পূর্ব ঘৌতা যেন সাক্ষাৎ জাহান্নাম

হালিম সেবায়া-র বিশ্লেষণ

পূর্ব ঘৌতা যেন সাক্ষাৎ জাহান্নাম

সম্মানিত সুধী, পূর্ব ঘৌতা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। শান্ত থাকুন। বলা হচ্ছে, এসবই নাকি আমাদের ‘গণমনোব্যাধি’।

‘সত্য-পরবর্তী’ যুগে আপনাকে স্বাগতম যেখানে এখন বিতর্ক চলছে। আমাদের কি রেড ক্রস-এর অফিস ঘেরাও করে ওই হামলা রুখতে এবং আহতদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ? নাকি না। অবশ্য রেড ক্রস ওই ধরনের আগ্রাসী হামলাটিকে ‘পাগলামি’ দাবি করলেও নানান জায়গা থেকে আমাদের বলা হচ্ছে, এসব নাকি ‘অপপ্রচার’, ‘সাজানো ঘটনা’, এমনকি ‘সবার ভুল’।

শুরু করার আগে একটি কথা বলা খুব জরুরি যে, যেনতেনভাবে সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলা করাটা মানা যায় না। রেড ক্রস এও জানায়, ‘দামেস্ক-এর সবার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর শঙ্কা কাজ করছে যে, কখন তার সন্তানদের ওপর ওই বোমা আছড়ে পড়ে।’ তাহলে ঘৌতা বিশেষ করে আলাপে আসছে কেন? কারণ হচ্ছে, সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হলো, ৫৫০ জনের মতাে নিহত ও আহত ২ হাজার ৫০০ জনের মতাে।

যেন সাক্ষাৎ জাহান্নাম অথবা ইঁদুর বনাম উকুনের লড়াই

একটি আরবি প্রবাদ আছে, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু যখন উত্তর ঘৌতা-র বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়ে ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে ওই হামলাকে ‘বর্ণনাতীত’ দাবি করে তখন এই নীরবতাকে কেউ সম্মতি ধরলে বলার কিছু থাকে না।

ওই বিবৃতির মূল বক্তব্য ধরতে কারো বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। সিরিয়া-র ওই বহুবিধ হামলার ব্যাখ্যা করতে সব শব্দই যেন ব্যবহার হয়ে গেছে।

সিরিয়ার এক লেখকের মতাে অনেকেই মনে করেন, সিরিয়ার ওই অবস্থা একটি ‘দে জ্যা ভু’ (যে ঘটনা দেখলে মনে হয়, আগেও ঘটেছে) এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে পুতিনের অধীন সিরিয়ায় বাশার-এর ‘জয়’ আসলে কেমন। আবার সিরিয়া-কে কেউ কেউ বলছেন, ‘দুনিয়ার জাহান্নাম’ অথবা ‘সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন’। ফলে কী শব্দ ব্যবহার করা যায় সেটি সমস্যা নয়। সমস্যা হলাে, কোনাে শব্দ যে আসল পরিস্থিতি ব্যাখা করতে পারছে না, সেটিই মূল সংকট। ইউনিসেফ-এর ওই বক্তব্যের একটি ফুটনোট আছে, ‘এসব অত্যাচারের পক্ষে সাফাই বক্তব্য দেয়ার কোনাে শব্দ আদৌ আছে কি না জানা নেই।’

হ্যাঁ, দৃশ্যত কারো কারো কাছে আছে। যেমন- সিরিয়ার সংসদ সদস্য নাবিল সালেহ ওই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘ইঁদুর বনাম উকুনের লড়াই’ হিসেবে। সেখানে শাসক ইঁদুরের অবস্থাতেই আছেন।

কেউ কেউ বলতে পারেন, সেটি ওই নারী সদস্য লড়াই অর্থে বুঝিয়েছেন। কিন্তু সালেহ মনে করেন, ঘৌতাবাসীর নির্বংশ হওয়া উচিৎ। কারণ তারা মিথ্যুকের মতাে ফিলিস্তিন-এর ছবিকে সিরিয়ার ছবি হিসেবে ব্যবহার করছে।

শব্দ খেলার মধ্য দিয়ে কোনাে আবেগের ফুলঝুরি ছড়াতে চাই না। বলতে চাচ্ছি, এসব শব্দ এখন এই যুদ্ধ সময়ে বেশ ‘গ্রহণীয়’ ও ‘ন্যায্য’।

জনসাধারণের ওপর হামলা করায় ঝামেলার কিছু নেই

যাহোক, ওই ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে সিরিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থা দিনকে দিন ঘোলাটে হচ্ছে এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কিন্তু একটি কথায় কোনো জটিলতা থাকা উচিত না যেখানে সাধারণ নাগরিকদের হামলার ক্ষেত্র বানানো হয়েছে। আরো টার্গেট করা হয় হাসপাতাল, এমনকি সহায়তাকারী সংস্থার লোকজনের ওপরও।

এটি সত্য, ওইসব যুদ্ধে সব সময়ই ব্যাপক জীবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। আসাদ-এর পক্ষ হয়ে নিরাপত্তা পরিষদকে জাতিসংঘের দূত জানান, ‘আসাদ আত্মরক্ষার জন্য সিরিয়ার বর্ডার-এ সামরিক অবস্থান নিয়েছেন।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী ওই ধরনের যুদ্ধের ঘটনা আসলে নাকি ‘সামরিক প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে’ ঘটে। কিন্তু যে তর্কটি আসেনি সেটি হলাে, এসব হামলার ক্ষেত্রে অন্তত মানবিক কারণগুলো নজরে আনা উচিত। আন্তর্জাতিক আদালত তার পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠকে দাবি করেছেন, ‘মানবাধিকার আইন’ আসলে দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সাধারণ নাগরিককে জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে।

এটি একটি ইস্যু যেখানে ওইসব সংঘর্ষে সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে কোনাে তফাত করা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এসব ক্ষেত্রে খাটে, এমনকি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- নাগরিকদের যথাযথ নিরাপত্তা (জেনেভা কনভেনশন ১৯৭৭ সালের ১৩ অনুচ্ছেদ), খাদ্যের নিরাপত্তা (১৪ অনুচ্ছেদ) এবং আহত ও সেবা প্রদানকারী ব্যক্তিদের নিরাপত্তা (৭-১১ অনুচ্ছেদ)।

এই যে, ‘ইঁদুর ও উকুনের লড়াই’সহ নানান উপমা এসব অমানবিক বিপর্যয়ে বিভিন্নভাবে বহু ব্যক্তি ব্যবহার করেছেন। এসব শুনতে হচ্ছে যেখানে মানবতা দখল হয়ে গেছে। এসব হত্যাকাণ্ড ধর্মীয় ও জাতিগত যুক্তি দেখিয়ে জায়েজ করা হচ্ছে।

আসলে ঘটে যাওয়া ওইসব যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো খুব সহজেই অস্বীকার করা যায়।

যা খুব হতাশাজনক হলেও অবাককর নয়তো হলো, এসবের বিপরীতে কোনাে শক্তিশালী আওয়াজ আমরা শুনতে পাইনি এবং ঘৌতা-র মানুষের পাশেও কেউ দাঁড়াননি। যারা দাঁড়িয়েছেন তারা হয় বাশারের পক্ষে, নয়তাে ওই এলাকার অবৈধ দখলদারদের পক্ষে।

সিরিয়ার শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে একটি দাবি প্রায় তোলা হয়, তারা নাকি হামলার আগে আকাশ থেকে ওই এলাকা ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার জন্য লিফলেট ছােড়ে। এভাবে জানানোটা কোনাে ভালাে উপায় কি না এ আলাপে না গিয়েও এতটুকু পরিষ্কার, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী জানে কোথায় কোথায় সাধারণ মানুষের বসবাস রয়েছে। ফলে ওইসব অঞ্চলে হামলা পরিচালনায় দায় তারা এড়াতে পারে না, পারা ন্যায়সঙ্গতও নয়।

ওই ধরনের লিফলেট আমাকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, উত্তর আলেপ্পো-য় এ রকম লিফলেট ছাড়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। তা প্রচার করেছিল সিরিয়া ও রাশিয়ার বাহিনী। লেখা ছিল, ‘এটিই শেষ ভরসা, নিজেকে বাঁচান। এই এলাকা ছেড়ে যদি দূরে কোথাও অবস্থান না নেন তাহলে সবাই মারা পড়বেন। আপনাদের নিয়ে কারো কোনাে আশা নেই। ফলে আপনাদের সহায়তার কেউ নেই।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর পর্যবেক্ষণ মতে, ঘৌতার ক্ষেত্রে ওই ব্যাপারটি কাজ করেছে। তাদের মতে, ‘হামলার আগে নাগরিকদের এলাকা ত্যাগ করার কথা বললেই সব জায়েজ হয়ে যায় না। পূর্ব সতর্ক বার্তা দিয়ে অথবা না দিয়ে কেবল সামরিক অঞ্চলে হামলা করা যায়। তবে তা অবশ্যই যৌক্তিক পরিমাণে।’

দুইয়ে দুইয়ে কি পাঁচ হয়?

ওই হামলা ঘিরে মিডিয়ার সংবাদকে প্রপাগান্ডা বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেঞ্জা। তিনি বলেন, এসব কি ‘মিথ্যা প্রচারণা’, ‘বিকৃত তথ্য’ ও বিশ্ব দর্শকের ‘গণমনোব্যাধি’ হয়েছে।

রাশিয়ার মতে, ঘৌতা নিয়ে মিডিয়ার ব্যাপক কাভারেজ আসলে সিরিয়া ও রাশিয়ার সুনাম নষ্ট করছে।

বলছি না, মিডিয়া তার রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাপারে নেতিবাচক খবর ছড়ায় না। কিন্তু যখন বলা হচ্ছে, ‘মনোব্যাধি’ তখন সেটি আসলে আলোচিত ‘সত্য-পরবর্তী’ জমানার যুক্তি চর্চার দিকেই তাক করছে।

এটি আমাকে জর্জ অরওয়েল-এর ‘১৯৮৪’ উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে যেখানে ছিল ‘সবশেষে দল যখন বলবে, দুয়ে দুয়ে যোগ করলে পাঁচ হয় তখন সেটি মেনে নেয়াটাই সই।’

অন্যভাবে বললে বলা যায়, আমাদের বাস্তবতার দ্বিধারী তলোয়ারের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এক হাতে আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, জাতিসংঘ, মানবাধিকারসহ নানান সংঘ, এমনকি ক্যাথলিক পোপও। তারা ওই যুদ্ধে বিরতির ডাক দিয়েছেন এবং যুদ্ধকালীন মানবাধিকার সহায়তার জন্য উন্মুক্ত করার দাবি তুলেছেন। অন্যদিকে আমাদের বলা হচ্ছে, আমাদের নাকি ‘মনোব্যাধি’ হয়েছে অথবা আমরা প্রপাগান্ডার শিকার। কারণ আমরা নাকি ওই দুই নেতৃত্ব চিনতে পারিনি।

HAMZA AL-AJWEH/AFP/Getty Images

নেবেঞ্জা-র ওই বক্তব্যের বিপজ্জনক দিক হচ্ছে, তার এই যুক্তি মানবতার দুর্দশা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। ফলে যে কোনাে খবর তার পছন্দ না হলেই তিনি বলে দেবেন, এটি ভুয়া খবর। নিরাপত্তা কাউন্সিল-এর সব সদস্যই এসব করেন, কেবল রাশিয়া নয়।

ওইসব তর্ক যদি আমরা মেনে নেই তাহলে অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়ানোর সব নৈতিক শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলবাে। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে যেখানে অনেক ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াইকারী ওই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে নীরবে সরে এসেছেন।

পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, জাতিসংঘের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি এই ভেবে না যে, তারাই কেবল ‘দুনিয়াকে রক্ষা করতে পারে’। কিন্তু ২০১১ সালের রিপোর্টের দিকে নজর রেখেই অস্বীকার করছি, এসব সংগঠনগুলো আসাদ ও পুতিন-কে শত্রুজ্ঞান করে না।

এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিতে পারি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্ট মতে, ঘৌতার ঘটনা শুধু যুদ্ধাপরাধের নমুনাই নয়। এমনকি এখানে ‘কিছু অরাষ্ট্রীয় বাহিনী, বিশেষ করে ‘আর্মি অফ ইসলাম’ও এসব অপহরণ, হামলা এবং ওইসব চুপচাপ গিলে খাওয়ার সঙ্গে জড়িত। তাদের মর্টার্স ও গ্র্যাড রকেট ব্যবহারও ‘যুদ্ধাপরাধের শামিল’। অরওয়েল-এর ওই ‘১৯৮৪’ বই থেকে আরেকটি লাইন- ‘বিতর্কের বিপরীতে বিতর্ক তো এক ধরনের কমন সেন্স’।

প্রশ্ন থেকেই যায়, আমাদের ওই লাখ লাখ মানুষের মানবিক বিপর্যয় ঘিরে এসব বিরোধের কোথাও ওই ‘কমন সেন্স’-এর লক্ষণ আছে, নাকি আমরা দুইয়ে দুইয়ে পাঁচের যুগে আসলেই ‘গণমনোব্যাধি’তে আক্রান্ত?

বৈরুতভিত্তিক রাজনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক হালিম সেবায়া-র এ লেখাটি আলজাজিরা-র মতামত বিভাগে ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়