সিরিয়ায় টানা বিমান হামলায় প্রাণহানি ৪০০ ছাড়িয়েছে

সিরিয়ায় টানা বিমান হামলায় প্রাণহানি ৪০০ ছাড়িয়েছে

সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতা-য় দেশটির সরকারি বাহিনীর বিমান হামলায় এ পর্যন্ত চারশ’রও বেশি বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে। রাশিয়ার সাহায্যপুষ্ট সিরীয় সরকার সেখানকার বিদ্রোহীদের দমনের নামে সাধারণ নাগরিকদের বাড়িঘরের ওপর আকাশ পথে বোমাবর্ষণ করছে। খবর আলজাজিরার।

সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানায়, গত রবিবার শুরু হওয়া ওই বোমা হামলায় কমপক্ষে ৪০৩ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫০ শিশু রয়েছে। এছাড়া আরো ২ হাজার ১২০ জন গুরুতর আহত হন।

বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে কাউন্সিল সভার আগে এক বক্তব্যে জাতিসংঘের সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত স্টেফান ডি মিস্তুরা আশু যুদ্ধবিরতির আয়োজনে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতা-র মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সরকার ও বিদ্রোহী- উভয়পক্ষকেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে এবং তা না হলে সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাদ্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আহতদের সেখান থেকে অন্যত্র নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।’

স্টেফান ওই বিমান হামলায় আলেপ্পো হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেন।

ধ্বংসস্তূপের নিচে বসবাস

পূর্ব ঘৌতার বাসিন্দারা এখন গৃহহীন। বাসস্থান, এমনকি লুকানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। গাড়ির মেকানিক রাফাতুল আব্রাম দুমায় থাকেন। আকাশপথের ওই হামলায় তার কাজের ব্যাঘাত ঘটে। কারণ পর পর দু’বার বোমাবর্ষণের ফলে তিনি যে রাস্তায় কাজ করেন তা ধ্বংস হয়ে যায়। তার স্ত্রী এবং দুই কিশোরী কন্যা ওলা ও খাদিজা বাসায় অপেক্ষা করে কখন তিনি আসবেন এবং তারা প্রতিবেশীদের অবস্থা জানতে পারবে।

আব্রাম বলেন, ‘আমি আমার কয়েকটা সরঞ্জাম বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম এবং এখন তা দিয়েই যখন সুযোগ পাই তখন গাড়ির কাজ করছি। কখনো কখনো আমার কাজের জায়গার আশপাশেই বিস্ফোরণ হচ্ছে। তখন কাজ রেখে দ্রুত বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে মিলে আহতদের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করতে কাজ করছি।’

আব্রাম বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স-এর কাজই বেশি করতে হচ্ছে। কারণ এগুলোই বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে।’

সারা দিন পর বাসায় এলে ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আব্রামকে তাড়া করে বেড়ায়- যখন তার বাড়ির পাশের কাউকে দেখেন মৃত সন্তানের লাশের পাশে আহাজারি করতে অথবা বাবার কোলে বিস্ফোরণে পা হারানো শিশু কিংবা ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা পরিবারের সাহায্যের জন্য কারো কান্না ও খোদার কাছে সাহায্যের আর্তনাদ। তিনি বলেন, ‘এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখে বসে পড়ি এবং তাদের সঙ্গে আর্তনাদ করতে চাই। কিন্তু তা না করে তখন তাদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি।’

বাঁচো অার মরো এক সঙ্গেই

রাজধানী দামেস্ক-এর কাছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব ঘৌতা প্রধানত অনুন্নত এলাকা। ২০০৩ সাল থেকে সরকারের দখলেই আছে এটি। প্রায় চার লাখ সিরিয়ান নাগরিকের বাস এ অঞ্চলে। এ যাত্রায় ভয়াবহতম সরকারি হামলার ফলে সেখানে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছে চরম। এক প্যাকেট রুটির দাম এখন প্রায় ৫ ডলার। দেখা দিয়েছে অপুষ্টি। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশটিতে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ১১ দশমিক ৯ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে।

খাদ্য ঘাটতি মেটাতে এই ফেব্রুয়ারিতে মাত্র একটি ট্রাক নাশাবিয়াহ শহরে প্রবেশের অনুমতি পায়। কিন্তু গত ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে একটি গাড়িও যেতে দেয়া হয়নি।

নাসিমুল হাতমি আলজাজিরা-কে জানান, তার স্বামী ও ১০ বছর বয়সী কন্যার ঘুম ভাঙে বিমানের শব্দে। তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিদিন এভাবেই যায়। আশপাশে বিস্ফোরণ হওয়ার পর ঘর পরিষ্কার করি এবং এক ঘরে সবাই লুকাই, এক সঙ্গে জড়ো হয়ে থাকি, মরলেও এক সঙ্গেই মরবো। আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে এক বিছানায় ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞাসা করে, কেন সে বাইরে খেলতে বা স্কুলে যেতে পারবে না।’

হাতমি একজন শিক্ষিকা। পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে পড়ায় মাস কয়েক আগেই তার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্কুলে যেতে না পারলেও তার মেয়ে ও আশপাশের শিশুদের পড়ান প্রায় প্রতিদিনই। তার স্বামী সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য বের হয়ে বার্লি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন এবং তা দিয়ে তাদের সকাল ও রাতের খাবার হয়। অনেক সময় তিনি খালি হাতেই বাড়ি ফেরেন।

জনসাধারণের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ

সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্সের কর্মী মাহমুদ আদম বলেন, ‘পূর্ব ঘৌতা এখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। একটি সমাজকে নির্মূল করার জন্য এখানে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হচ্ছে- তাদের বাসাবাড়ি, স্কুল, বাজার, হাসপাতাল ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা কেন্দ্রে। এমন অনেক পরিবার আছে যারা দিনের পর দিন সূর্যের আলো দেখেনি। রাশিয়ান যুদ্ধবিমানের বর্বরতা দেখে ভয়ে বেসমেন্টে লুকিয়ে আছেন তারা।’

মাহমুদ আদম বলেন, ‘আমরা জানি না পৃথিবীকে আমাদের পরিস্থিতি জানাতে আমরা বেঁচে থাকব কি না। রকেট লাঞ্চার ও যুদ্ধবিমানগুলো রবিবার থেকে এখনো পূর্ব ঘৌতার আকাশে ঘোরাঘুরি করছে। আমাদের সবাই জানে, ওই আক্রমণ একটি হত্যাযজ্ঞ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ। ওই আক্রমণ হচ্ছে জনসাধারণের বিরুদ্ধে সিরিয়া সরকারের যুদ্ধ।’

চিকিৎসা কেন্দ্রও হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না

তুরস্কের সীমান্তবর্তী শহর গাজিয়ানটেপ থেকে আলজাজিরা প্রতিনিধি ওসামা বিন জাভেদ জানান, পূর্ব ঘৌতার ডাক্তারদের মতে, এখানকার পরিস্থিতি অবর্ণনীয়।

জাভেদ জানান, অস্থায়ী ক্লিনিকগুলোয় একের পর এক আহত মানুষ আসছে। তারা চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু জায়গা ও সরঞ্জামের অভাবে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কারণ সিরিয়ান-আমেরিকান মেডিকাল সোসাইটির মতে, রবিবার থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২২টি চিকিৎসা কেন্দ্র লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।

সিরিয়ান ইউনিয়ন অফ ফ্রি ডক্টরস-এর আহমেদ আল মাসরি জানান, সরকার বোমাবর্ষণের সবচেয়ে হিংস্র পথ বেছে নিয়েছে। এতে পূর্ব ঘৌতার বেশির ভাগ হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের ৩টি চিকিৎসা কেন্দ্র বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে একজন নিহতের পাশাপাশি তিনজন আহত হন।

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে অনৈক্য

ইতোমধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল যুদ্ধবিরতির আয়োজন করতেও ব্যর্থ হয়েছে। জরুরি সেবা সরবরাহ করতে সুইডেন ও কুয়েত  ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনে। কিন্তু জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসেলি নাবেনজায়া বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তিতে সম্মতি আসেনি। তিনি প্রস্তাবটিকে আরো বাস্তব সম্পন্ন করার কথা বলেন। তিনি ‘হোয়াইট হেলমেট’খ্যাত ‘সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স’-এর  বিরুদ্ধে “সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে বলে” অভিযোগ করেন।

জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বাশার আল জাফরি অভিযোগ করেন, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ‘সিরিয়ায় যুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মদদে যোদ্ধা সংগ্রহ’-এ সহযোগিতা করছে।

আলজাজিরার কূটনৈতিক সাংবাদিক জেমস বায়েস জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে বলেন, জাফরি এমন একটি সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করছেন যিনি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছনি। কূটনৈতিক দিক থেকে রাশিয়ার মদদ পাচ্ছেন তিনি। সিরিয়ার সরকারকে দুই বছর ধরে রাশিয়া সাহায্য করছে যুদ্ধের দিক পরিবর্তন করতে। এখন তারা সাহায্য করছে যেভাবেই হোক ওই যুদ্ধে জয়লাভ করতে।

৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদকৃত। তথ্য : ইনস্টিটিউট ফর দি স্টাডি অফ ওয়ার, সাউথ ফ্রন্ট  -ALJAZEERA