সিরিয়ার চলমান যুদ্ধকে অনেকটা জার্মানির মাগদেবার্গ-এ ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রায় ৩০ বছরের যুদ্ধের সাথে মিলে যায়। যেন আজকের আলেপ্পোই সেদিনের মাগদেবার্গ। সাদা চোখে দেখলে, এই যুদ্ধ কিছু সাধারণ সংঘর্ষ থেকে উৎপত্তি নিলেও পুরো ইউরোপবাসীর ওপর এই যুদ্ধ অভিশাপ হিসেবে হাজির হয়। শেষমেশ শান্তির পতাকা উড়ে ওয়েস্টফালিয়ায়, যখন যুদ্ধরত সব পক্ষই একেবারে পরিশ্রান্ত, ব্যর্থ। তখনকার ৩০ বছরের সেই যুদ্ধ ছিল ক্যাথলিক বনাম প্রটেস্ট্যান্টদের লড়াই, আজকের দিনের শিয়া-সুন্নি লড়াইয়ের মতই। কিন্তু এখনকার সিরিয়াতে মনে হচ্ছে, ক্ষমতা এবং আঞ্চলিক কতৃত্ব বজায় রাখতে ধর্মের প্রভাব তুলনামূলক বেড়েছে।
সিরিয়ায় চলমান এই যুদ্ধের শুরুটা হয় আরব বসন্তের পরই, সিরিয়ার গণতন্ত্রকামীরা সে দেশের প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের একনায়কতান্ত্রিকতার অবসান চায়। কিন্তু এটি পরে একটি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। ইরান এবং তার সামরিক ফোর্স হিজবুল্লাহ আর রাশিয়ার সাথে মিলে লেবাননের শিয়া মিলিশিয়ারা সিরিয়ায় আসাদের পতন ঠেকাতে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়, যেখানে তুরস্ক এবং সৌদি আরব আসাদ-বিরোধীদের সমর্থন দেয়। যা আসলে পরে, শিয়াদের সাথে সুন্নিদের বিরোধে রুপ নিয়েছে।
একইসময়ে, এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমরা দেখলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আইএস-বিরোধী প্রচারণা শুরু হল। যখন এই আইএস এর পতন হল, উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের সাথে কুর্দিদের লড়াইও শুরু হয়ে গেল। পরে দেখা গেল, এই আইএস-বিরোধী কুর্দি যারা আবার মার্কিন মদদপুষ্ট তারা তুরস্কের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ল। ফলে এখন লড়াই খোদ দুই ন্যাটো সদস্যের মধ্যে জারি হয়ে গেল। তারপরও, কিছুদিন আগে সিরিয়ায় মার্কিন বোমা হামলায় ডজন খানেক রাশিয়ান সৈন্য নিহত হওয়ার খবরের পর, আমেরিকার সাথে রাশিয়ার মুখোমুখি লড়াইয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
ফলে নতুন নতুন সমীকরণের মধ্য দিয়ে, সিরিয়ার এই ঘটনা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। দামেস্ক কার নিয়ন্ত্রণে আছে, এখন আর সেটি লড়াইয়ের ইস্যু নয়। বরং এখানে লড়াইয়ের ইস্যু হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে কার প্রভাব শেষমেষ টিকে থাকবে। ফলে এই লড়াই কেবল রাশিয়া বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, সাথে শিয়া ইরান বনাম সুন্নী সৌদী আরব; এই সৌদি আরবের সাথে আবার মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ক বেশ উন্নতির পথে।
আবার এ যুদ্ধে থাকছে তুরস্কও। কেননা, তুরস্কের ভীতির জায়গা হচ্ছে, উত্তর সিরিয়ার কুর্দিরা যদি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে তবে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের কুর্দিরাও সেদিকে মোড় নিতে পারে। এমনকি ইরাকের উত্তরদিকের কুর্দিরাও আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলেছে, তার জন্যে সেখানে গণভোটের আয়োজন পর্যন্ত হয়েছিল।
শেষমেশ, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী সামরিক শক্তি হিসেবে; লেবানন এবং দক্ষিণ সিরিয়ায় তার নিরাপত্তার স্বার্থ আছে। যদিও বেশ কিছুদিন যাবত, সিরিয়ার যুদ্ধে ইসরায়েলকে তেমন দেখা যাচ্ছিল না। তারপরেও, হিজবুল্লাহর ওপর নানা সময় ইসরায়েল আকাশ-সীমায় হামলা চালাতে বাধ্য হয়। মূলত এর ফলে তারা উত্তর সীমানায় ইরানকে ব্যতিব্যস্ত রাখতেও কাজ করে।
মূলত এই মাসের শুরুতে একটি ইরানি ড্রোনে হামলা করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধে নিজের হাজিরাটা ভালভাবেই জানান দেয় ইসরায়েল। সিরিয়ায় যখন এভাবে ইসরায়েল বিমান হামলা চালাচ্ছিল, তখন একটি ইসরায়েলি বিমান পাল্টা হামলার শিকার হয়, যদিও সে বিমানের ইসরায়েলি পািইলট প্রাণে বেঁচে যান। যা কিনা ইসরায়েলকে এই যুদ্ধে আরো সংশ্লিষ্ট থাকতে প্রণোদনা দেয়।
এসবের পর পরিষ্কার যে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে ভ্লাদিমির পুতিনের বিশেষ সম্পর্ক এখন আর ইসরায়েলের ধর্তব্যে নেই। রাশিয়া হয়ত ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না, বা করে না। ফলে যাই হোক, ইসরায়েল এখন সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবেই আছে।
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, আরেকটি যুদ্ধ এই ফ্রন্টে শুরু হতে পারে, ইসরায়েল বনাম ইরান। এতে খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিভাবে এসব ঘটতে পারে তা বলাই বরং সহজ। আসলে বাশারের পক্ষ সমর্থনকারী রাশিয়া, ইরান এবং হিজবুল্লাহ’র জয় হলে প্রতিবেশি হিসেবে ইসরায়েল চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না।
ইরান বনাম ইসরায়েল (ইসরায়েলের আড়ালে সৌদি আরব) যুদ্ধ শুরু হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে, আঞ্চলিক প্রভাবের এই যুদ্ধ যেন নতুন একটি ফ্রন্ট। এতে ইউরোপসহ অনেকে এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শুধু শরণার্থী সংকটই এখানে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার একমাত্র কারণ থাকবে না। ইরানের পারমানবিক চুক্তিকে উড়িয়ে দেওয়ার যে ধমকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, এই যুদ্ধের ঝনঝনানি থেকে ইউরোপের মুক্তি মিলবে না। আসলে, ইউরোপের সীমান্ত থেকে এই যুদ্ধ খুব বেশি দূরে নয়।
এসব বিপদ মাথায় রেখে, ইউরোপ এসব সঙ্কট দূর থেকে দর্শক হিসেবে দেখে যেতে পারে না। তাই ইরানের পারমাণবিক চুক্তি রদ করতে ইউরোপের উদ্যোগ থাকা উচিৎ। ইসরায়েলের প্রতি ইউরোপের দায়িত্ব থেকে, ইউরোপের উচিৎ ইসরায়েলের জন্য যেকোন হুমকির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
এখন তাই ইউরোপের কূটনৈতিক প্রভাব বাড়াতে যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিৎ। এই ঘনিয়ে আসা যুদ্ধের সাথে ইউরোপের নেতৃবৃন্দের উচিৎ নিজেদের যথাযথ পদক্ষেপ হাতে নেওয়া।
জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভাইস চ্যান্সেলর জোস্কা ফিশার এর লেখাটি প্রজেক্ট সিন্ডিকেট এ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়।