বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকদিন থেকেই কার্যত ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তাুরিত অালাপ আমাদের চোখে পড়ে না। প্রবীণ রাজনীতিক ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠকণ্ঠ বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের আলাপটি আশা করি এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা উসকে দেবে।
বাঙলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অপ্রতিহতভাবে বিচরণ করছে। তারাই পরিণত হয়েছে শাসক শ্রেণীর প্রধান ও সব থেকে শক্তিশালী অংশে। এটা কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় সম্ভব হলো, সেটা দেখার আগে প্রথমেই দেখা দরকার যে রাজনৈতিক দল স্বাধীন বাঙলাদেশে প্রথম ক্ষমতাসীন হলো তাদের শ্রেণী চরিত্র। এদের শ্রেণী চরিত্র নিয়ে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে কোন আলোচনাই দেখা যায় না। দেশি বিদেশি কোন গ্রন্থকারও এদিকে আজ পর্যন্ত নজর দেন নি। এর ফলে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার শেষে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যে পরিণতি লাভ করেছে সে বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণাই জনগণের তো নয়ই, এমনকি এদেশের বুদ্ধিজীবী মহল এবং ইতিহাসবিদদেরও নেই। এর ফলে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চড়িয়ে সরকারি লোকরা ও তাদের সাথে সম্পর্কিত লেখক বুদ্ধিজীবীরা বাঙলাদেশের “ইতিহাস” রচনা করেন!
পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাঙলা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বৈষম্যের শিকার ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ আমলের তুলনায় এখানে মুসলমান মধ্য শ্রেণীর একটা বিকাশ শুরু হয়েছিল। বিশেষতঃ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম হলেও পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগ ও শিল্পের বিকাশ কিছুটা বেশি হওয়ায় এখানে একটা মধ্য শ্রেণী গঠিত হয়েছিল। এই মধ্য শ্রেণীর আকার বড় ছিল না এবং তার মেরুদণ্ড বলেও কিছু ছিল না। কারণ এখানে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছিল সেটা পাকিস্তান সরকারের সরাসরি উদ্যোগেই হয়েছিল এবং সরকারের সাথে সম্পর্ক ছাড়া অন্যভাবে সেটা সম্ভব ছিল না। শিল্পের জন্য প্রয়োজন ছিল পুঁজি, জমি, লাইসেন্স ও বৈদেশিক মুদ্রা। এর প্রত্যেকটি নির্ভরশীল ছিল সরকারের ওপর। এ কারণে সরকারি দলের লোক, তাদের আত্মীয় স্বজন, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত লোকজনই বিনিয়োগের সুযোগ পেতো এবং যেটুকু শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল তাদের মালিকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছিল সরকারের লোক। সরকার বিরোধী কোন লোকেরই সহজ সুযোগ ছিল না কোন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের। কাজেই শিল্প ও সেই সাথে ব্যবসা মালিকদের স্থান কোন বিরোধী দলে ছিল না, সামান্য দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া! আওয়ামী লীগের মধ্যেও তারা অনুপস্থিত ছিল।
১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানের পর এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, বাঙলাদেশে সরকার বিরোধীরা ক্রমশঃ শক্তিশালী হওয়ার শর্ত তৈরি হয়েছে এবং সরকারের অবস্থান দ্রুত দুর্বল হচ্ছে। সরকারের এই অবস্থা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে আরও খারাপ হওয়ায় শিল্প ব্যবসা মালিক, আমলা এবং সরকারের সাথে সম্পর্কিত অনেকে সরকার পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কিত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু তার ফলে এই শেষ পর্যায়ে তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগ সংগঠনে কোন শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা সম্ভব ছিল না।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ বাঙালী মধ্য শ্রেণী বা পেটি বুর্জোয়াদের দল হিসেবে আকারে বড় ও প্রভাবশালী হচ্ছিলো এবং ষাটের দশকের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সব থেকে বড় দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ছিল একটি মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক দল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি এবং অবস্থানের কারণে ও তাকে ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের আকার বড় হলেও তার শ্রেণীগত চরিত্র ছিল খুব দুর্বল। তারা ছিল মূলতঃ
মধ্যস্বত্বভোগী এবং উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন নানা স্বার্থের প্রতিনিধি। দেশের কোন মৌলিক শ্রেণী অর্থাৎ কৃষক শ্রমিক থেকে নিয়ে শিল্প ব্যবসা মালিক, বড় ভূমি মালিক, আমলা ইত্যাদির কোন প্রতিনিধিত্ব তার মধ্যে ছিল না। আওয়ামী লীগের এই গঠনের (composition) দিকে তাকালে দেখা যাবে উকিল মোক্তার, পাট ও বীমার দালাল, ফড়িয়া ফটকাবাজ ব্যবসায়ী ইত্যাদি লোকরাই ছিল তার নেতৃত্বে। এই সাথে তাদের মধ্যে ছিল প্রাথমিক মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক, ছোট সরকারি কর্মচারি, ছোট দোকানদার, ছাত্র এবং যুবক বেকারের দল। এরা প্রত্যেকেই ছিল উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন। এই ধরণের একটি সংগঠন দেশে সর্বপ্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত ও শক্তিশালী হওয়ার মধ্যে যথেষ্ট বিপদ ছিল এবং দেশ ও জনগণ এই বিপদের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম থেকেই পড়েছিল।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগ এক জনসভা করেছিল। সেই বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবের বক্তৃতা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, জনগণকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এটা ছিল তাঁর দ্বারা উচ্চারিত এক মহা সত্য। কিন্তু তার সাথে তিনি যে সব কথা বলেছিলেন তার চরিত্র ছিল অন্য রকম। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলেছিলেন, মুক্তি সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। তার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন লাঠি শোঁটা নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা ইতিপূর্বে কেউ বলে নি, কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে কেউ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে না। তারা বাইরে বের হয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করে। তাছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অস্ত্র শক্তির মোকাবেলার জন্য যার যা আছে, লাঠি শোঁটা ইত্যাদি দিয়ে লড়াই করতে যাওয়া এক ধরনের আত্মঘাতি ব্যাপার ছাড়া আর কিছু নয়। কাজেই এসব কথা পরিস্থিতির চাপে শেখ মুজিবের বাগ্মিতার উত্তেজিত উচ্ছাস (oratorical exuberance) ছাড়া আর কিছু ছিল না। তার সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না দেশের ভূমি বাস্তবতার (ground reality)।
এর প্রমাণ পাওয়া গেল ৭ই মার্চের পরই। তাঁরা পাকিস্তান সরকারকে অমান্য করে দেশের শাসনভার নিজেদের হাতে নিলেন। কিন্তু দেখা গেল কমিউনিস্টসহ কোন ধরণের রাজবন্দীকে তাঁরা জেল থেকে মুক্তি দিলেন না, যদিও জেলের পুরো নিয়ন্ত্রণ তখন তাঁরাই করছিলেন। মণি সিংহ, দেবেন শিকদার, ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল্লাহ সহ বহু সংখ্যক নেতাকে তাঁরা জেলেই আটক রেখেছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য মুক্তি দেন নি। তাঁরা জেলে আটক ছিলেন যেভাবে পাকিস্তান সামরিক সরকার তাঁদেরকে আটক রেখেছিল, অথচ তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন দেশপ্রেমিক।
এর আরও বড় প্রমাণ পাওয়া গেল ১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আসার পর। দেখা গেল, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করার কথা তাদের সাথেই আওয়ামী লীগ নেতারা বসলেন পাকিস্তানের সংসদীয় সংকট সমাধানের জন্য। এ কথা কি আওয়ামী লীগ নেতারা বলতে পারেন যে, ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনায় তাঁরা স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সকল তথ্য অনুযায়ী তাঁরা আলোচনা করেছিলেন পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা। আওয়ামী লীগের দাবি ছিল জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পাকিস্তানে সরকার গঠন করা এবং শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো। ১৫ই মার্চের পর থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাথে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর যেসব আলোচনা হয়েছিল তার মধ্যে কি অন্য কিছু ছিল?
বাঙলাদেশের স্বাধীনতা তো দূরের কথা, জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর পক্ষে সম্ভব ছিল না এটাই ছিল ভূমি বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা অনুযায়ীই পাকিস্তানের সামরিক সরকার এদেশের জনগণের ওপর এক সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৫শে মার্চ রাত্রে আক্রমণ শুরু করেছিল। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে পূর্ব বাঙলার মাটিতে ঐ দিনই পাকিস্তান উচ্ছেদ হয়েছিল।
এই আক্রমণের পরবর্তী ঘটনাবলীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র ও তার চরম দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছিল। ২৫শে মার্চের আগে মার্চ মাসের প্রথম থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ প্রবল বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন এবং ২৫শে মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ, যে যুদ্ধে গরীব কৃষক শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এবং অসংখ্য নারী অংশ গ্রহণ করেছিলেন ব্যাপকভাবে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের এই অংশ গ্রহণ ছিল এক উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। সেই পরিস্থিতিতে কোন দল নয়, কোন নেতা নয়, জনগণই তাঁদের প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, শুরু করেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে তাঁদের সংসদীয় সংলাপ ভেঙে যাওয়ার পর সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে তাঁদের নেতৃত্ব ধসে পড়েছিল। তাঁদের সর্বোচ্চ নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে জনগণ বিপুল সমর্থন দিলেও তিনি শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ও নেতৃত্ব দিতে অপারগ হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে ঘরে বসে আত্মসমর্পন করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ, আমীরুল ইসলাম, কামাল হোসেনরা ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার পর তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করার জোর তাগিদ দিলেও তিনি তাতে সম্মত হন নি। এ কথা আমীরুল ইসলাম ও কামাল হোসেন তাঁদের স্মৃতিকথায় বলেছেন। এ ধরনের কোন ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে ঘটে নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেওয়ার ও সে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে তাঁর আত্মসমর্পণকে আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘরাণার তথাকথিত ইতিহাসবিদরা নানাভাবে যতই ব্যাখ্যা করুন তার হাস্যকর দিক ও ভূয়া চরিত্র অস্বীকার করা যাবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তে অন্য সকলকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে কোন নেতা বা সিপাহসালার নিজে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারেন? তাঁর পরিবারকেও সেনাবাহিনী আটক করে ঢাকার ধানমন্ডির এক বাড়িতে আটক করে তাঁদের দেখাশোনা ও নিরাপত্তা বিধান করলেন, যে সৌভাগ্য বাঙলাদেশের জনগণের জন্য তখন কল্পনাও করা যেতো না।
২৫শে মার্চের আক্রমণের পর শেখ মুজিবের আত্মসমর্পণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের সমগ্র নেতৃত্ব ও কর্মীবৃন্দ ও তাঁদের ঘরাণার বুদ্ধিজীবীর দল প্রাণ রক্ষার জন্য দেশের জনগণকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মম আক্রমণের মুখে ফেলে ভারতে পলায়ন করলেন। সে সময় তাঁদের এই পলায়ন প্রসঙ্গে চারু মজুমদার বলেছিলেন, These people reached India as soon as their legs could carry them। এই পুরো ব্যাপারটিই ঘটেছিল সংসদীয় রাজনীতিতে অভ্যস্ত আওয়ামী লীগের কোন যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা, ক্ষমতা ও প্রস্তুতি একেবারেই না থাকার কারণে। সেই অবস্থায় তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধসে পড়া ছিল এক স্বাভাবিক ব্যাপার। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ করার কোন ক্ষমতাই আওয়ামী লীগের ছিল না।
এভাবে শূন্য হাতে ভারতে উপস্থিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাজ দাঁড়িয়েছিল ভারত সরকারের কাছে দেনদরবার করা এবং বাঙলাদেশকে স্বাধীন করার দায়িত্ব ভারত সরকারের ওপর অর্পণ করে তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করা। যেভাবে বাঙলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকারের ভূমিকা যথাক্রমে কি ছিল তা সুবিদিত। ভারত সরকার ও ভারতীয় সেনাবাহিনী ছাড়া বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কোন সম্ভাবনাই তখন ছিল না। তবু সেই অবস্থায় হাজার হাজার কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্তের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন এবং যথাযথ সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে তাঁরা অকাতরে নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন। ভারত সরকার এবং আওয়ামী লীগ তাঁদেরকে পাকিস্তানী কামানের খোরাক (cannon fodder) হিসেবেই ব্যবহার করেছিল।
এই বাস্তবতার প্রতিফলন ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যে ঘটেছিল। তথাকথিত ভারত-বাঙলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পনের কথা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বাঙলাদেশের কোন ভূমিকা সেখানে ছিল না। ভারতীয় ইস্টার্ণ কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা এবং পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিয়াজী আত্মসমর্পণ চুক্তিতে (instrument of surrender) সই করেছিলেন। বাঙলাদেশের সেনা অধিনায়ক ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন এবং ডেপুটি অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম খোন্দকার পেছনে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন!
এই চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক দিন পর তাজউদ্দীন এবং প্রবাসী বাঙলাদেশ সরকারের নেতারা ভারতের তত্ত্বাবধানে দেশে ফিরেছিলেন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার তাঁকে লণ্ডনে পাঠিয়েছিল। সেখান থেকে দিল্লী হয়ে তিনি ঢাকা পৌঁছেছিলেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। জনগণ ঢাকা বিমান বন্দরে বিশাল আকারে উপস্থিত হয়ে শেখ মুজিবকে যেভাবে সংবর্ধনা জানিয়েছিল সেটা এদেশের ইতিহাসে এক বড় রকম উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
স্বাধীন বাঙলাদেশে একেবারে প্রথম থেকেই শুরু হলো ব্যাপক আকারে আওয়ামী লীগের ছাত্র, যুবক ও নানা স্তরের নেতা কর্মীদের লুটপাট। তাদের প্রথম টার্গেট হলো অবাঙালীরা। তাদের বাড়ীঘর, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়ে তারা অনেকে একেবারে ভিক্ষুকে পরিণত হলেন। অনেকে কোন রকমে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন পাকিস্তানে। কিন্তু শুধু অবাঙালীই নয়, বাঙালীদের অনেকের অবস্থাও হলো একই রকম। উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন, ফড়িয়া চরিত্র সম্পন্ন লোকদের উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থ সম্পদ অর্জনের কোন উপায় না থাকায় বিদ্যমান সম্পদ লুটপাট ছাড়া সম্পদ অর্জনের অন্য পথ ছিল না। কাজেই প্রথম থেকেই সেই পথ ধরে তারা সারা দেশ জুড়ে এমন কর্মকাণ্ড শুরু করলো ও চালিয়ে যেতে থাকলো যার সাথে তাদের কথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ কোন সম্পর্ক ছিল না। এর পরিণতি যা দাঁড়িয়েছিল তা দেখার আগে আওয়ামী লীগ সরকার কি করেছিল তার দিকে তাকানো দরকার।
আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকার প্রধান শেখ মুজিবর রহমান বাঙলাদেশের সংবিধানের খসড়া রচনা করে সেটা সংবিধান সভায় পাশ করলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীন বাঙলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য কোন সংবিধান সভা নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন না করে তাঁরা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার তত্ত্বাবধানে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য এবং সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদেরকে নিয়েই গঠন করলেন বাঙলাদেশের সংবিধান সভা! এটা ছিল এক অবাক কাণ্ড। ইচ্ছে করলে অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা স্বাধীন বাঙলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সংবিধান সভা গঠন করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তাঁরা ইয়াহিয়ার দ্বারা গঠিত পাকিস্তানের সংবিধান সভার দ্বারাই গঠন করেছিলেন স্বাধীন বাঙলাদেশের সংবিধান!! কাজেই এই সংবিধানের মধ্যে ১৯৭১ সালের ‘মুক্তি যুদ্ধের চেতনার’ কোন প্রতিফলন ছিল না। এটা কোন উপেক্ষার বিষয় নয়। কিন্তু এর কোন ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
এটা তো গেল সংবিধান প্রসঙ্গে প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হলো, এইভাবে গঠিত সংবিধানের সাথে বাঙলাদেশের বিদ্যমান ভূমি বাস্তবতারও কোন সম্পর্ক ছিল না। কাজেই দেখা গেল সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের চার খুঁটি হিসেবে ঘোষণা করার পর অল্প দিনের মধ্যে পর পর চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে বাঙলাদেশ পরিণত হলো একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ পুরাতন কায়দায় সরকার পরিচালনায় অপারগ হয়ে নিজেদের পুুরানো দলকে বাতিল করে গঠন করলো ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)’ নামে এক নতুন রাজনৈতিক দল। অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে দেশে প্রচলিত হলো একদলীয় একচ্ছত্র শাসন। শুধু কয়েকটি সরকারি পত্রিকা ছাড়া সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হলো। চারিদিকে শুরু হলো ব্যাপক ধরপাকড় ও জেল জুলুম। দেশে নেমে এলো এক সন্ত্রাসের রাজত্ব।
এইসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই রাজনীতি ক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অপসারিত হয়ে তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হতে শুরু করেছিল ব্যবসায়ীরা। তারা যে সংকট শাসক শ্রেণীর মধ্যে সৃষ্টি করেছিল তার পরিণতিতেই শেখ মুজিবকে নিজের দল পর্যন্ত ভেঙে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল বাকশালের মত একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল।
ব্যবসায়ী শ্রেণী কর্তৃক বাঙলাদেশে শাসন ক্ষমতা দখলের সাথে আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ছিল। উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন, মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়া চরিত্রের লোকরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে যা হয় তা-ই এক্ষেত্রে হয়েছিল। তারা লুম্পেন চরিত্র প্রাপ্ত হয়েছিল। শুধু অর্থনীতি ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র সমাজে তারা সৃষ্টি করেছিল বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য। লুটতরাজ ও দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের হাতে দ্রæত পুঁজি সঞ্চিত হতে থাকে। কিন্তু সে পুঁজি বিনিয়োগে আইনগত বাধা থাকায় এক্ষেত্রে এক সংকট সৃষ্টি হয়।
১৯৭২ সালেই আওয়ামী লীগ একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিল। কয়েকজন উদ্ভট সমাজতন্ত্রী দ্বারা গঠিত এই পরিকল্পনা কমিশন বাঙলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে যেমন শিল্প বাণিজ্য জাতীয়করণ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে তারা ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সিলিং ধার্য করেছিল ২৫ লাখ টাকা। পাকিস্তানি পুঁজি মালিকদের সম্পত্তি, কলকারখানা ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় খাতে ইস্ট পাকিস্তান ইনডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (EPIDC) মত একটা রাষ্ট্রীয় করপোরেশনের ওপর সেগুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলে তাতে অসুবিধার কিছু থাকতো না। কিন্তু সরকার শুধু পাকিস্তানিদের শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যই বাজেয়াপ্ত করে নি, বাঙালী শিল্প মালিকদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করে তার রাষ্ট্রীয়করণ করেছিল। এই শিল্প মালিকরা পাকিস্তানি আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সম্পর্কিত থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে তাদের কোন অবস্থান ছিল না এবং জাতীয়করণের নামে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সময় তাদের কোন প্রতিরোধ শক্তি ছিল না। জাতীয়করণকৃত এসব কলকারখানা ও শিল্প ব্যবসার ম্যানেজারি ও কর্তৃত্ব আওয়ামী লীগের লোকদেরকেই দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এগুলি লুটপাট করেছিল অবাধ ও বেপরোয়াভাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা ‘সমাজতন্ত্র’ নির্মাণের জন্য যে পরিকল্পনা সুপারিশ তাঁদের রিপোর্টে করেছিলেন তার সাথে আওয়ামী লীগের স্বার্থ ও ভূমি বাস্তবতার কোন সম্পর্ক ছিল না। এ কারণে শেখ মুজিব তাকে হিসাবযোগ্য মনে না করে ময়লার বাক্সে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা একে একে পদত্যাগ করে বিদায় নিয়েছিলেন। এর ফলে পরিকল্পনা কমিশন বলে বাস্তবতঃ আর কিছু থাকে নি।
এ দিকে লুটপাট, চুরি দুর্নীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা ও তাদের লোকজনের হাতে যে কোটি কোটি টাকা সঞ্চিত হয়েছিল তার কোন বিনিয়োগের ব্যবস্থা না থাকায় সে পুঁজি শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় নি ২৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগের সিলিং ধার্যের ফলে। কিন্তু পুঁজি তো কৃপণের সঞ্চয় নয়। তার লক্ষ্য হলো মুনাফা। আইনসম্মত উপায়ে সে মুনাফা অর্জনের পথ খোলা না থাকায় তা বিনিয়োজিত হতে শুরু করেছিল বেআইনি ব্যবসা খাতে। এই ব্যবসা আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ছিল মজুতদারি ও চোরা কারবার ও বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে ছিল চোরাচালান। এভাবেই গঠিত হয় বাঙলাদেশের নব্য ধনিক শ্রেণী। শেখ মুজিবের শাসন আমলেই শুরু হয় তাদের শাসক শ্রেণীতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে সমগ্র অর্থনীতি, প্রশাসন ও রাজনীতিতে যে বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ও সংকট তৈরি হয় সেটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের আর থাকে নি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো সেই পরিস্থিতিতে অনুপযুক্ত হওয়ার কারণেই আবির্ভাব হয়েছিল বাকশালের মত পুরোপুরি একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠনের। কিন্তু পরিস্থিতি এমন সংকটজনক ছিল যে, সেটা করেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের টিকে থাকার সম্ভাবনা শেষ হয়েছিল। সেই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চক্রান্তের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এক অংশের নেতা এবং সামরিক বাহিনীর একাংশের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। শেখ মুজিবকে হত্যার পর চারজন ছাড়া তাঁর মন্ত্রীসভার মন্ত্রীরা সকলে মোস্তাকের মন্ত্রী সভায় প্রাণভয়ে যোগদান করেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীরা হত্যার বিরুদ্ধে একটা লিফলেট ও পোস্টার দিতে অথবা মিছিল করতে সম্পূর্ণ অপারগ হয়ে উধাও হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালেই কয়েক মাস পর সামরিক বাহিনী মোস্তাককে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তার ফলে বাঙলাদেশের ব্যবসায়ী বুর্জোয়ারা ক্ষতিগ্রস্থ তো হয়-ই নি, উপরন্তু তারা নিজেদের অবস্থান শক্তভাবেই ধরে রেখেছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও পরে এরশাদ ছিলেন এই লুম্পেন ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদেরই রাজনৈতিক প্রতিনিধি। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপি, বিশেষতঃ আওয়ামী লীগের আমলে এই পরিস্থিতি এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
১৯৭১ সালেই মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ প্রায় ভেঙে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বাঙলাদেশ আমলে তার একটা অংশ তাঁর নেতৃত্বে ছিল। তিনি সেটা জিয়াউর রহমানকে উপহার দিয়েছিলেন এবং তাঁরা বিএনপিতে যোগদান করায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি খাড়া হয়ে ও এক ধরণের স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল আওয়ামী বাকশাল আমলে চোর দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের একটা অংশ। এই পরিস্থিতি এরশাদের সামরিক শাসন আমলে একই রকম ছিল এবং বিএনপির পথ ধরে এরশাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর জাতীয় পার্টি। জিয়াউর রহমান নিজে ব্যক্তিগতভাবে চোর দুর্নীতিবাজ ছিলেন না, কিন্তু তিনি চোর দুর্নীতিবাজ পরিবৃত থাকতেন, তাদেরকে ব্যবহার করতেন। এটা রাজনীতিতে কোন নতুন ব্যাপার ছিল না। ভারতে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং এখন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ব্যক্তিগতভাবে চোর দুর্নীতিবাজ বলা যাবে না। কিন্তু তাঁরাও চোর দুর্নীতিবাজদের দ্বারা পরিবৃত। এরশাদের অবস্থা এদিক দিয়ে ভিন্ন ছিল। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মহা চোর ও দুর্নীতিবাজ ছিলেন এবং তাঁর শাসন আমলে চোর দুর্নীতিবাজরা ব্যবসায়ী বুর্জোয়া হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান বেশ শক্তিশালী করেছিল।
১৯৯০ সালে এরশাদের সামরিক সরকার উৎখাতের পর তথাকথিত সংসদীয় শাসনে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের শক্তি আরও সংহত ও শক্তিশালী হয়। আগেকার দিনে ব্রিটিশ অথবা পাকিস্তানি আমলে রাজনীতিতে, বিশেষতঃ নির্বাচনের সময়, অর্থ ও পেশি শক্তির কোন প্রকৃত ভূমিকা ছিল না। তখনো পর্যন্ত নির্বাচনের সময় অর্থের বিনিময়ে কারও নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ ও নির্বাচনের ব্যয় নির্বাহের ব্যাপার ছিল না। আর্থিকভাবেও নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব থাকতো রাজনৈতিক দলগুলির। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর থেকে এই পরিস্থিতি আরও দ্রুত পরিবর্তিত হয়। নির্বাচনে মনোনয়ন লাভের জন্য দলকে লাখ লাখ বা কোটি কোটি টাকা দেওয়া শুরু হয়। আওয়ামী লীগ আমলে এই দুর্নীতি তাদের সংগঠনের একটা প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজে পরিণত হয়। এর ফলে পুরানো রাজনৈতিক নেতারা ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়ে রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রায় নির্মূল হয়। অর্থের জোরে সংসদীয় বড় দুই দলই অর্থ সম্পদের মালিক ব্যবসায়ীদেরকে মনোনয়ন দেওয়ার ফলে সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। সকল কর্মকাণ্ডে, নীতি প্রণয়ন থেকে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি ও তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় সংসদ সদস্যদর মধ্যে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু হয়ে এখন তাদের সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি। অন্যরা সরাসরি ব্যবসায়ী না হলেও দুচার জন ব্যতিক্রম ছাড়া কোন না কোন ভাবে তারাও ব্যবসার সাথে যুক্ত। এর একটা প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দিনের পর দিন কোরাম না হওয়ার মধ্যে। এভাবে কোরাম ফেল করার ঘটনা কোন দিনই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে, এমনকি বাঙলাদেশে ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে হতো না। কারণ সে নির্বাচনেও রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সে অবস্থা এখন আমূলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগেও বিভিন্ন সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল যে, জাতীয় সংসদ অধিবেশন চলা কালে কোরাম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিবেশন বেশ নির্বিঘ্নেই চলেছিল! এটা এখন প্রায় প্রত্যেক দিনেরই ব্যাপার!! এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, কোরাম না থাকলে যেখানে অধিবেশন মূলতুবী করার কথা সেখানে সংসদে স্পিকার সেটা না করে অধিবেশন চালিয়ে যান। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অগ্রাহ্য হওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না। অধিবেশনের কাজ কোরাম হলে যেভাবে রেকর্ড হয় সেভাবেই রেকর্ড হয়ে আইনসিদ্ধ হয়। কোন দেশে জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্টে এটা হতে পারে, এ কথা চিন্তা করাও যায় না। কিন্তু অন্য দেশের ক্ষেত্রে যা চিন্তার বাইরে, বাঙলাদেশে তাই হচ্ছে এবং প্রত্যেক অধিবেশনেই তা হচ্ছে নিয়মিতভাবে।
এভাবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কোরাম না থাকার বিষয়টি সংবাদপত্রে রিপোর্ট করা হলেও কেন এমন হচ্ছে এ নিয়ে কারও জিজ্ঞাসা নেই। কোরাম ছাড়া এভাবে খোদ জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার কিভাবে সংসদের কার্যক্রম গ্রাহ্য ও আইনসম্মত হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন এ নিয়ে কোন রাজনৈতিক মহল থেকেও কোন প্রশ্ন করা হয় না! এটা এক মহা ব্যতিক্রমী এবং অদ্ভূত ব্যাপার হলেও এই হলো বাঙলাদেশের বর্তমান অবস্থা!!
জাতীয় সংসদ এই অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার কারণ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি থাকায় এরা প্রকৃত রাজনৈতিক উপাদান না হওয়ায় ব্যবসার গুরুত্ব এদের কাছে রাজনীতির গুরুত্বের থেকে অনেক বেশি। কাজেই রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের কোন উৎসাহ অথবা প্রয়োজন নেই। রাজনীতি, সংসদ সদস্য হওয়া ইত্যাদির সবকিছুর মূলেই এদের ব্যবসায়ী স্বার্থ। ঠিক এ কারণেই জাতীয় সংসদের অধিবেশনে গিয়ে সময় নষ্ট করার থেকে সে সময় তাদের ব্যবসার কাজ করা এবং নানা ধরণের সরকারি সুবিধার জন্য সেক্রেটারিয়েটে ঘোরাঘুরি করা অনেক লাভজনক। এ কারণেই তারা জাতীয় সংসদের অধিবেশনের সময় সেখানে অনুপস্থিত থাকে এবং সেখানে কোরাম ফেল হয়। এই অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে কোরামের অভাবে অধিবেশন বন্ধ রাখলে অধিবেশন একেবারেই অসম্ভব ও অচল হবে। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই বাঙলাদেশ জাতীয় সংসদেও স্পীকার কোরাম ছাড়াই অধিবেশন অব্যাহত রাখেন!!! বাঙলাদেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের থেকে ব্যবসায়ীদের অপ্রতিহত প্রাধান্যের কারণেই রাজনীতি থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বিতাড়িত হয়েছেন। আগেকার যে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি এখনো টিকে আছেন তাঁদের রাজনৈতিক চরিত্রও পরিবর্তিত হয়ে তাঁরা পরিণত হয়েছেন ব্যবসায়ীতে।
মার্কস তাঁর ক্যাপিটাল এর তৃতীয় খণ্ডে Historical Facts About Merchants’ Capital শীর্ষক এক পরিচ্ছদে বলেছেন, “Merchants’ capital, when it holds a position of dominance, stands everywhere for a system of robbery, so that its development among the trading nations of old and modern times is always directly connected with plundering, piracy, kidnapping slaves, and colonial conquest; as in Carthage, Rome, and later among the Venetians, Portuguese, Dutch etc.” (Karl Marx: Capital, Volume III, Progress Publishers, Moscow, 1966, P. 331) বাঙলাদেশে এখন চুরি দুর্নীতি, লুটতরাজ, হত্যা, গুম, নানা ধরনের দস্যুতার যে ব্যাপক রাজত্ব কায়েম হয়েছে এটা বাঙলাদেশে ক্ষমতাসীন ব্যবসায়ী পুঁজির কোন বিশেষত্ব বা নতুন কীর্তি নয়, এটা মার্কসের ওপরে উদ্ধৃত বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
যারা সরকারি ক্ষমতার আসনে বসে আছে তাদের মধ্যে ব্যবসায়ীরা এবং বর্তমানে ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত প্রাক্তন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আছেন। এদের নিয়ন্ত্রণ দেশের প্রশাসন, আইন শৃংখলা বাহিনী, শিক্ষা, শিল্প আদালত ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে থাকার কারণে দেশে এখন এক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও এর প্রভাব ব্যাপক ও মারাত্মক। এদের নীতিজ্ঞান বলে কিছুই নেই। এরা যে সব দুর্নীতি ও গর্হিত কাজ নিজেরা অহরহ করে চলেছে সে সব কাজ না করার জন্য এরা জনগণকে সভা সমাবেশে বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রচার মাধ্যমে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে নির্দেশ উপদেশ দিচ্ছে। এক নম্বর দুর্নীতিবাজও দিন রাত বলছে দুর্নীতিবাজদের বিচার চালিয়ে যাবো। তাদের রেহাই দেওয়া হবে না। এ কাজে কোন লজ্জাবোধ তাদের নেই। শুধু তাই নয়, যারা তাদের বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে এরা অশ্লীল ভাষায় কটুক্তি করতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। ভদ্রতা, শালীনতা ও সভ্যতার লেশমাত্র এদের আচরণে নেই। এদিক দিয়ে বলা চলে এদের আচরণগত সংস্কৃতি অতি নিম্ন পর্যায়ের। লুটতরাজ ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের চরিত্রের প্রতিফলনই এদের এই আচরণের মধ্যে দেখা যায়। এরা নিজেরা খুন খারাবি করলেও তার কোন বিচার হয় না। এমনকি থানাতেও এসব খুনখারাবির ডায়েরি লেখে না। এসব নিয়ে যতই আন্দোলন হোক, তার কোন তোয়াক্কা এরা করে না। হত্যা সহ নিজেদের সব রকম দুর্নীতির মামলা এরা ধামাচাপা দিয়ে রাখে। এদের বিরুদ্ধে বড় বড় মামলা হলেও নিজেরা সরকারি ক্ষমতায় বসে সে সব মামলা এরা আদালতকে দিয়ে প্রত্যাহার করে। অথচ অন্যদেরকে নানা মামলায় ফাঁসিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে শাস্তি দেয় ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে বেপরোয়াভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদেরকে হয়রাণ করে।
ক্ষমতাসীন ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে মার্কস ওপরে যা বলেছেন সেটা আরও স্পষ্ট করার জন্য তিনি একই পৃষ্ঠায় এক ফুট নোটে মার্টিন লুথারকে উদ্ধৃত করেছেন। এই উদ্ধৃতিতে লুথার বলেছেন,“Although the merchants daily rob the whole world, while a knight may rob one or two once or twice a year.” “Go by the word of Isaiah: Thy princes have become the companions of robbers. For they hang the thieves, who have stolen a gulden or a half gulden, but they associate with those, who rob all the world and steal with greater assurance than all others, so that the proverb remains true: Big thieves hang little thieves’ and as the Roman Senator Cato said: Mean thieves lie in prisons and stocks, but public thieves are clothed in gold and silk.”
বাঙলাদেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে এই উদ্ধৃতিতে যা বলা হয়েছে তার অপূর্ব সাদৃশ্য খুব লক্ষণীয়। বাঙলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকরা ও তাদের ব্যবসায়ী সাঙ্গপাঙ্গরা ও সহযোগীরা যেভাবে ক্ষেত্র বিশেষে ছোট খাটো চোর ধরলেও, নিজেরা পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি, লুটপাট করে নিজেদেরকে ‘সোনা ও সিল্কে’ মুড়িয়ে রেখেছে এটা এক প্রকাশ্য ব্যাপার। উন্নয়নের নামে প্রকল্প তৈরি করে এরা লুটপাট করছে, ভূমি দস্যুতা করছে এবং হেন অপরাধ নেই যা করছে না।
নিজেদের এই রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের সব থেকে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি যেভাবে ভূয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল সেটা এদের শ্রেণী চরিত্রের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে একইভাবে নিজেদের সরকারি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এরা এখন চক্রান্ত করছে। কিন্তু এরা ক্ষমতায় আসুক অথবা এদের পরিবর্তে অন্য কোন রাজনৈতিক দল অথবা শক্তি ক্ষমতায় আসুক, বাঙলাদেশে ব্যবসায়ীরা যেভাবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে তার পরিবর্তন সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোন সংস্কারের মাধ্যমে সম্ভব, এটা মনে করা সম্পূর্ণ অবাস্তব। সেটা হওয়ার কোন উপায় একেবারেই নেই।
লেখাটি ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ শনিবার ঢাকা স্বদেশ চিন্তা সংঘ আয়োজিত ড. আহমদ শরীফ স্বারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়।