন।
• করিম কি ক্লাববদলের কথা ভাবছেন? যদি পরিস্থিতি না বদলায়?
না। কারণ করিম বিশ্বাস করেন, সত্যিকারের সমর্থকরা তার পাশে রয়েছেন। এটা প্রমাণ করতে চান, সবার সমর্থন পাওয়ার যোগ্য তিনি।
• ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো মিস করলেও দর্শকের সমর্থন পান। বেলও সবার সমর্থন পান ক্রমাগত ইনজুরি সত্ত্বেও। আপনার কি মনে হয়, করিমের জন্য বিষয়টি অন্য রকম হয়ে গেল কেন?
ঠিক জানি না আসলে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, রিয়ালের সত্যিকারের সমর্থক, ক্লাব, ও সতীর্থরা তার পাশেই আছে। তিনি মাদ্রিদ-এ সব সময় ভালোবাসাই পেয়ে এসেছেন। শেষ কিছুদিনের ঘটনাগুলো আসলে বোঝা খুব মুশকিল।
পরিস্থিতি আসলেই বদলে গেছে। সমালোচনায় মুখর মুখগুলোয় এখন বেনজেমার স্তুতি। অথচ একজন ছিলেন যিনি কখনোই বেনজেমার সামর্থ্য নিয়ে দ্বিধায় ভোগেননি। তিনি হলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বেনজেমার নিঃস্বার্থ খেলা বহুবার সাহায্য করেছে রোনালদোকে গোল পেতে। প্রিয় বন্ধুর ওই অবদানের জবাবটাও রোনালদো দিলেন দারুণভাবেই।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে, বেনজেমা বিশ্বের অন্য স্ট্রাইকারদের মতাে ক্ষুরধার নন। হওয়ার প্রয়োজনও আছে কি? রিয়ালের খেলা যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় সেই রোনালদো সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেনজেমার সঙ্গেই। আর স্বস্তিতে খেলা রোনালদোর রাফতারের সামনে প্রতিপক্ষ যে অসহায় তা নিয়ে নতুন করে কিছু যোগ করার বোধহয় কোনো দরকার নেই। এখানে যে বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা আছে সেটি হলো বেনজেমার আসল পজিশন কী? তিনি এই মুহূর্তে শ্যাডো স্ট্রাইকারের ভূমিকায় খেলছেন। তার মূল কাজ গোল করা নয়, করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। ছোট্ট একটা জিনিস মনে করিয়ে দিই। লা লিগা-য় সবচেয়ে ভালো গোল রেশিও রোনালদোর। আর ওই গোলে প্রতক্ষ্যভাবে সবচেয়ে বেশি সহায়তা এই অচল আধুলি বেনজেমারই। এখন সমালোচনা করার আগে যেটি ভাবার বিষয় তা হলো, বেনজেমার বদলি কোনো স্ট্রাইকার হয়তো আনলো রিয়াল। কিন্তু তিনি এমন নিঃস্বার্থভাবে রোনালদোকে বল জোগান দেবনে, নাকি তার কাছাকাছি স্কোরিং রেশিও নিতে পারবেন? একটু খেয়াল করলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। আলাভেসের বিপক্ষে লা লিগায় ৩০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন রোনালদো। এটি করতে তার লেগেছে মেসি-র চেয়ে ৪১ ম্যাচ কম। মেসিই যেখানে গোল রেশিওতে রোনালদোর পেছনে সেখানে ঠিক কে তার অভাব পূরণ করবে- এ প্রশ্নটা থেকেই যায়।
বেনজেমার পাশে দাঁড়ানো দু’জনের একজন ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়, অন্যজন পাঁচবার ব্যালন ও দু’বার বেস্টজয়ী। এমন দু’জন যখন অন্ধের মতাে আস্থা রাখছেন তখন এটা বলাই যায়, বেনজেমায় নিশ্চয় কিছু আছে। হ্যাঁ, তিনি পারফেক্ট নন। কিন্তু তিনি কি ফেলনা? এর জবাব তো আলাভেসের বিপক্ষে মাঠেই দিয়ে দিলেন। আর যিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত রিয়াল আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে না দেবে ততদিন বার্নাব্যু ছাড়ছি না তার প্রতি এমন আচরণ একটি বাজে উদাহারণ হিসেবেই গণ্য হবে ইতিহাসে। বেতন, চুক্তি, বেঞ্চে বসানো- কোনো বিষয়েই যার কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই; বরং রিয়ালের জার্সিটা গায়েই স্বর্গের সুখ খুঁজে পান, ঠোঁটে ফোটে ঐশ্বরিক তাবাসসুম, সামান্য ইহতিরাম তো তার এমনিতেই প্রাপ্য।