গত জানুয়ারিতে চীনে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছিল যেখানে জম্মু-কাশ্মীরকে চীনের নিজের অংশ হিসেবেই দাবি করা হয়। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে অচিরেই মাঠে যে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী যোগ হচ্ছে ব্যাপারটি তখনই আঁচ করা যাচ্ছিল।অেবশ্য কাশ্মীর নিয়ে চীনের আগ্রহের কখনোই কমতি ছিল না। এর আগে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের বিবাদমান ব্যাপারগুলো নিয়ে মধ্যস্থতা করারও প্রস্তাব দিয়েছিল চীন। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী চীন তার প্রতিবেশী ভারতীয় সীমান্তে তাদের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ)-র একটি শাখা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর আদলে শক্তিশালী ‘ইন্টিগ্রেটেড ইনডিভিজুয়াল সোলজার কমব্যাট সিস্টেম’ দিয়ে সজ্জিত করেছে। এর মূল লক্ষ্য ইউনিটটিকে ভবিষ্যতের ‘ইনফরমাটাইজড ওয়ারফেয়ার’, মানে যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আরো যুদ্ধক্ষম করে তোলা।
শুধু তা-ই নয়, ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, তুরস্ক-এর প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ জম্মু-কাশ্মীরের রাওয়ালকোট সেক্টরে নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) পরিদর্শন করেছে। এসব ঘটনা যে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই ঘটনার পর কাশ্মীর নিয়ে ভারত, পাকিস্তান- উভয়েরই নতুন করে ভাবতে হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন এখন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত। কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিতে চীনের বিস্তর প্রভাব চোখে পড়লেও কাশ্মীর বিতর্কে চীন সব সময় একটা ভারসাম্যের নীতি নিয়েই হাঁটছে। কিন্তু কিছুদিন ধরে কাশ্মীর নিয়ে চীনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতাে ভিন্ন। তা ভারতীয় রাজনৈতিক মহলেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে রাজ্যসরকারের মুখপাত্র ও পূর্তমন্ত্রী নইম আখতার কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কাশ্মীর-এ আগের মতো পরিস্থিতি আর নেই। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে। এখন এ বিষয়টি শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর মধ্যে বড় শক্তির হস্তক্ষেপ আছে।’ তার ওই বড় শক্তি যে চীন সেটি মোটামুটি পরিষ্কার।
ওই অবস্থায় স্বভাবতই কাশ্মীরে চীনের নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে আলোচনা শোনা যাচ্ছে। সার্বিকভাবে নজর রাখলে দেখা যাবে, কাশ্মীরে চীনের ক্রমাগত আগ্রহ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সেটি তার আঞ্চলিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পরিকল্পনার একটি অংশ। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সব বিষয় ভারতকেন্দ্রিক হওয়ায় এসব অঞ্চলে চীনের ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখা দিন দিন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। ভারত ওই অঞ্চলে উদীয়মান বৃহৎ শক্তি হওয়ার কারণে কাশ্মীরসহ এই অঞ্চলের বেশির ভাগ নীতিগুলো ভারতের স্বার্থে নির্ধারিত হয়ে থাকে। তাই এ ধরনের একমুখী অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাশ্মীর নিয়ে চীন ওই নতুন নীতি গ্রহণ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ওই অঞ্চল নিয়ে চীনের আগ্রহ বুঝতে হলে অবশ্যই চীনের উদীয়মান অর্থনৈতিক প্রসারের ওপরও চোখ রাখা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের দিক থেকেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি চীন ব্যাপক মাত্রায় আগ্রহী। চীন কখনোই চায় না ওই অঞ্চলে তার অর্থনৈতিক অগ্রসরতার চালিকাশক্তি অন্য কারো হাতে থাকুক। একই অঞ্চলের দেশ হিসেবে চীন সব সময় কাশ্মীরসহ দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব ধরে রাখার ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক নজর রাখে। এসব অবস্থা বিবেচনায় চীন এ অঞ্চলে তার কৌশলগত অবস্থান সক্রিয় ও পুনর্নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। সম্প্রতি কাশ্মীর ইস্যুতে চীনের সরব হওয়ার পেছনে এটিও অন্যতম কারণ হতে পারে। আরেকটি কারণ হচ্ছে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের উদ্যোগ। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ক্ষমতা গ্রহণের পর তার রাষ্ট্রীয় সফরের প্রথম দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছিলেন। ওই সফরে তিনি দু’দেশের সঙ্গেই চীন এ অঞ্চলে নতুন অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের নিজেদের আশার কথা জানান। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে চীন ঘেঁষা হওয়ায় ওই উদ্যোগে তারা রাজি হলেও রাজি হয়নি মোদির ভারত।
কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে যাওয়া চীন-পাকিস্তান ওই অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণে ভারতের তীব্র আপত্তিই সম্ভবত কাশ্মীর প্রশ্নে চীনকে নতুন করে দক্ষিণ এশীয় এই সমীকরণে টেনে এনেছে। আলোচিত ওই করিডোর চীনের অর্থনৈতিক প্রসারে যেমন জরুরি তেমন ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বিনা প্রশ্নে যে চীন ওই এলাকার রাজনীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখবে না এটি এখন পরষ্কার।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাশ্মীর নিয়ে চীনের আগ্রহের মূলে রয়েছে ভারতকে চাপে রাখার কৌশল। চীনের ‘ওয়ান রোড, ওয়ান বেল্ট’ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করার জন্য দিল্লিকে চাপে রাখতে চীনের জন্য কাশ্মীর বেশ ভালো একটি ট্রাম্প কার্ড। কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয় প্রশাসন সব সময়ই একটি স্পর্শকাতর অবস্থান বজায় রাখে। কাশ্মীরে ভারতীয় সামরিক তৎপরতার দিকে তাকালে সেটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তাই ভারতের সঙ্গ যে কোনো দেনা-পাওনায় যেতে হলে কাশ্মীরে হাত দেয়ার সিদ্ধান্তটি চীনের বেশ কোশলীই বলতে হবে। এছাড়া পাকিস্তান তো আগেই চীনের রাজনৈতিকবলয়ের মধ্যেই রয়েছে।
সব মিলিয়ে কাশ্মীর নিয়ে ভারত এখন নতুন ও বাড়তি চাপের মধ্যে রয়েছে। ভারত ওই ইস্যুতে চীন ও পাকিস্তানকে একই সঙ্গে বিবেচনা করছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত-এর বক্তব্যে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী দুটি ফ্রন্টে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে দুটি ফ্রন্ট নয়, এখানে দুটি ফ্রন্ট এক রেখায় হাজির হয়েছে। ভুটান থেকে নিয়ে অরুণাচল প্রদেশ, লাদাখ থেকে নিয়ে জম্মু ও শ্রীলংকা থেকে নিয়ে মালদ্বীপ পর্যন্ত একটিই ফ্রন্ট। পাকিস্তান ও চীন এখন ভিন্ন নয়।’
কাশ্মীর সমস্যার অন্য অনেক কারণের একটা হলো তার ভৌগোলিক অবস্থান। এছাড়া চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে তার অংশগ্রহণও সর্বজনবিদিত। তবে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান জরুরি এ কথা মানছেন সবাই। এটি অবশ্যই হতে হবে সেখানকার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে চীনের এ নতুন নীতিতে ওই প্রত্যাশার ওপর কী প্রভাব ফেলে সেটিই এখন দেখার বিষয়।