তিনি এই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কবি। চিন্তক হিসেবেও এখনকার সময়ে রেজাউল করিম রনি অগ্রগণ্য। তরুণদের কাছে তিনি ‘ইন্টেলেকচুয়াল রকস্টার’। তার কাজের পরিধি বহু বিস্তৃত। সাহিত্য, রাজনীতি, মিডিয়া ও দর্শন নিয়ে তার গভীর ভাবনা-চিন্তা বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। চট্টগ্রামভিত্তিক সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘চন্দ্রবিন্দু’র পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেন সম্পাদক মঈন ফারুক। তার সঙ্গে ছিলেন একেএম সাইফুল ইসলাম, সাখাওয়াত সামির ও নজরুল ইসলাম। ওই কাগজটির ডিসেম্বর ২০১৬, অষ্টম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। ‘জবান’ ও চন্দ্রবিন্দুর যৌথ ব্যবস্থাপনায় অনলাইন সংস্করণ হিসেবে ওই সাক্ষাৎকার এখানে পেশ করা হলো।
মঈন ফারুক : চিন্তার জগৎ নির্মাণের জন্য বিভিন্ন লেখালেখি আর যারা কবিতা লেখেন তাদের মধ্যকার পার্থক্যকে কীভাবে দেখেন?
রেজাউল করিম রনি : আপনার প্রশ্নটা যদি বুঝে থাকি তাহলে এমনভাবে বলতে পারি, আপনি ধরে নিচ্ছেন বা মনে করেন, লেখালেখির মধ্য দিয়ে চিন্তার জগৎ নির্মাণের একটা কাজ হয়। তো এই লেখা তো বিভিন্ন রকমের। এখানে কবিতা ও অন্য লেখার তফাত নিয়ে প্রশ্ন করেছেন- এই তো?
হ্যাঁ, এ প্রশ্নটিই রেখেছি।
রনি : প্রথম কথা হলো, চিন্তার জগতের সঙ্গে লেখালেখির সম্পর্কটা জটিল ও সহজ করে দেখা যায়। কিন্তু এখনকার সময়ে অক্ষর বা প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান চর্চার কারণে আমরা মনে করি, লেখালেখিই বুঝি চিন্তা-ভাবনা করার এক মাত্র ধরন। বিষয়টি তা নয়। আপনি সারা জীবনে এক লাইন না লিখেও চিন্তার জগতে কাজ করতে পারেন। আপনাকে লিখতেই হবে এমন কোনাে কথা নাই। চিন্তার জগতে জটিলতা সামলানোর ক্যাপাসিটি তৈরি করার জন্য একটা সাধনা ও সংগ্রামের দরকার হয়। চিন্তা একটা সিসটেমেটিক জিনিস। মনের যা খুশি কল্পনা আর দার্শনিক অর্থে চিন্তা করা এই দুয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। আপনার প্রশ্নে ফিরি, আপনি লেখেন বা না লেখেন। আপনার মধ্যে একটা ‘পয়েসি’ থাকা দরকার। আর যদি লেখা হয় সেটি যে কোনাে লেখা বা কাজই হোক, এর মধ্যেও একটা ‘পয়েসি’ থাকার ব্যাপার আছে। সেদিক থেকে লেখালেখির যাবতীয় জিনিসের সঙ্গে কবিত্ব শক্তির একটা সম্পর্ক আছে বলতে পারেন। আবার অন্যদিক থেকে কবিতা লেখা আর অন্য যে কোনাে লেখালেখির প্রক্রিয়া এক নয়। কবিতা লেখার প্রক্রিয়া কি তা আমি বলতে পারবাে না। যেহেতু আমি কবিতা লিখি আর কীভাবে সেটি লেখা হয় তা জানি না, কবিতা লেখার চেয়ে কবি হওয়া জরুরি- এটা বলতে পারি। যিনি কবি তিনি বুঝতে পারেন কবিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন। এটা বাইরে থেকে হুবহু বলা মুশকিল। অন্যদিকে আর যেসব লেখালেখি আছে এ জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। একটা সচেতন পরিশ্রমী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজে ‘শিক্ষিত’ করে তুলতে হয়। তবে এর কোনাে ব্যাকরণ নাই। একেকজন লেখক নিজের জন্য কাজের প্রক্রিয়া নিজের মতো করে ঠিক করেন। তবে যে কোনাে লেখালেখিকে একটা সহজাত প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি। যাই লিখি, যে মাধ্যমেই লিখি এতে কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয় না।
সাহিত্যে বিশ্বাস ও বিনোদনের আলাদা দুটি দিক আছে। আবার উদ্দেশ্যমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেও অনেকে লেখালেখি করেন। আপনি কী বলেন?
রনি : বিশ্বাস নানান রকম। ধর্মে বিশ্বাস, জাতীয়তায় বিশ্বাস বা অধর্মে বিশ্বাস। সবই দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত্য কী? সাহিত্যে কী থাকে এটা নিয়ে দুনিয়ায় বহু প্যাঁচাল হয়েছে, হচ্ছে। একেকজন তার আইডিওলজির সাপেক্ষে সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছেন। তবে এই বিষয়ে একটা বই আপনাদের দেখতে বলতে পারি- জ্যাক দেরিদা-র ‘অ্যাক্টস অফ লিটারেচার’। পরে সময় পেলে এটা নিয়ে লিখব। এখন তাত্ত্বিক কচকচানি করতে চাই না। সরলভাবে কিছু কথা বলি। বাদ দেন সাহিত্য। অন্য একটা প্রশ্ন ধরে কথাটা বলি, জীবনের উদ্দেশ্য কী? দেখবেন এটা নিয়েও নানানজনের নানান মত আছে। তবে মোটামুটি দার্শনিকভাবে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আমরা টের পাই। তা হলাে, সত্যের অন্বেষণ। তো সাহিত্যেও লেখকরা জীবনের সত্যকে খুঁজে বেড়ান। আর এর মধ্যে বিশ্বাস-বিনোদন, হিংসা-প্রেম, রাজনৈতিক মতলব- সবই হাজির থাকে। বিশুদ্ধ শিল্প বলে কিছু নাই। যারা মনে করেন তিনি একটা রাজনীতি, ইতিহাস ও সমাজ নিরপেক্ষ শিল্প সৃষ্টি করবেন আর কল্পিত সৌন্দর্যের পূজা করে আরামের সাহিত্যিক জীবন পার করবনে তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। নন্দনতত্ত্বেরও একটা রাজনীতি আছে। এরও একটা ঐতিহাসিক নির্মাণের সিলসিলা আছে। যারা বিশুদ্ধ শিল্প সৃষ্টি করে অমর হইতে চায় তারা স্টুপিড। তথাকথিত ক্ল্যাসিকাল সাহিত্যের যে ধারণা আমাদের এখানে তৈরি হয়েছে তা ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্ট-এর হাত ধরে এসেছে। ওই ইউরোপিয়ান আলোকায়ন প্রকল্পই এখন মরণদশায় পৌঁছে গেছে। তাই এটার আর খাওয়া নাই।
অন্যদিকে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে দলীয় প্রচার বা একটি বিশেষ মতাদর্শের প্রচারের কাজ করা শুরু হলে তাও বিরক্তিকর হয়। ওই যে সত্য। সাহিত্যের মধ্যে এই মুক্ত সত্যের ইশারা থাকতে হয়। এ জন্য খোঁজাখুঁজির একটা আয়োজন থাকতে হয়। আমিও জ্যাক দেরিদার মতো সাহিত্যকে ফ্রি প্লে মনে করি। এটা একটা মুক্ত খেলা। তা জীবনকে নানাভাবে আবিষ্কারের চেষ্টায় রত থাকে। আমরা সব আবিষ্কার করে ফেলেছি বা ফেলবাে হয়তাে। তবুও যা আবষ্কোরের অবিরম সংগ্রাম বাকি থাকবে তা হলাে, এই মানব জীবন। আর সাম্প্রতিক চিন্তা-দর্শন বা মতাদর্শের লড়াই ও পার্থক্য এত পরিষ্কার যে, সাহিত্যিককে আদি জীবনের হদিস করতে অনেক বেগ পেতে হয়। লিখতে এসে তথাকথিত চলতি ফ্যাশন বা মেইন স্ট্রিম মতাদর্শ দ্বারা লেখক পরিচালিত হতে থাকেন। সন্ত্রাসকেই চেতনা বলে পূজা করতে থাকেন। তাই সাহিত্য জিনিসটা মোটেও মহান বা পূত-পবিত্র নয়। এর রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দিক আছে। আমি অন্য বিষয়ের মতােই এটাকেও যথেষ্ট ক্রিটকালি দেখতে চাই। দেখেন, আমাদের এখানে নতুন লেখকরা প্রথমেই যেই ফাপড় ফেস করেন তা হলাে, তিনি যে অরগানিক ক্যাপাসিটি নিয়ে সাহিত্য শুরু করেন তা তাকে বিসর্জন দিতে হয়। তাকে তথাকথিত মূলধারার নকশা রপ্ত করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে তার ইনোসেন্সির বিনাশ সাধিত হয়। তিনি একটা চালু মানদণ্ড ধরে আগাতে গিয়ে নিজের প্রতি অনেক সময় সৎ থাকতে পারেন না। তখন তার জন্য অন্যের প্রয়োজনে ভাড়া খাটা সহজ হয়। মিডিয়ার মাধ্যমে তখন এটাকেই প্রধান ধারা বলে প্রচার করা হয়। এভাবে একজন লেখক হীনম্মন্য কেরানিতে পরিণত হন। তবে কোনাে লেখক নিজে জেনে-বুঝে যদি কোনাে পজিশন নেন তাহলে সেটি নিতেই পারেন। কিন্তু মুখে নিরপেক্ষ আর আদর্শে ফ্যাসিবাদী বা প্রগতিবাদী- এটা একটা হারামিপনা। এই আত্মপ্রচার এবং ভোগ ও বিজ্ঞাপনের যুগে মূল কথা হলো, সততার জন্য নিজের ভেতরে সংগ্রাম জারি রাখা এবং নিজের ইনোসেন্সিকে রক্ষা করাই একজন লেখকের সবচেয়ে কঠিন ও জরুরি দায়িত্ব।
এমন কিছু কী আছে যে, আপনি লিখতে চাননি কিন্তু লেখা হয়ে গেছে!
রনি : হাঃ হাঃ, হাঃ। নাহ, মনে হয় না। লিখতে বিরক্ত ফিল করি এমনিতেই। তবে কবিতার কথা বললে বলবাে, কবিতাটা লেখা শেষ হওয়ার আগে জানিই না আসলে কী লেখা হচ্ছে। এমনিতে অন্য যে লেখালেখি করি তা মোটামুটি একটা পরিকল্পনার মধ্যেই করি। অনেক সময় আড্ডাবাজি ও গল্প করে দিন পার করে দিই। লিখতে ইচ্ছা করে বাট লিখি না। আর ইচ্ছা করে না কিন্তু লিখব- প্রশ্নই ওঠে না। আমার ওই অর্থে বাজারও তৈরি হয় নাই। হলে ভালাে হতাে। তখন লিখবাে কি না জানি না। তবে লিখি বা না লিখি সব সময় লেখালেখিজনিত বিষয়-আশয় নিয়েই থাকি।
কেন লেখালেখিতে এলেন? লেখালেখিতে এসেই কবিতা লিখছেন, নাকি কবিতাই আপনাকে লেখালেখিতে টেনে এনেছে?
রনি : কেন লেখালেখিতে আসছি এর কোনো সহজ উত্তর নাই বা আমি তো শুধু লেখালেখি করি না। অন্য আট-দশজন যা করেন আমি এর সবই করি। চাকরি করেছি। এখন নিজের মাছের খামার নিয়ে ব্যস্ত থাকি। সামাজিক ও পারিবারিক সব দায়িত্বও পালন করি। লেখালেখিটা আমার কাছে বিশেষ কোনাে কাজ নয়। আমি লেখক বলে চরম উদাস হয়ে ভাবে গদ গদ থাকার কিছু নাই। এটা আমার জীবন যাপনেরই অংশ। তাই খুব পরিকল্পনা করে লেখালেখি শুরু করি নাই। সহজাতভাবে লিখি। শুরুতে এটা বলতে পারি, যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি তখন নজরুল মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। তবে লেখক হতে চাই নাই। ছোট ছোট গল্প লিখতাম। জারিগানে যা শুনতাম সেগুলো নিজে নিজে লিখতাম। নিজের মতো করে চরিত্র বসিয়ে দিতাম। ছড়া লিখতাম। তবে সবই পুরনাে বইয়ের সঙ্গে বেচা হয়ে যেত। পোলাপান যেমন লেখে আর কী!
নাহ, শুধু কবিতা দিয়ে শুরু করি নাই। শুরু থেকেই কবিতা ও গদ্য একই সঙ্গে চর্চা করি। আর কবিতা কখনো পরিকল্পনা করে লিখি না। কবিতা মাথায় চলে আসে। যে কোনাে জায়গায় লিখে ফেলি বা অলসতা করে অনেক সময় লিখি না। এখনো আম্মা খালি কাগজের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কবিতা ঝেড়ে ফেলে দেন। নিজের লেখালেখিকে এখনো বিশাল কর্ম বলে দেখি না। সহজ-সরলভাবে যা হয় হবে। না হলে নাই। কবিতার বানান ছাড়া তেমন এডিটও করি না। আসলে যখন বুঝেছি হৃদয়ের মধ্যে কবিত্ব বিরাজ করে তখনই কবিতার বিষয়ে মনোযোগী হয়েছি। অপেক্ষা করেছি কখন আমার কবিতা আমাকে দিয়ে লেখানো হবে। এরপরে সরাসরি বই বের হয়েছে পাঠকদেরই চাপে। পাঠক দেখি পড়ছেন। এই তো। আর অন্য লেখালেখির জন্য প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে নিজেকে তৈরি করেছি বলতে পারেন। যে ধরনের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করি তা সংগ্রহ করাও কষ্টকর কাজ। এখন তো কিনডেল ও ক্রেডিট কার্ড থাকায় ব্যাপারটি সহজ হয়ে গেছে। এক সময় বইয়ের জন্য কতাে জায়গায় যে ঘুরেছি! তবে সব বই পড়ে হয় না। অনেক মানুষের সঙ্গে, অনেক জ্ঞানীদের সঙ্গে সঙ্গ তৈরি করতে হয়েছে। এখনো সব সময় শেখার জন্য মুখিয়ে থাকি।
সাহিত্য জিনিসটা মোটেও মহান বা পূত-পবিত্র নয়। এর রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দিক আছে। অন্য বিষয়ের মতােই এটাও যথেষ্ট ক্রিটকোলি দেখতে চাই। দেখেন, আমাদের এখানে নতুন লেখকরা প্রথমেই যেই ফাপড় ফেস করেন তা হলাে, তিনি যে অরগানিক ক্যাপাসিটি নিয়ে সাহিত্য শুরু করেন তা তাকে বিসর্জন দিতে হয়। তাকে তথাকথিত মূলধারার নকশা রপ্ত করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে তার ইনোসেন্সির বিনাশ সাধিত হয়। তিনি একটা চালু মানদণ্ড ধরে আগাতে গিয়ে নিজের প্রতি অনেক সময় সৎ থাকতে পারেন না। তখন তার জন্য অন্যের প্রয়োজনে ভাড়া খাটা সহজ হয়। মিডিয়ার মাধ্যমে তখন এটাকেই প্রধান ধারা বলে প্রচার করা হয়। এভাবে কোনো লেখক হীনম্মন্য কেরানিতে পরিণত হন
ব্যক্তিগত সৌজন্য বোধ- এটা এক রকম এমন যে, আমাদের ইচ্ছা না থাকলেও অনেক সময় বজাই রাখি। শিল্পের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনাে চাপানো দায় থাকে কি না? ওই শিল্প নিয়ে কোনাে কথা হতে পারে?
রনি : শিল্পে ভণিতার একটা ব্যাপার থাকে। শিল্পী বা সাহিত্যিক অনেক সময় এটার আশ্রয় নেন। তবে ওই ভণিতা অপছন্দ করি। আমার এটার দরকার হয় না। এমনকি এখনকার কিছু পোলাপান নাটকীয়তার ভঙ্গিতে গল্প লিখেই কবি হিসেবে পরিতৃপ্ত। এগুলো এড়ায়ে যাই। কেউ যদি মনে করে সে খুব চতুরী করে কোনাে কাজ করবে তাহলে সে আসলে নিজেকে বোকা বানানো ছাড়া আর তেমন কিছু হাসিল করতে পারবে না। সাহিত্যে লেখকের সঙ্গে অপর সত্তার যে সম্পর্ক তৈরি হয় এতে সত্যকে উপেক্ষা করলে পরিণাম হয় ভয়াবহ। সাহিত্যের কোনাে চাপানো দায় থাকে না। লেখক নিজেকে নিজে দায়িত্ব দেন এবং যে যেমন সত্তা ধারণ করেন তেমন সাহিত্যই তার হাতে তৈরি হবে। আপনি ভণিতা করে কিছু সময় পাবলিককে বোকা বানাতে পারেন বাট মুনাফেকি প্রকাশ হয়ে পড়তে বাধ্য। আমাদের জীবনের অন্যতম প্রধান লড়াই হলো সরল হওয়া, জটিল হওয়ার মধ্যে কোনাে ফায়দা নাই। এতে অন্তরের শান্তি নষ্ট হয়। এটা আমাদের সাহিত্যিকরা কেন বােঝনে না তা বুঝে পাই না। আর ব্যক্তিগত সৌজন্য বোধ তো এটা না যে, আপনি একটা জিনিস অপছন্দ করেন কিন্তু দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে তাকে খুশি করবেন আর পেছনে গালি দেবেন। সামনাসামনি সব খোলাসা করে দেয়াই সৌজন্যতা। গালি দিলে সামনেই দেন। আমি যেমন দিই। আমার ধারণা, কিছু ফটকা লোক বাদে পাবলিক আমাকে এ জন্যই খুব বেশি অপছন্দ করে না।
এটাও একটা জিনিস যে, আমার বেঁচে থাকার মধ্যে কবিতা আছে আর এই বেঁচে থাকাটা থেকেই কোনো কবিতা লেখার চেষ্টা করি। এমন নয় যে, আজই একটা ঘটনা ঘটলাে আর লিখলাম। যে ঘটনাগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মনের মধ্যে তা থেকেই কবিতা লেখা হয়। এ বিষয়টাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রনি : আগেও এটা নিয়ে একটু কথা হয়েছে। কবিতা লিখতে গিয়ে আপনি যদি জেনে যান কী লিখবেন তা কবিতা না হয়ে হবে কবিতার কঙ্কাল- ডেরেট ওয়ালকট এমন একটি কথা বলেছিলেন। আপনি কীভাবে বেঁচে আছেন তা আপনি পুরোপুরি জানেন না। কিন্তু জানেন যে, বেঁচে আছেন। তেমনি কবিতাও। আপনি জানেন, কবিতা বলে একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু কবিতায় ‘কবিতা’ কীভাবে আছে তা আপনি পুরোপুরি জানেন না। কবিতা নিয়ে আমার বেশকিছু লেখা আছে যেখানে ওইসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তবে এখানে এটাই বলবাে, নিজেকে সব সময় শিশুর মতাে উন্মুক্ত রাখি যাতে কবিতার ব্যাপারটা আমার জীবনে স্বাধীন মতাে ঘটতে পারে। সব কবিতা লিখবাে- এমনটা চাই না। অবশ্য কবিতার ওই হাজিরাটা থাকুক জীবনে যা লিখতে পারি লিখব। কেউ পড়লে পড়বেন, না পড়লে না-ই। তবে আধুনিককালে কবিতার নামে যে অত্যাচার শুরু হয়েছে তা থেকে দূরে থাকি। নিজের মনের বিকার ও কল্পনাকেই কবিতার জন্য যারা যথেষ্ট মনে করেন এবং এটা লিখেই ফালাফালি করেন তারা নিজেকে প্রতারণা ও অন্যকে প্রতারিত করেন। কবিতা নিয়ে ফালাফালির কিছু নাই। এটা হলাে ওই পরিষ্কার পুকুরের মতো আপনার মনকে ধোয়ার জন্য যার কাছে আপনাকে যেতে হবে। এই পুকুরের পানি নোংরা হলে মশা-মাছি ভন ভন করবে। কবি ছুটবেন পুরস্কারের জন্য বা দালালি করবে অবৈধ ক্ষমতার।
একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনায় আনতে চান। তা হলো, মেইন স্ট্রিম সাহিত্য বলতে বর্তমান সময়ের সাহিত্য বোদ্ধারা কী বােঝাতে চান? সমাজের প্রচলিত ধারার সঙ্গে এর যোগসূত্রটা কী হতে পারে?
রনি : মেইন স্ট্রিম সাহিত্য বলে কিছু নাই। কথাটা পরষ্কির করে বলি, কোনাে দেশ বা সমাজে একটা কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়। ওই ইন্ডাস্ট্রি নিজেদের প্রয়োজনে কিছু লোকও তৈরি করে। মিডিয়া, ক্ষমতা- এসবের সমন্বয়ে একটা ফাংশন করে। এখন আমাদের দেশের বেশির ভাগ লেখক যেহেতু ফকিন্নি মানসিকতার, নিজের কলিজার জোর নাই, সততার সঙ্গে ফাইট করার সাহস নাই সেহেতু ওইসব প্রতিষ্ঠানের সেবকে পরিণত হন তারা। আর এই সেবা-দাসীদেরই বেশি বেশি মিডিয়ায় দেখা যায়। এতে তরুণ লেখকরা মনে করেন, তারাই বুঝি লেখক। তারাই বুঝি সাহিত্যের মা-বাপ। তারাই বুঝি সফল। তবে এখন মিডিয়ার এই একচেটিয়া মাস্তানি আর নাই। সোশ্যাল মিডিয়া এটা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। আগে সাহিত্য সম্পাদকরা এমন ভাব নিতেন যে, নতুন যারা লিখতে আসতো তারা খুব অসহায় হয়ে থাকতাে। এখন ওইদিন নাই। আমার ক্যাপাসিটি থাকলে আমিই মেই স্ট্রিম। তবে যেটা সব সময় করি তা হলাে, এই যে মূলধারা বলে কলোনিয়াল হীম্মেন্যতার চর্চা এটাকে এখানে জোরালো করা হচ্ছে- এর বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ফাইট জারি রাখি। এই যে মেইন স্টম নামধারী সাহিত্যিককুল- এরা তো কালো চামড়ার ইংরেজ অথবা ক্রমনিক মানসিকতার আঁতুড়ঘর। তারা বাংলাদেশের জনচৈতন্যের শত্রু। তারা একটা হাইব্রিড সেকুলার পজিশনকে ধর্মের মতো মান্য করে, মানদণ্ড মনে করে। সমাজের অন্যপ্রান্ত বা প্রান্তিক বলেন বা ভিন্ন চিন্তার মানুষ বলেন, তাদের প্রতি হিংসা ও ঘৃণা লালন করে। তারা উন্মাদ ক্ষমতার পূজারি। তারা জনগণের কাছে অভিশপ্ত ও জ্ঞানপাপী হিসেবে পরিচিত। একটা মধ্যবিত্ত পরিসরের মধ্যে তারা নিজেদের মহান করে তুলতে চায়। এ জন্য যা যা প্রয়োজন এর সঙ্গে আপস করে বেঁচে থাকে। ওই লেখকদের পাত্তা দেয়ার কিছু নাই। তবে এটা একটা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের দেশে। এটা সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে আছে। এটা একটা ইউরোসেন্ট্রিক মানসিকতা। কতিপয় লোকের নিজেদের সব সময় সবকিছুর কেন্দ্রে ভাবার অসুখ এ দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশে একটা জীবন্ত বাধা। এই বিষয়ে একটা লেখা লিখছি ‘হোয়াট ইজ মেইন স্ট্রম’ নামে। এটা বাংলা করে ছাপাবো।
সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক কী? সমাজিক উন্নয়নে সাহিত্য কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে? লেখকের ধরন কেমন হবে?
রনি : সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে। এই ধরনের প্রশ্ন অবশ্য বামপন্থী পজিশন থেকে বেশি আসে। আমাদের বামরা সমাজ নিয়ে বেশি ভাবেন এবং সব সময় ‘সমাজ’ বিরোধী নীতি-নৈতিকতার চর্চাই করেন। যাক, এ কথা। সমাজের সঙ্গে সহিত্যের আগবাড়িয়ে সম্পর্ক রাখার কোনাে দায় নাই। আপনি না চাইলেও সাহিত্যে সমাজ হাজির থাকবে, থাকে। সাহিত্য কী নিয়ে কাজ করে এটা বুঝলেই আর এই ধরনের প্রশ্ন আমাদের ফেস করতে হবে না। বাংলাদেশের সাহিত্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে বামপন্থী ইতরগুলো। আরও গোঁড়ায় প্রশ্ন করতে পারেন, কোনো কিছু কেন ‘সাহিত্য’ হয়? সাহিত্য বলে এই যে আলাদা ক্যাটাগরি করা এরও একটা রাজনীতি আছে। সাহিত্য ও নন-সাহিত্য বলে একটা ক্যাটাগরি তৈরি করার মধ্য দিয়ে কালচারাল জগতে একটা হেজিমনি বা আধিপত্য তৈরির প্রচেষ্টা জারি আছে। এটা নিয়ে গায়ত্রী স্পিভাক তার ‘ডেথ অফ ডিসিপ্লিন’ লেখায় বেশ দরকারি আলাপ তুলেছেন। ওইসবের একটা ইডিওলজিকাল পজিশন আছে। সমাজের যারা সবকিছুকে লেবেলিং করে, যারা মনে করে তাদের সিলেকশনই শেষ কথা তারাই দেখবেন ঠিক করে দেবে এটা সাহিত্য আর এটা সাহিত্য নয় এবং এ জন্য যে ধরনের যুক্তিগুলো পেশ করা হবে তা গভীর অশিক্ষা থেকে উৎপন্ন। কাজেই এই যে নেইমিং বা নামকরণের রাজনীতি এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে হবে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কোনাে গ্রুপকে সাহিত্য কী এটা ঠিক করে দেয়ার এখতিয়ার দেয়ার দরকার নাই। একজন আক্কেলমন রাইটার এটা অবশ্যই বােঝেন। তো এদিব থেকে সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কটা সরাসরি ও জটিল।
এখানে প্রশ্ন করতে পারেন, কোন সমাজ? একটা দেশের সমাজের বহু স্তর বা পর্ব থাকে, বহু ভিন্নতা থাকে। ওই অনুযায়ী লেখকও তারা তৈরি বা প্রেট্রোনাইজ করেন। ফলে বড় মিডিয়া আর ক্ষমতার কাছে যে আছে তাকেই লেখক মনে করার কোনাে কারণ নাই। সে হলাে যাত্রা দলের হিরোর মতো। মঞ্চ ও লাইট সরে গেলে তারে কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। যতক্ষণ তার ওপর আলো ধরা আছে ততক্ষণ সে ঝিলিক দেখাবে, আলো নেভালে সব শেষ।তোর কোনাে অরগানিক ক্যাপাসিটি নাই। এই ধরনের লেখকরাও তাদের সাহিত্য সমাজের ক্ষতির কারণ হয়। শাহবাগের পর আমরা একদল লেখকদের চিনেছি। আজ তাদের শাহবাগের পরাজিত শক্তি বলে চিহ্নিত করি। তারা নিজের কলমকে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর আদর্শ প্রচারের জন্য ব্যবহার করে। তবে কোনো লেখক তার কৌমের চিন্তা ও কল্পনার ভাষ্যকার হতে পারেন। কিন্তু যে ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর দিয়ে একটা বিশেষ শ্রেণি অন্য সব শ্রেণির প্রতি অত্যাচার জারি রাখেন ওইসব জালেমের সঙ্গে লেখক যখন আঁতাত করেন তখন জনগণের ঘৃণাই তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে। আমাদের এখনকার বেশির ভাগ লেখকদের বেলায় যেটা ঘটেছে। তাই লেখক বলেন, কবি বলেন আর সাধারণ মানুষ বলেন, একটা কমন নৈতিক ভ্যালু তার মধ্যে থাকতে হবে। একচোখা হলে হবে না। না হলে উপকারের বদলে ক্ষতিও হতে পারে তাদের দ্বারা।
যাহোক, সাহিত্য জীবনের ভেতর থেকেই তৈরি হয়। লাইফ হলো এর সোর্সপ্রধান। আর সমাজও ওই জীবিত মানুষজনকে নিয়েই। অবশ্য এর মধ্যে মৃত ব্যক্তিরাও হাজির থাকেন। তাদের জন্যও সমাজের কিছু করণীয় থেকে যায়। এরপরও জীবনই সমাজের প্রাণ। মানুষ বলি নাই, বলেছি জীবন। মানে, আরো প্রাণীও আছে। কাজেই ওই দুয়ের সম্পর্ক আছে। তবে তা সমাজভেদে ভিন্ন হয়। জেলোপাড়ার যে গান আর বড়লোকের মদের পার্টিতে যে গান বা বাজারের যে কবিতা ও শহরের আধুনিক যে কবিতা এর মধ্যে পার্থক্য আছে। একদল ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের জোরে সবপ্রান্তের ওইসব জিনিসকে সাহিত্য বলেই স্বীকার করবে না। তবে প্রতিটি সমাজেই যার যার মতো করে শিল্প ও সাহিত্যের আয়োজন অনেক আগে থেকেই জারি আছে। এটা সমাজের জন্য একই সঙ্গে একটি স্পিরিচুয়াল উইনডো হিসেবে কাজ করে। অবশ্য সেকুলাররা সন্ত্রাসী কায়দায় ওইসব নিয়ন্ত্রণ করে। সবকিছুকে লেবেলিং করে নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করতে খুবই তৎপর। একদল অন্য দলকে দাবিয়ে রেখে নিজেদের একমাত্র সাহিত্য ও শিল্পের প্রতিনিধি মনে করতে পছন্দ করে। এই জন্য শিল্প, রস, নন্দন, মান, বোধ, দায়বদ্ধতা- এসবের নামে কিছু স্কেলও তারা আমদানি করে। আসল লেখকের কাজ হলাে, এই হেজিমনিক রিলেশনশিপটাই সবার আগে ধসিয়ে দেয়া। এই হলাে ব্যাপার।
ফেসবুকসহ বর্তমানে নানান সামাজিক মাধ্যম ও ব্লগগুলো কেন্দ্র করে নতুন লেখক সৃষ্টি হচ্ছে। সংখ্যার দিক থেকেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করার মতাে। নানান বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছেন, নানান ছকে আগাচ্ছেন। এই যে, এত লেখক আদৌ প্রয়োজন আছে কি না? তারা কেন লিখছেন? ওই লেখকদের ভবিষ্যৎ কী?
রনি : ফেসবুক নিয়ে একটা মজার কথা বলেছিলাম একবার। এটা হলাে, ওইসব ড্রাগের মতো যা আপনি ওষুধ এবং নেশা দুই অর্থেই ব্যবহার করতে পারেন। ভার্চুয়াল জগৎ একটা ফলস আইডেনটিটি তৈরি করে অনেক সময়। অনেকটা ইমিটেশনাল আর কী! আসল কথা হলাে, কেউ যদি লেখক হতে চান তাহলে এ জন্য তিনিই নিজের কাজ নির্ধারণ করবেন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, আমরা চাইতেছি লেখক, পাচ্ছি ফেসবুকার। ফেসবুকের চটজলদি ফেনাটিক পপুলারিটির দিকে তাকিয়ে যারা লেখালেখি করেন তারা শেষ পর্যন্ত হতাশ করেন এবং নিজেরাও হতাশ হন। লেখক আর ফেসবুকারের মধ্যে যে চিকন ফারাকটা আছে, তা মনে রাখলে কিছু সুবিধা হতে পারে। আগে যেটা বলেছি, আধুনিক, মেকানিক্যাল দুনিয়ায় লেখকের কয়েকটি ইনার লড়াই থাকে। এগুলো বুঝতে হবে। কবি-সাহিত্যিকরা যখন নিজের অহঙ্কার, ইগো ও ব্যক্তিবিকার থেকে নারসিস্টিক আরচণ করেন তখন তা হাস্যকর হয়ে ওঠে। অনেকে সহজে তারকা হওয়ার জন্য এমনটা করছেন ফেসবুকে। নাম নয়, নিজেদের কিছু লাইকার ও বন্ধু তৈরি করে অনেকেই নিজেকে এ জমানার শ্রেষ্ঠ কবি-বুদ্ধিজীবী ঘোষণা করছেন ফেসবুকে। তারা যে দিন দিন অশিক্ষিত থেকে অশিক্ষিততর ও হাস্যকর প্রাণীতে পরিণত হচ্ছেন তা বুঝতে পারছেন না । তবে ফেসবুক বা ওই ধরনের কম খরচের স্বনিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকে ব্যবহার করতে পারলে একটা কাজেরও হতে পারে। এত লেখকের প্রয়োজন আছে কি না এটা আমার বলা ঠিক হবে না। আমার তো মনে হয়, বাংলাদেশে লেখক খুবই কম। দেশের বাংলা-ইংরেজি বড় বড় কাগজে কাজ করেছি নতুন লেখক খুঁজতে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ই হতাশ হই। মুরুব্বি কয়েক রাইটার ছাড়া গুছায়া একটা পলিটিকাল কলাম লিখতে পারেন এমন তরুণ রাইটার তো পাই না। জবান-এর জন্য অনেকে লেখা পাঠান। খুব কম লেখাই ছাপতে পারি। তবে লেখক লেখক ভাব ধরে বেশ আত্মতৃপ্তিতে থাকেন অনেকে। কাজের কাজ নাই, শেখার মেহনতও নাই।
লেখকদের বিকাশের একটা বড় বাধা হলো, গোঁয়ারের মতো ইগো। নিজেরে বিশিষ্ট মনে করা একটা অসুখ। এটা আমাদের এখানে আছে। ফেসবুকের কারণে এটা আরো চাউর হচ্ছে। আমি যেটা বলতে পারি, অলেখকের লেখক সুলভ হম্বি-তম্বি বিরক্তিকর। অনেকে মনে করেন, লেখক হওয়া বুঝি একটা মহান তারকা টাইপের ব্যাপার। আর এ জন্য ব্লগ, ফেসবুককে নিজের মনের হাবিজাবি ভাব প্রকাশের একটা সহজ মাধ্যমে পরিণত করে ফেলেন। তখন তারা লেখক না হয়ে হয়ে ওঠেন একটা ফেনাকিট ফেসবুকার বা গণবিরোধী ব্লগার। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় ফেইক ইমেজ তৈরির কসরত দেখা যায়। একটা ইমিডিয়েট ব্যক্তিত্ব তৈরি করার চেষ্টা দেখি। লেখালেখির জন্য ওইসব মাধ্যমকে একচেটিয়া ব্যবহার করি না। অবশ্যই ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি। তবে এটা মাঝে মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে। কোনো লেখক যদি প্রকৃতই লেখক হয়ে উঠতে পারেন তাহলে তার জন্য মাধ্যম কোনাে ইস্যু নয়। আর হৃদয়ের গভীরে লেখক না হয়েও লেখক ও সংস্কৃতিজীবী হিসেবে পারফর্ম করার ধান্দা থাকলে প্রতিদিন ১০ ড্রাম তৈল মর্দন করে বা নেশা সেবন করেও লাভ হবে না। শাহবাগ ও ঢাবির ছবির হাটে এমন অনেক রোগী দেখা যায়। তারা সংস্কৃতিকর্ম করতে এসে ‘কলচারাল’ শক খেয়ে উন্মাদের মতো ঘােরাঘুরি করে দিন পার করেন। আর হাব-ভাব, চলন-বলন এবং মনে মনে ভাবেন, তিনি একটা মহান প্রতিভা। কিন্তু পাবলিক খালি হেরে চিনতেছে না। এই দুঃখে দেখা যাচ্ছে নেশার ডোজ বেড়ে যায়। একটু বামপন্থা, একটু ‘৭১-এর চেতনা, দুই ছটাক প্রগতীশীলতা- এসব মিলে এক হাস্যকর অবস্থা। কোনো লেখককে প্রথমে লেখক হতে হবে। এরপর সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইন্ডাস্ট্রিটা বুঝে ফাংশন করতে হবে। তখন ভবিষ্যৎ আর আমার আগাম বলতে হবে না, তিনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। যদি দেশের বাইরে তাকাই, বিশেষ করে আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোয় কী ধরনের সাহিত্য সমাদৃত কিংবা আরেকটু কাছ থেকে বলতে গেলে গ্লোবাল কন্ডিশনে আমাদের লেখকদের দায়িত্ব কী? তাদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বাওঝা-পড়াটাও কি আমাদের সাহিত্যে প্রয়োজনীয় প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
রনি : ভালাে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে নিজের দেশ, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে একটা অন্ধ অহঙ্কার আছে। দেখবেন, শামসুর রাহমানকে সবাই মিলে আকাশে তোলার মিশন নিয়েছেন। তার কবিতা অনুবাদ করে বাইরে পাঠকদের দেন- তারা বলবেন, এসব লেখা তো আমাদের ইউরোপের কবিরা ১৯ শতকে প্রচুর লিখে গেছেন। আর এটাই আমাদের দেশে মূলধারা বলে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা বাইরে পশ্চাৎপদ এবং কোনাে মূল্য পাবে না। লালনের গান, জলালউদ্দিনের গান বা কোনাে পালাগান আপনি অনুবাদ করেন বা অন্যদিকে আল মাহমুদের দিকে দেখেন। তার কবিতা বিদেশিরা পড়তে চান। কারণ তিনি বাংলার আদি টোনটা ধরতে চেয়েছেন। তিনি যেহেতু ইসলামের সিম্বল ধারণ করেন, মুসলমান পরিচয়ের ভেতর ফাংশন করেন সেহেতু তাকে এই বৃদ্ধ বয়সেও অপমান করা হয়। অবশ্য আল মাহমুদের নান্দনিক চয়েজ সংস্কৃতি সাহিত্যজাত- এটা নিয়ে আমার ক্রিটিক আছে। সেটি অন্য কথা। যাক, যেটা বলছিলাম- নিজের সবকিছুর প্রতি দরদ থাকা অন্যায় নয়। তাই বলে নিজেদের অযোগ্যতা ও মূর্খতাকেও উন্নতি বলে চালানোর হুজুগ এক ধরনের ক্রাইম। এই ক্রাইম এখন জাতীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের লেখকরা মোটা দাগে ক্যালকেশিয়ান-কলোনিয়াল মানসিকতার দাস। এটিকে আমি বলি ‘সাবলেট কলোনিয়ালজিম’। ১৯ শতকে কলকাতার যে তথাকথিত রেনেসাঁ তা একটা ইউরোপিয়ান অসুখ। ওই নকল কলকাতার নকল হচ্ছে আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলরা। আর সাহিত্যিকরা এই প্রগতিশীলতার দাসে পরিণত হয়েছেন। সম্প্রতি এর সঙ্গে হাইব্রিড মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যুক্ত হয়ে শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। শাহবাগ, একুশের গ্রন্থ মেলা- এসব পুঁজি করেই টিকে আছেন কতিপয় লেখক। আদতে তাদের সাহিত্য বাজার যেমন বিকশিত হয়নি তেমনি লেখকরাও শিক্ষিত হয় নাই। আপনি যদি পাকিস্তান বা ভারতের লেখকদের দিকে তাকান, তাদের বাজারের দিকে দেখেন তাহলে শাহবাগি কবি-সাহিত্যিকদের অস্থির অহঙ্কার দেখে হাসি পাবে। তাদের কেউ গোনেন না আসলে। সাহিত্য বা শিল্প তো একটা গ্লোবাল বাজার ধরার কথা। হারুকি মুরাকামি তো জাপানের গল্পই বলেন, খালিদ হোসাইনি বা মহসিন হামিদ তো পাকিস্তানের গল্পই বলেন, আগা শাহিদ আলি তো কাশ্মীরের কবিই। তাহলে সারা দুনিয়ার মানুষ কেন পড়েন তাদের? তাদের কোন ক্যাপাসিটি তাদের একই সঙ্গে লোকাল ও গ্লোবাল করে তােলে? এদিকে আমাদের লেখকদের কোনাে মনোযোগ নাই। ক্যাপাসিটি তৈরি করার কোনাে চেষ্টাও নাই। অন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের লেখকদের কেউ পাত্তা দনে না। যেসব উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে এর বেশির ভাগই এনজিও সাহিত্য। তারা চিন্তা ও আইডিয়ার দিক থেকে আসলেই পশ্চাৎপদ। তবে আগামী দিনের লেখকরা ওই খোঁয়াড় ভেঙে বের হতে না পারলে বিপদ আছে। কারণ এই চেতনার বাজার শেষ হওয়ার পথে। এই ক্ষুদ্রবাজারও ধসে যাচ্ছে। এর মতাদর্শিক কোনাে লেজিটিমেসি আর থাকবে না। তাই আপনাকে বড় মাঠে খেলার দম অর্জন করতে হবে। নইলে নিজে নিজেই মহান লেখক ও সংস্কৃতিজীবী হয়ে জাদুঘরে চলে যাবেন।
আপনার মতে সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা কী? আপনি কি মনে করেন মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে এ দেশের প্রতিটি মুসলিম কবির ইসলাম নিয়ে লেখা ও ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু হলে তা নিয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে? আমার ধর্মের পক্ষে আমি প্রতিবাদী হলে তা কি সাম্প্রদায়িকতা?
রনি : সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের দেশে যেসব কথাবার্তা বলা হয় তা ১৯ শতকের চিন্তার পরিসরে দাঁড়িয়ে। আমি এটা নিয়ে অনেকবার লিখেছি। প্রথম কথা হলাে, তারা যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কার করেন ওই অর্থে সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু নাই। অন্যদিকে ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনাে সম্পর্ক নাই। কতিপয় অশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মনে করেন, ধর্ম বা বিশেষ করে ইসলাম মানেই সাম্প্রদায়িকতা। ইসলামের বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকায় যে ধরনের ইসলামোফোবিক আচরণ ডেভেলপ করেছে একই ধেনের মানসকিতা আমাদের এখানকার মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছে। তারাই ‘৭১-কে একই সঙ্গে পাকিস্তানি ও একটা ইসলাম বিরোধী সংগ্রাম মনে করেন। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া যখন ১৬ ডিসেম্বরকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের বিজয় দিবস বলে প্রচার করে তখন মুখে কোনাে কথা ফোটে না। সাম্প্রদায়িকতার রেটরিকটা সেকুলার নামধারী এখানকার ইসলামোফোবিকদের কমন বচনে পরিণত হয়েছে।
যে কোনাে ধর্মের লোক অবশ্যই তার ধর্মের পক্ষে থাকবেন- এটাই স্বাভাবিক। লেখক বা অলেখক বলে কোনাে কথা নাই। এখন ধর্মের ইডিওলজির ভিন্নতার ভেতর দিয়ে যদি কোনাে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয় (সেটি হতেই পারে) তাহলে সেটি তো কোনােভাবেই সাম্প্রদায়িকতানেয়। এটা ধর্মযুদ্ধ। পৃথিবীর বহু দেশে এটা চলছে। সাম্প্রদায়িকতা একটা কমন ব্যাপার। তা প্রতিটি কমিউনিটির মধ্যে থাকে এবং এটা থাকায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। আমাদের দরকার হচ্ছে কোন কমিউনিটির মধ্যে চর্চিত কোন মতাদর্শ কখন ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে তা বুঝতে পারা। খোলাসা করে বলি, ধরেন, ইসলামের নামে বা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের নামে তো অস্ত্রধারী গ্রুপ আছে। আবার অসংখ্য লোক আছে- তারা ওইসব কমিউনিটির সদস্য। কিন্তু অস্ত্রধারী নয়। এখন ওই অস্ত্রধারীরা কী চিন্তা ও মতাদর্শের বলে তাদের কমিউনিটিকে লিড দিতে চায় তা বুঝতে পারা হলাে কাজের কাজ। এছাড়া ওইসব অস্ত্রওয়ালা গ্রুপের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সম্পর্ক কী তাও নজরে রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা সাম্প্রদায়িকতা বলে আহাম্মকের মতো চিৎকার করে লাভ নাই। ওই তর্কটা যেভাবে ফেস করি, সংক্ষেপে এর একটা আউট লাইন দিই- কোনাে জনগোষ্ঠীর প্রধান কর্তব্য হলাে রাজনৈতিক কনিউনিটি আকারে নিজেদের তৈরি করা। এটা বামরাও বলেন। তা না হলে পলিটকাল কমিউনিটি তো আর হাওয়া থেকে হবে না! এ জন্য তো মতাদর্শ লাগে। ওই আদর্শ ধর্ম বা অধর্ম- যাই হোক। তাইলে ওই আদর্শ নিয়ে যখন কোনাে গ্রুপ তার শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখন সেটি সাম্প্রদায়িকতা কেন হবে? বরং এটা তো তার করারই কথা। কাজেই বুদ্ধিজীবীদের যে মুখস্থ অনুমান রাষ্ট্র বা একটি কমিউনিটির সবাই খালি গান গাইবে আর ডুগডুগি বাজাবে তা তো কল্পনা। বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী বেনেডিট এন্ডারসন এটা ভালােভাবে ডিল করেছেন। তিনি বলেছেন, কমিউনিটি মানে ‘ইমাজিন কমিউনিটি’। তো ওই কমিউনিটি হয়ে ওঠাই তো লক্ষ্য থাকে।
রাজনীতি মানে তো শুধু ক্ষমতা নয়, একই সঙ্গে কোশ্চেইন অফ কমিউনিটি। কমিউনিটি তৈরি করাই কাজ। রাজনৈতিকভাবে আমরা এখনো ‘কমিউনিটি’ আকারে গড়ে উঠতে পারি নাই। এটা আমাদের একটা বড় সংকট। এখন আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আমাদের এখানে রক্তারক্তি হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা একটা ভেক টার্ম। এটা ১৯ শতকের বাবুরা আমদানি করেছেন। ভারত-পাকিস্তান টেনশনের কালে এর রমরমা দিন গেছে। এখনাে ওই ভূত আমাদের বুদ্ধিজীবীরা জিইয়ে রেখেছেন। জীবনে শুনি নাই বা দেখি নাই, আমাদের দেশে কোনো হিন্দু এই জন্য পাশের বাড়ির মুসলামনরে কোপায়ে মেরে ফেলছেন। এখন ধরেন, হিন্দুরা দেশের নাগরিক। কিন্তু তারা মনে করেন, তারা মাইনরিটি ও লীগ সরকার তাদের বন্ধু। লীগ যাই করে তারা সব বিনা বাক্যে সমর্থন করেন সব সময়। সব সময় লীগই সেরা। অন্যায় করলেও তাদের পক্ষেই থাকবেন। এটাই তাদের রাজনৈতিক পজিশন ধরেন। এবার লীগ-বিএনপি হাঙ্গামা লাগলাে এবং হিন্দুদের মাইর দিল। বুদ্ধিজীবীরা দেখবেন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে টিভির পর্দা ফাটিয়ে ফেলবেন। একবারও বলবেন না, দেশের নাগরিকদের ওপর অন্যায় হয়েছে। সব নাগরিককে নিয়ে আন্দোলন করা দরকার। তা করবেন না। বলবেন যে, হিন্দু মাইর খাইছে। এটা কমপ্লিটলি পলিটিকাল ও পার্টিজান ভায়োলেন্স। আশা করি, এই উদাহারণ থেকে অল্পতে বিষয়টা ইঙ্গিত করতে পারলাম। আবার শুধু ইসলাম বাদে সব ধর্মের সমন্বয়ে কমিটি করে দেশের শান্তি রক্ষা করার জন্য বড় বড় সেমিনার করবেন আর বলবে এটাই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র।
সেকুলার রাষ্ট্রের চেষ্টা সম্প্রদায়গত ঝগড়া পরিসংখ্যানের দিক থেকে কম। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ বলে যারা নিজেদের প্রচার করে ওই ভারতে স্বাধীনতার পর কয়টা দাঙ্গা হয়েছে? আর পাকিস্তানে- যেখানে তেমন শক্ত গণতন্ত্র নাই বলে প্রচার আছে সেখানে কয়টা হয়েছে? এ পরিসংখ্যানটা মেলান, আমার কথাটা পরিষ্কার হবে। ওইসব দেশের মধ্যে অনেক শক্ত কমিউনিটি আছে। অনেকে অস্ত্র ধারণ করেছে- সব ঠিক আছে। কিন্তু ‘সাম্প্রদায়িকতা’র দিক থেকে তারা অনেক বেটার। আশীষ নন্দী একবার একটা তথ্য দিয়ে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। আমি মনে করি, তিনি ঠিকই ধরেছেন। তিনি বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাটা শিক্ষিত মহলের মধ্যে বেশি ঘটে। সূচনা হয় এখানেই। পরে তা জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার ঘটানো হয়।
সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু নাই। এখানে আমাকে ক্রিটিক করতে পারেন। বলতে পারেন, তাইলে রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে। রাষ্ট্রের সম্প্রদায় নিরপেক্ষতার রেটরিক একটা নিষ্ঠুর কৌতুক। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই এটা কমন। রাষ্ট্র সব সময় তার পাওয়ার সংহত করার জন্য কমিউনিটির মধ্যে বিভাজনের আগুনে প্রকাশ্যে বা গোপনে ঘি ঢেলে থাকে। রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার ভেতর দিয়ে সমাজের ভিন্নতার দ্বন্দ্ব মেটে যায় না। এ জন্য সামাজিক স্তরে লড়াই জারি থাকে। কাজেই সম্প্রদায়ের মতাদর্শের নিরিখে সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু নাই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। এটা সাম্প্রদায়িকতা নয়। যে লড়াই করবে সে বলবে, মুক্তিযুদ্ধ করতেছে। তার কমিউনিটিকে মুক্ত করতে সে লড়ছে।
সাধারণত ক্ষমতার স্বার্থে ওইসব কমিউনিটির ভেলুজকে এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়কে ক্ষেপিয়ে দেয়া হয়। আর বাংলাদেশের তো অদ্ভুত নিয়ম, যদি হিন্দুয়ানি ভাবধারা প্রমোট করেন আপনি আপনি প্রগতিশীল। ইসলামের রিচুয়াল ধরে থাকলেই আপনি সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী- হেনতেন। এই যে কলোনিয়াল ক্রাইসিস তা আমাদের সাহিত্যে প্রবল। এর মধ্যে যে যার মতাে ফায়দা নেয়ার জন্য কুত্তার কামড়াকামড়ি করছে। এটা নিয়ে কথা বললে অনেক কথা।
আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের কলোনিয়াল ধারাটা কলকাতার মতো নয়। আমাদেরটাকে এ জন্যই সাবলেট কলোনিয়ালিজম বলি। তো হুমায়ূন ওই ধারাটা প্রথম ব্রেক করেছেন। এটা লিখে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। উপন্যাস বা সাহিত্যের যে আদর্শ ঠিক করে দেয়া হয়েছে এর সবকিছু অগ্রাহ্য করে তিনি লিখে গেছেন এবং পাঠক যে এটা নিয়েছেন তা তো খুব স্বাভাবিকই মনে হয়। আমার মনে হয়, আমাদের শিক্ষার সমস্যাটা সমাধান হলে হুমায়ূন আরো জনপ্রিয় হতেন। সামনে আরো হবেন। আর তাকে যারা বাজারি বলেন তারা সাহিত্যের বাজার বােঝেন না। যে কোনাে জিনিস তো বাজারে যাবেই। বইপত্র কি পূজা দেয়ার জিনিস?
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কলোনিয়াল রুচি থেকে আপনি বের হতে বলেছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে তো অনেকেই বাজারি লেখক বলেন। এটা কেন?
রনি : হুম, হুমায়ূন নিয়ে অনেক দিন থেকে কাজ করছি। আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের কলোনিয়াল ধারাটা কলকাতার মতো নয়। আমাদেরটাকে এ জন্যই সাবলেট কলোনিয়ালিজম বলি। তো হুমায়ূন ওই ধারাটা প্রথম ব্রেক করেছেন। এটা লিখে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। উপন্যাস বা সাহিত্যের যে আদর্শ ঠিক করে দেয়া হয়েছে এর সবকিছু অগ্রাহ্য করে তিনি লিখে গেছেন এবং পাঠক যে এটা নিয়েছেন তা তো খুব স্বাভাবিকই মনে হয়। আমার মনে হয়, আমাদের শিক্ষার সমস্যাটা সমাধান হলে হুমায়ূন আরাে জনপ্রিয় হতেন। সামনে আরো হবেন। আর তাকে যারা বাজারি বলেন তারা সাহিত্যের বাজার বােঝেন না। যে কোনাে জিনিস তো বাজারে যাবেই। বইপত্র কি পূজা দেয়ার জিনিস? এটা তো বিক্রি করা হয়। তো বিক্রি বেশি হওয়াই তো লক্ষ্য থাকা উচিত। হারুকি মুরাকামি, মার্কেজ তো আরো বেশি বিক্রি হয়। তাদের চিন্তা হলাে ব্যক্তিগত হিংসার জায়গা থেকে জাগ্রত করা। বাজারি লেখক বলে কিছু নাই। যারা এসব বলেন তাদের বই কি তাদের বউ বা বন্ধু-বান্ধবীর জন্য লেখেন, বাজারে কি ছাড়ে না? হুমায়ূন সম্পর্কে এখনকার বুদ্ধিজীবীদের কথাবার্তা শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন, এ সমাজটা কতটা হীনম্মন্য ও চিন্তাশূন্য। বাজারি লেখক বলে হুমায়ূনের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে এর ফাঁপা দিকটা দেখিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। যারা আগে আমার হুমায়ূন ডিলিং নিয়ে তর্ক করেছেন তাদের অনেকেই এখন কনভিন্স। পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। তবে হিমু ফ্যানাটিকদের জন্য ওই বিষয়ে সিরিয়াস রিডিং তৈরি হতে সময় নেয়। অনেকে আমার লেখাটা আমলে নিয়েছেন, নতুন করে ভাবছেন।
আসলে হুমায়ূন নিয়ে যে জিনিসটা মূলত ডিল করতে শুরু করেছি তা হলাে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি। অনেকে এটা এখন বুঝতে পারছেন। কাজেই হুমায়ূন নিয়ে আমার কাজের আসল উদ্দেশ্যটা শুধু হুমায়ূনকে নতুন করে আবিষ্কার করা নয়। এই হাইব্রিড সেকুলার পরিসরে যে সাংস্কৃতিক পলিটিকসটা চলে তা খতিয়ে দেখা এবং দেরিদীয় পদ্ধতিতে সাহিত্যের ওই হেজিমনিক ব্যাপারটি ডিকনস্ট্রাক্ট করার একটা চেষ্টা করছি। এখনাে যা লিখেছি তা সব খসড়া। হুমায়ূন নিয়ে কাজটা শেষ করবাে ইনশাআল্লাহ। ওনাকে যে অবহেলা করা হয়েছে, জনপ্রিয় ও শস্তা লেখক বলে যেভাবে কর্নার করে নিজেদের মূর্খতাকে দম্ভ আকারে হাজির করে সাহিত্যকে একটা কঠিন ও মুষ্টিমেয় লোকজনের জন্য বিশেষ সৃষ্টি বলে প্রচার করা হয়েছে ওই মিথটা ভাঙতে শুরু করেছে ইতােমধ্যে। এটা আরাে সময় নিয়ে করবাে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে সবকিছুরই একটা বাজার আছে। সাহিত্য তো অবশ্যই অনেক বড় একটা বাজার তৈরি করতে পারে। এ জন্য তো ক্যাপাবল রাইটার লাগবে। আপনি দেখবেন, কোনাে বড় লেখকই বাজারশূন্য নন। আবার যেসব ফলস লেখক বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দিয়ে বাজার তৈরি করে তাদের বাজার দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এটাকে অনেকটা আসল ডাক্তার আর ক্যানভাসারের ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করা যায়। ডাক্তার ভালাে হলে বিজ্ঞাপন লাগে না। আর ক্যানভাসার নাননেভাবে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু একবার যে ধরা খায় সে পরে আর ওই পথে যায় না। সাহিত্যিকের বাজার তৈরির জন্য লেখকের তেমন কিছু করতে হয় না। তার কাজ লিখে যাওয়া। নিজের সঙ্গে প্রতিদিন ফাইট করা। এটা করবে ইন্ডাস্ট্রির লোকজন। বাংলাদেশে যেহেতু সবকিছু দলীয় ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সেহেতু আজও এখানে কোনাে সাহিত্য বাজার দাঁড়ায়নি। আগামীতে তৈরি হবে সেটিও বলতে পারি না। তাই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে চোখ রাখতে হবে। ভাষা কোনাে ব্যাপার নয়। পৃথিবীতে বহু লেখক আছেন একই সঙ্গে ৩-৪টি ভাষয়ি কাজ করেন। তাদের এজেন্টরাই এগুলোর ব্যবস্থা করেন। কাজেই বাংলাদেশে সাহিত্য নিয়ে তথাকথিত মূলধারা বা মেইন স্ট্রম লোকজন যা বলেন তা শুনলে লেখালেখির বাজার দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রনি : ধন্যবাদ আপনাদের। এছাড়া প্রিয় পাঠকদের বিশেষ ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা সবাইকে।