কাশ্মীরে হ্যাশট্যাগমিটু- যেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই নির্যাতিত

প্রিয়াংকা বরপুজারির কলাম

কাশ্মীরে হ্যাশট্যাগমিটু- যেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই নির্যাতিত

১৯৯১ সালে কাশ্মীরি উপত্যকায় ভারতীয় বাহিনী এক রাতে প্রায় দেড়শ’র বেশি নারীকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনার তিন দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো তারা ন্যায়বিচারের মুখ দেখতে পাননি। এছাড়া পুরুষরা যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল তাও এক সময় নীরবে সমাহিত হয়ে গেছে।

১৯৯১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির ওই রাত কুনান-এর গ্রামবাসী ও তাদের প্রতিবেশীদের জীবন আমূল পাল্টে দেয়। ভারতশাসিত কাশ্মীর উপত্যকার গভীরে দেড় শতাধিক নারীকে ধর্ষণ, শতাধিক পুরুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও অসংখ্য ঘরবাড়ি লুট করে ভারতীয় বাহিনী। নির্যাতিতদের প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও এলাকাবাসীর মতে, ওই রাতে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা প্রায় আড়াইশ’র বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

আর অপরাধীরা? কমপক্ষে ৩০০ ভারতীয় সেনা সদস্য। তাদের অত্র এলাকার জঙ্গিবাদ নির্মূল ও ঘরে ঘরে অবাধ তল্লাশির হুকুম দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী ওইসব ক্ষেত্রে ‘ড্রাকোনিয়ান ল’-এর অজুহাত পেশ করে এবং ওই নীতির প্রতি তারা আনুগত্য প্রকাশ করে যেটি তাদের এই ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ওই অবস্থা চলমান থাকলে এটি এক সময় যে পুরো কাশ্মীর উপত্যকাকে এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘সশস্ত্রবাহিনী ঘেরা অঞ্চল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

দি আর্মড ফোর্স স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (এএফপিএসএ) হলো কলোনিয়াল যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃক জারি করা একটি অধ্যাদেশ। এটিতে সেনাবাহিনীকে যে কোনো মু্হূর্তে কোনাে পরোয়ানা ছাড়া যে কোনো জায়গায় প্রবেশ এবং যে কাউকে যখন ইচ্ছা হত্যা করার বৈধতা দেয়। ভারত সরকার নিজেদের প্রয়োজনে ওই কালা-কানুন এখনো জারি রেখেছে। ভারত সরকার ওই অন্যায় আড়াল করে এর দায় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করে থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো সব সময় বিনা বিচারে ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

কাশ্মীর এমন একটি অঞ্চল যেটি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ দীর্ঘ দিনের। কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। এর মানে হলো নির্বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গুম হয়েছে সহস্রাধিক পুরুষ ও এরও অধিক নারী। লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে ব্যাপক।

২০১১ সালে ‘জম্মু-কাশ্মীর মানবাধিকার কমিশন’-এর একটি বিশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়, তারা প্রায় দুই হাজার অজ্ঞাতনামা কবরের সন্ধান পায়।

‘কুনান পুষ্পরা-র কথা কি তোমাদের মনে আছে?’ এ প্রশ্নটি তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে এবং একটি বইয়ের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এটি মূলত কুনান পুষ্পরার হতভাগ্য নারীদের নিয়ে রচিত যারা ন্যায়বিচার পাননি। তাদের মধ্যে অবিবাহিত প্রায় ৪০ ধর্ষিত নারী বিচারের আশায় রাস্তায় নেমে আসেন। নানান সময় বহিরাগত সৈন্যরা তাদের নির্যাতন করেছে। তাদের প্রায় সবারই এখন পর্যন্ত বিয়ের ব্যবস্থা হয়নি।

বছরের পর বছর ধরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টসহ সব প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিয়েও ওই নারীরা বিচারের মুখ দেখতে পাননি। মামলা করাটাও তাদের জন্য সহজ ছিল না। আর ফাইল হলে তা যথেষ্ট প্রমাণ না থাকার অজুহাতে আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো এক অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা আর রাজ্যসরকার-এর করা একটি মামলা এখন শুনানির অপেক্ষায়।

বর্তমান বিশ্বে বিরোধ ও সংঘর্ষপূর্ণ এলাকাগুলোয় যৌন নির্যাতন বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পুরুষ আর নারী উভয়ই এর ফলে যে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন তা বর্ণনাতীত। তবে উভয়ের ক্ষেত্রে এর সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রভাব ভিন্ন।

যেমন কোনো নারী যখন ধর্ষণের স্বীকার হন তখন তা পুরো এলাকার অপমান হিসেবে নেয়া হয়। আর যখন পুরুষ এ রকমের স্বীকার হন তখন সেটি কেবল তার ব্যক্তিগত পুরুষত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দাঁড়ায়। কাশ্মীরের অগণিত পুরুষ ওই নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন।

‘পাপা টু’ নামে একটি ভয়ঙ্কর আর্মি ক্যাম্প আছে। সেখানে অগণিত পুরুষকে উলঙ্গ করে এক সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সৈন্যরা। এছাড়া অধিকাংশ পুরুষের যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দিত এবং তাদের ওই হতে যাওয়া ‘নপুংশকতা’ নিয়ে হাসাহাসি করত।

‘জম্মু-কাশ্মীর মানবাধিকার কোয়ালিশন’-এর হয়ে ওই ধরনের নির্যাতনের ওপর গবেষণা করা সাজিয়া আজাদ জানান, ওই টর্চার ক্যাম্প থেকে অনেকেই জীবিত ফিরে আসতে পারেননি। আর যারা ওই অত্যাচারের প্রাথমিক কয়েক ঘণ্টা সহ্য করে ফিরে এসেছেন তাদের জীবন হয়ে গেছে দুর্বিষহ। নির্যাতনের দরুন অনেকেই চিরতরে তাদের পুরুষত্ব হারিয়েছেন। তাদের অপহরণ ও ছাড়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো লিপিবদ্ধ দলিল থাকে না। কেউ কেউ ওইসব বিষয়ে মুখ খুললেও অনেকেই লজ্জা-অপমান আর ভয়ের কারণে মুখ খুলতে রাজি হয় না।

যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কুনান পুষ্পরার ঘটনার পর যে পুলিশ রিপোর্ট ফাইল করা হয় সেখানে পুরুষদের ওই নির্যাতনের কোনাে ঘটনাই আসেনি। ওই রিপোর্টে মূল নির্যাতনের অনেক ঘটনাই লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যা করা আছে তা প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে বেশি ও ভয়াবহ।

এক গবেষককে তারা জানান, আর্মি তাদের যা করার সবটাই করেছে। কাঠ, পানি, তার, পোর্টেবল ডিসি ব্যাটারির সাহায্যে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় তারা আটককৃতদের যন্ত্রণার সর্বশেষ সীমায় নিয়ে যেতে সবকিছুই করেছে। অনেকেই সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন আর অনেকেই অসাড় হয়ে সেখানেই পড়ে ছিলেন। তবুও ২৪ ফেব্রুয়ারি অনেকেই সেখানে ছিলেন যাদের মধ্যে ২৪ জনকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছিল। অনেক নারী যারা ধর্ষণের স্বীকার হয়েছিলেন এবং অনেকেই অন্যত্র পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন।

কাশ্মীরের উর্দিওয়ালাদের ওই ভয়ঙ্কর রূপ থেকে মাতৃগর্ভের একটি ভ্রূণ পর্যন্ত নিস্তার পায় না। ওইসব নির্যাতনের পর অনেক পুরুষ ও তাদের পরিবারের রক্ষার্থে আর ফিরে আসতে পারেন না। কাশ্মীরের পুলিশ ওইসব ঘটনার তদন্ত ও তাদের শান্ত করার বদলে নানানভাবে হেনস্তা করে। প্রতিদিন ওই ধরনের অমানবিক নির্যাতনের ফলে আইনের কাছে বিচার চাওয়ার মানসিকতা, সাহস- উভয়ই তারা হারিয়ে ফেলেন। সেখানে তার নিজের প্রাণ নিয়েই শঙ্কায় থাকেন প্রতিনিয়ত।

নব্বইয়ের ওই সময় ২০ বছরের অনেক তরুণও ওই বর্বরতার স্বীকার হন। বর্তমানে পাথর নিক্ষেপের কারণে যাদের আটক করা হয় তাদের বয়সও অনেক কম। এমনকি আদালতে তাদের ওপর ওই ধরনের নির্যাতনের বয়ান দেয়ারও অনুমতি পান না।

আটকের পর যাদের মুক্তি দেয়া হয় তাদের রাখা হয় কঠোর পাহারায় যেন তারা কারো সঙ্গে যোগাযোগ বা বক্তব্য দিতে না পারেন।

গত আগস্ট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে নাসরুল্লাহ খান ও মানজুর আহমেদ খানকে অপহরণ করে সেনাবাহিনী। অকথ্য নির্যাতনের পর নাসরুল্লাহ খান ফিরে এলেও মানজুর এখনো নিখোঁজ।

এত কিছুর পরও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থেকে কাশ্মীরিরা এখনো পিছপা হননি, বরং সেনাবাহিনীর ওই ধরনের অমানসিক নির্যাতন তাদের আরো একত্রিত ও সংঘটিত করেছে। একজনের ওপর ওই ধরনের নির্যাতন আরো দশজনকে অস্ত্র হাতে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে নিজেদের রক্ষার্থে।

বুরহান ওয়ানির ক্ষেত্রেও ওই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তিনি ও তার ভাই বেশ অল্প বয়সে আর্মির ওই নির্যাতনের শিকার হন এবং প্রতিশোধস্পৃহা তার মধ্যে তীব্র হইয়ে উঠে। এ কারণেই তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘হিজবুল মুজাহিদিন’-এ যোগ দনি। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে যখন ভারতের সেনাবাহিনীর হাতে তিনি শহীদ হয় তখন পুরো কাশ্মীর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার শেষকৃত্যে কাশ্মীরি জনগণ রাস্তায় নেমে আসে।

একই সময় অনেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও অহিংস উপায়েও তাদের প্রতিবাদ জারি রেখেছেন যাদের ঘরে রয়েছে আহত বাবা-ভাই অথবা আপনজন রয়েছে নিখোঁজের লম্বা তালিকায়।

কাশ্মীরি নারীদের প্রতিরোধের দিন হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে ২৩ ফেব্রুয়ারি। আন্দোলনকারীদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন আর বাকি যেসব পুরুষ যারা তাদের প্রতি সেদিনের ওই অন্যায়ের জন্য এখনো প্রতিবাদ জারি রেখেছেন তাদের জন্য পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে।

বর্তমান এমন একটি সময়ে যখন হলিউড থেকে মানবাধিকার কর্মী এবং সর্বত্র সবাই যৌন নিপীড়ন নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #metoo হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছেন। হয়তাে একদিন কাশ্মীরের অত্যাচারের গুহা থেকে চিৎকার করে বলে ওঠা নিপীড়িতের ‘হ্যাশট্যাগমিটু’ও আমরা শুনতে পাবো।

মূল ইংরেজি লেখাটি টিআরটি ওয়ার্ল্ড-এর মতামত বিভাগে প্রকাশিত। এটি লিখেছেন ফ্রিলান্স সাংবাদিক প্রিয়াংকা বরপুজারি