আলাভেসে দ্যুতি ছড়ালো বার্নাব্যুর আকাশে। ৬৮০ দিন পর স্কোরশিটে বিবিসি ত্রয়ীর নাম। দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে রোনালদোর লা লিগায় ৩০০তম গোল। গোলবারে নাভাস-এর বিশ্বস্ত হাতের জাদুতে বহুদিন পর পাওয়া ক্লিনশিট। সুযোগ পেয়েই নিজেদের উজাড় করে দেয়া লুকাস, থিওর রোশনির মতো পারফরম্যান্স। আর কী চাইতে পারতেন এ ম্যাচ শেষে জিদান?
মাসের শুরুতেই সমালোচনায় জর্জরিত জিদান একগুঁয়ের মতো বলেছিলেন নিজের পুরনো শিষ্যদের ওপরই আস্থা রাখতে চান তিনি। সমালোচকার অবশ্য বলেছিলেন এ আস্থার ইতি ঘটবে জিদান-এর বরখাস্তের মধ্য দিয়ে। অথচ কত দ্রুতই না বদলে যায় দৃশ্যপট। মাসের শুরুতে লেভান্তের বিপক্ষে ২-২ ড্র-এর পর টানা পাঁচ ম্যাচ জিতলো রিয়াল। আর এ পাঁচ ম্যাচের প্রতিটিতে প্রতিপক্ষের জালে কমপক্ষে তিনবার করে বল জড়িয়েছেন জিদানের শিষ্যরা। সোসিয়াদাদ আর বেটিস-এর বরাতে তো জুটেছে পাঁচটি করে গোল। তবু তৃপ্তি আসছিল না। প্রতি ম্যাচেই গোল হজমের বদভ্যাস, বেল-বেনজেমার অফ ফর্ম জিদানের হাসির আড়ালে কিছুটা বিষাদের ছোঁয়া মেখে দিচ্ছিল যেন। আলাভেসের ম্যাচের পর আর আক্ষেপের সুযোগ থাকছে না। এবার প্রাণখুলে হাসতেই পারেন জিদান।
শুরুটা এতটা আশাজাগানিয়া ছিল না, বরং আবারও সহজ সুযোগ মিস করে বেনজেমা যেন নিজেই নিজেকে সমালোচকদের হাতে সঁপে দেয়ার ব্রত পালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মাঝে আলাভেসের কিছু আক্রমণও আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল ব্লাংকোস সমর্থকদের মনে। পুরো ম্যাচের দৃশ্যপটটাই বদলে গেল প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগে। রক্ষণদেয়ালটিকে বোকা বানানো বেনজেমা-র অসাধারণ ব্যাকহিলটি যখন অবিশ্বাস্য রাফতারে রোনালদো জালে জড়ালেন তখন থেকেই। নিজে গোল উদযাপনের চেয়ে বেনজেমার অবদানের স্বিকৃতি আদায়ে বেশ মনোযোগী দেখা গেল দি বেস্ট-কে। অবশ্য এর আগেই মৌসুমের অন্যতম সেরা গোলটি করার খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন বেল। মাঝমাঠ থেকে প্রতিপক্ষককে নিজের ট্যাকল দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে ক্যাসিমিরোর বাড়ানো বল ধরে বেনজেমার মাপা ক্রসে বেল যখন বাইসাইকেল কিকটি নিলেন ঠিক তখনই। ইঞ্চির জন্য বার মিস করে আফসোসের জন্ম দিলেও মুহূর্তটি ছিল মনে রাখার মতো।
প্রথমার্ধে এক গোলের লিডে বিরতিতে যাওয়া ব্লাংকোসদের ভয়াল রূপের পুরোটা প্রত্যক্ষ করে আলাভাসে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে। মিনিটের কাঁটা পুরো হওয়াঁর আগেই প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে বেনজেমা বাড়িয়ে দেন আগুয়ান বেল-কে। চাপের মুখে থাকা এ যুগলের যুগলবন্দি থেকে আসা দ্বিতীয় গোলটি যে জিদানের জন্য কতটা সুকুনের ছিল তা বয়ান না করলেও চলছে। বিবিসি যেন বহুদিন পর ফিরে পেল নিজেদের চেনা রূপ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিবিসি-কে বিবিসিএল-এ পরিণত করলেন লুকাস ভাস্কুয়েজ। সম্ভবত রিয়ালের জার্সি গায়ে এ ম্যাচে নিজের সেরা সময় কাটিয়েছেন কাস্তিয়ার ওই প্রডাক্ট। কখনো ডিফেন্স চেরা পাস, কখনো ক্রস, কখনো বা আচমকা শুট নিয়ে বিবিসি-র সঙ্গে সমানতালে টক্কর দিচ্ছিলেন ওই তরুণ। রোনালদোর দ্বিতীয় ও দলের তৃতীয় গোলের উৎসও তিনি। এটিকে রাতের অন্যতম সেরা আক্রমণ বললে অত্যুক্তি হবে না। বেলের চমৎকার ভিশনের ফল লুকাস-এর পায়ে বল। সঠিক সময়ে চিতার ক্ষিপ্রতায় গোলমুখে রোনালদো। আর ঠিক ওই সময়েই লুকাসের থ্রু। চেয়ে দেখা ছাড়া আলাভেসের রক্ষণের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।
ম্যাচের মাঝপথেই নিশ্চিত হয়ে যায় হোয়াইটসদের বড় জয়। অতৃপ্তি বলতে ছিল শুধু বেনজেমার একটি গোল। মাঝে রেফারির ভুলে অফসাইডে তার করা গোলটি বাতিল হলে আফসোসের মাত্রা আরাে বেড়ে যায়। কিন্তু বিধাতা যেন ঠিক করেছিলেন এ ম্যাচটিতে বেনজেমার কোনো আশাই অপূর্ণ রাখবেন না। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি আদায় করেন বেল। উৎসুক চোখগুলো চেয়েছিল পেনাল্টিটি কে নেন তা দেখার জন্য। ‘স্বার্থপর’ রোনালদো নিজের হ্যাটট্রিক পূরণ করবেন, নাকি বেনজেমা-কে সুযোগ দেবেন বহুদিন পর তাবাসসুম ঠোঁটে ম্যাচ শেষ করার? যে আদমি অ্যাসিস্টের জন্য দর্শককের আহ্বান জানান বেনজেমার উদ্দেশ্যে দেয়া দুয়ো বন্ধ করে তার অবদানের সম্মানে তালি বাজাতে, তিনি বেনজেমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান কী করে? তাই বেনজেমাই নিলেন পেনাল্টিটি। পূর্ণতা পেলো বার্নাব্যুর রাত।
থিওর কথা উল্লেখ না করাটাও অবিচার হয়ে যাবে। মার্সেলো-র বদলে মাঠে নামা ওই তরুণ একটি মুহূর্তের জন্যও মার্সেলোর অভাব তো বুঝতে দেননি, বরং পায়ের কাজে বুঝিয়ে দিয়েছেন- আর যাই হোক, রিয়াল-কে ভবিষ্যতে মার্সেলোর বিকল্প নিয়ে ভাবতে হবে না।
পুরো ম্যাচে সবচেয়ে চোখে লেগে থাকার মতাে বিষয় যেটি ছিল তা হলো, পুরো রিয়ালকে একটি দল হিসেবে খেলতে দেখা। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, মৌসুমের শুরুতেই পথ হারানোর ফলে বাজারে বহুবিধ কথা শোনা গেছে। মাত্র এ সপ্তাহেই বেলকে রিয়াল ছাড়া করে ছেড়েছে অনেক গণমাধ্যম। এমন গুমোট পরিবেশে এমন খেলা আলাদা করেই নজর কাড়ে। প্রত্যেকের শরীরের ভাষায় ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সব ছাপিয়ে এ ম্যাচটিকে জিদানের ম্যাচও বলা যায়। শত সমালোচনা সহ্য করে যক্ষের ধনের মতো খেলোয়াড়দের তো তিনিই আগলে রেখেছিলেন। আরেকজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি হলেন রোনালদো। ম্যাচে দুই গোল করেছেন বলেই নয়, রামোস-মার্সেলোর অনুপস্থিতে দলপতির দায়িত্ব যেভাবে সামলেছেন এবং বেনজেমার প্রতি দর্শকের বুকে যেভাবে তালিতে পরিণত করেছেন এতে এটি হলফ করেই বলা যায়, যারা বলেন রোনালদো টিমম্যান না তারা হয় ভ্রমে রয়েছেন নতুবা রোনালদো বিদ্বেষে সুখ খোঁজার ব্যাধিতে ভুগছেন।