‘ষড়যন্ত্র ছিল কিনা তা না দেখে অন্যান্য পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়েছে’

মেজর জেনারেল (অব:) আ ল ম ফজলুর রহমান এর সাক্ষাৎকার

‘ষড়যন্ত্র ছিল কিনা তা না দেখে অন্যান্য পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়েছে’

পিলখানায় সেনা হত্যাকান্ডের নয় বছর পার হল আজ। বিশেষ আদালতে সেদিনের ঘটনায় জড়িতদের বিচার প্রক্রিয়াও শেষের পর্যায়ে। সেই হত্যাকান্ডের পূর্বাপর নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন রয়ে গেছে। সেসব নিয়ে জবানের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বিডিআর এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) আ ল ম ফজলুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিনহাজ আমান—


 

মিনহাজ আমান: ২৫ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিডিআর বিদ্রোহের দিন, বিডিআর হত্যাকান্ড বা সেনা হত্যা দিবস এমন নানান নামে বলা হয়। আপনি কি হিসেবে বলবেন?

আ ল ম ফজলুর রহমান: আমি বলব সেনা হত্যা দিবস বলাটাই সঠিক হবে, কারণ নিহতদের মধ্যে সেনাদের আধিক্যই ছিল বেশি। প্রায় ৫৭ জন সেনা অফিসার নিহত হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মোট সেনা শহীদ হয়েছিলেন ৫৫ জন কিন্ত এই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৫৭ জন। তাছাড়া বিডিআর এর সদস্য যারা নিহত হয়েছে তারাও সেনার অন্তর্ভুক্ত। কারণ যুদ্ধের সময় এরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে আর্মির অধীনেই যুদ্ধ করে থাকে। আর যেহেতু এই বাহিনীকে কমান্ড করে সেনাবাহিনীর অফিসাররা। কাজেই আমি একে সেনা হত্যা দিবসই বলব।

বিচার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ঘটনার পর বিডিআরে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তার মধ্যে নামের পরিবর্তন ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই। শুধু নাম পরিবর্তন করেই কি একটা ঘটনাকে মিটমাট করে ফেলা যায়?

ফজলুর রহমান: মিটমাটের প্রশ্নটা যখন আসে তখন অবশ্যই এর সার্বিক মিটমাট হতে হবে। শুধু একটা দিক দেখলেই হবে না। আমি মনে করি না শুধু বিচার করে শাস্তি দিলেই বা নাম পরিবর্তন করেই সব মিটমাট হয়ে গেল। নাম পরিবর্তনের পেছনে একটা কারণ আমার মনে হয় রয়েছে, তখন তাদের নাম ছিল বিডিআর বা বাংলাদেশ রাইফেলস তাই তারা বিডিআর হিসেবেই বিদ্রোহ করেছিল। সরকার বা প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা হয়তো মনে করেছিলেন এই নামটা মুছে দিলে কলঙ্কটা মানুষের মনের আড়ালে চলে যেতে পারে। আবার দেখা যায় বাংলাদেশ রাইফেলস নামের মধ্যেই ‘রাইফেল’ রয়েছে যা থেকে একটা যুদ্ধের আভাস পাওয়া যায়। আসামে যেমন আছে আসাম রাইফেলস। কিন্ত যখন নাম রাইফেলস থেকে বর্ডার গার্ড হয় তখন নামটা শুনলে মনোজগতে আলাদা একটা চিত্র ভেসে ওঠে। আর মিটমাটের কথা যেটা বললেন, আমি মনে করি এই ঘটনার পরে আরো অনেক পরিবর্তন এসেছে; আইন কানুনে পরিবর্তন এসেছে, শাস্তির মাত্রায় পরিবর্তন এসেছে, এইসব ঘটনা যেন কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে না যায় সেক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে, অথরাইজেশনে পরিবর্তন এসেছে, ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং এর রুলস এ পরিবর্তন এসেছে। বিদ্রোহের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কিনা এটা না দেখে অন্যান্য দিকে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিক থেকে বললে পরিপূর্ণভাবে মিটমাট হয় নাই।

এ ঘটনায় বাংলাদেশের স্বশস্ত্রবাহিনীর কি কি ক্ষতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

ফজলুর রহমান: বিচারকদের তরফ থেকে যে অবজারভেশনগুলো এসেছিল সেখানে বলা হয়েছিল কুটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষতি হয়েছে। সামরিক ক্ষতি তো অবশ্যই হয়েছে। এতো স্বল্প সময়ে একসাথে এতো অফিসারের মৃত্যু অবশ্যই সেনাবাহিনীর জন্যে মস্ত বড় ধাক্কা। একটা অফিসারকে তিন বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে ধীরে ধীরে সেকেন্ড লেফটন্যান্ট, লেফটন্যান্ট, ক্যাপ্টেন, মেজর তারপর বানানো হয় মেজর জেনারেল। এই সময়ে উঠতেই তো বহু বছর লেগে যায়। এই সময়গুলো পুষিয়ে উঠতেই অনেক সময় লেগে যাবে আমাদের। তাছাড়া দেশের চৌকস অফিসারগুলোকে তখন সেদিকে পোস্টিং দেয়া হয়। যেমন কর্ণেল গুলজার যে কিনা র‍্যাব এর অফিসার ছিল, যাকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়, আবার কর্ণের বারী ছিল সেখানে। তারা খুবই চৌকস অফিসার ছিল। এতোগুলো চৌকস অফিসারের মৃত্যু অবশ্যই আর্মির জন্যে বড় একটা আঘাত। যদিও আর্মি ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে এবং ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই তা কাটিয়ে উঠবে।

সেনা সদস্যদের মানসিক অবস্থায় এই ঘটনার কোন প্রভাব পড়ে থাকতে পারে কি না?

ফজলুর রহমান: আপনারা দেখে থাকবেন, কোনো ব্যাংকের হয়তো একশো শাখা আছে এবং প্রতি মাসেই একজন ম্যানেজারকে সেরা ম্যানেজারের সম্মানে ভূষিত করা হয়। কিন্ত এই ব্যাপারটা আর্মির মধ্যে নাই। কারণ আর্মিতে এভাবে স্বতন্ত্র কাউকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা হয় না। এটা না করার কারণ আর্মিতে কোনো স্বতন্ত্র নেতা নেই। কখনোই সেরা কমান্ডিং অফিসার বাছাই করা হয় না। কোনো ব্যাটেলিয়ন যদি সেরা হয় তাহলে ওই ব্যাটেলিয়নের সবাই সেরা। এটা সবার কৃতিত্ব, নির্দিষ্ট কারো না। কাজেই এই ধরণের আঘাত যখনই আসে তখন শুধু একজনকে আঘাত করে না, পুরো আর্মিকেই আঘাত করে। এটা একটা দিক।

আরেকটা দিক হচ্ছে, যেকোনো প্রসাশনিক চাকরির পরীক্ষা বা বিসিএস ক্যাডারের পরীক্ষা এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরীক্ষা এক নয়। আর্মির পরীক্ষা হয় আইএসএসবিতে (ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড) অার এর মাধ্যমেই আর্মি অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হয়। এবং শুধুমাত্র এদেরই বলা হয় দেশের অ্যাপয়েন্টেড লিডার। কিন্ত এই পরীক্ষা অন্যান্য পরীক্ষার মতো হয় না। পরীক্ষায় তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি বিচার করা হয়। যেমন লিডারশিপ, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ইন্টেলেকচুয়াল এবেলিটি ইত্যাদি দক্ষতার পরীক্ষা নেয়া হয়। এসব পরীক্ষায় দেখা হয় সে আসলে আর্মির জন্যে উপযুক্ত কিনা। অফিসার হিসেবে সিলেক্ট করার আগে দেখা হয় তারা আর্মির সাইকোলজি মেনে নেয়ার উপযুক্ত কিনা। আর্মির কাজ হচ্ছে তিনটা, আদেশ দেওয়া, আদেশ শোনা ও আদেশ পালন করা। তাদের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে প্রস্তত থাকতে হয়। আবেগী মানুষকে আর্মিতে নেয়া হয় না। তাই বিডিআর বিদ্রোহের জন্যে আর্মি অফিসারদের মানসিক সমস্যায় কোন ব্যবস্থা নেয়ার দরকার পড়ে না।

সেনাবাহিনীর ওপর এর প্রভাব নাও পড়তে পারে যেহেতু তারা প্রশিক্ষিত। কিন্ত দেশের সাধারণ নাগরিকের মধ্যে সার্বভৌমত্বের যে ধারণা বা গৌরবের অনুভূতি ও চিন্তা সেখানে কোন ধরণের প্রভাব পড়তে পারে কি?

ফজলুর রহমান: এতে কোনো সন্দেহ নাই যে এর প্রভাব সামরিক বেসামরিক সকলের উপরেই পড়েছে। সবাই আঘাতপ্রাপ্ত এবং স্তম্ভিত হয়েছে ঘটনার তীব্রতায়। কিন্ত আমাদের সকলের দায়িত্ব একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে শোককে শক্তিতে পরিণত করা। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের।

ছবি: আবু তাহের খোকন

কিন্ত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করার কোনো লক্ষণ কি আমরা বর্তমান সেনাবাহিনী বা বর্ডার গার্ড থেকে পাই? যেমন বর্ডারে প্রতিনিয়ত বিএসএফ কর্তৃক আমাদের নাগরিক হত্যা হচ্ছে।

ফজলুর রহমান: মৌলিক ভাবে দেখলে আর্মির ভেতরে এবং বাইরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অস্ত্রের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। নতুন নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। দেশকে দুর্ভেদ্য করার চেষ্টায় এই সংগঠনগুলো গড়ে উঠছে।

হ্যা বর্ডারে আমাদের নাগরিক হত্যা হচ্ছে; আমরা যেয়ে পতাকা বৈঠক করে লাশগুলো নিয়ে আসছি এবং বর্ডার গার্ড কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এটা সকল নাগরিকের অভিযোগ, আমার নিজেরও। এটা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিনা অনুমতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সীমানায় যাবে না। কিন্ত কেউ যদি যায়ও তাহলে গুলি করে মেরে ফেলার কথা কোথাও বলা নাই। কেউ সীমানা অতিক্রম করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং বিএসএফ পরে তাকে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকে দেশে হস্তান্তর করা হবে। কিন্ত বিএসএফ তা করছে না। যেহেতু বিএসএফ আইন মানছে না, তাই বর্ডার গার্ডের উচিৎ ভারতকে আইন মানতে বাধ্য করা এবং এর জন্যে যা করা দরকার তাই করা। এবং আমাদের বর্ডার গার্ড এর সেই প্রশিক্ষণও রয়েছে। কিন্ত তারা তা করছে না এবং এটা আমারো অভিযোগ।

পিলখানায় সেনা হত্যাকান্ডের পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে শোনা যায়, সীমান্তে নানা সময়ে বিডিআরের বলিষ্ঠ ভূমিকা, বিশেষ করে জৈন্তাপুর ও রৌমারীর ঘটনার প্রেক্ষিতে কোন ধরণের প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করে থাকতে পারে কিনা?

ফজলুর রহমান: পিলখানার যে ঘটনা, মিডিয়ায় আসছে বা অনেকেই এটা মনে করেন। একটা স্ট্রং পারসেপশন আছে, এর মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র ছিল এবং এর পেছনে প্রতিবেশী দেশও জড়িত। যদিও এটা প্রমাণ হয় নাই বা ষড়যন্ত্র কি না তা প্রমাণ করার চেষ্টা হয় নাই এর জন্যেই মিটমাট টা সামগ্রিক হয় নাই, তাই শুধু আমাদেরই না অনেক নাগরিকেরই প্রশ্ন এর পেছনে কোন বহি:রাষ্ট্রের বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হাত ছিল কি না। আমরা যারা পত্রিকা পড়ি বা লিখি, তাদের কাছে এই ধারণাটা আছে।

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে

ফজলুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।