ললাটে লজ্জার হার দিয়ে মিশন লংকা শেষ করলেন মাহমুদুল্লাহরা। সমশক্তির লংকার সঙ্গে যখন লেহাজেই টান পড়েছে তখন আর চুপ থাকতে পারেননি বিসিবিপ্রধান। জরুরি সভায় তিনি মিলিত হয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্ট-এর সঙ্গে। সভা শেষে তিনি একটি কথা বলেছেন যা একই সঙ্গে বর্তমান হালতের বয়ান দেয় আবার হেড কোচের আবশ্যকতার জরুরতটিও তুলে ধরে। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক অাগেও নাকি একাদশ জানতে চেয়ে বোর্ডপ্রধান ব্যর্থ হয়েছেন। এতেই টেকনিকাল ডিরেক্টরের ট্যাকটিসের হালত সম্পর্কে আঁচ করা যায়। এ অবস্থায় বোর্ডপ্রধান অনুভব করছেন, একটি মাথা তথা একজন হেড কোচের আবশ্যকতা। তবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ভালোমানের কোনো কোচ পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি যে প্রতিবন্ধকতাগুলোর কথা বলেছেন তা যৌক্তিক ও বাস্তব সম্মত। তাই আজ মাথা নয়, বরং ম্যানেজমেন্টের অন্য একটি দিকে একটু আলোকপাত করতে চাই। কারণ মাথা যতই কাজ করুক, হাত-পা যদি মাথার নির্দেশে সাড়া না দেয় তাহলে দিন শেষে সবই বিফল।
একটি ম্যাচ জিততে বোর্ডে যেমন রান লাগে তেমনি ওই রানটি ডিফেন্ড করার বোলারদের অবদানও আবশ্যক। শ্রীলংকার বিপক্ষে বাংলাদেশের বোলিংয়ের হালত দেখে একটা সময় এটিকে আর জাতীয় দলনিয়, পাড়া-মহল্লার কোনো দল বলে মনে হচ্ছিল। যে কোনো কন্ডিশনেই টি২০-তে ১৯০+ একটি ভালো সংগ্রহ লড়াই করার জন্য। কিন্তু যে জবাবটি দরকার ওই লড়াইয়ের জন্য সেটিই বোধহয় খুইয়ে বসেছেন বোলাররা। শুধু শ্রীলংকার বিপক্ষেই নয়, বরং বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের বোলারদের ওই হালত দেখে আসছি আমরা। আপনি যদি এটিকে মানের ঘাটতি হিসেবে দেখাতে চান তাহলো তা ধোপে টিকবে না এই জন্য যে, খুব বেশিদিন নয়- মাত্র কয়েক বছর আগেই বোলারদের র্যাংকিংয়ের শীর্ষ দশে আমাদের একাধিক বোলারের নাম দেখেছি। তাহলে সমস্যার মূলটা কোথায়? এ জন্য একটু পেছন ফিরে যেতে হবে।
২০১৪ সালের মে মাসে বিসিবি বোলিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় সাবেক জিম্বাবুয়ান অধিনায়ক হিথ স্ট্রিক-কে। দায়িত্ব নেয়ার পর সাদামাটা বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটটিকেই যেন পরিণত করেছিলেন ভয়ঙ্কর এক বোলিং ইউনিটে। তার সময়েই আগমন মোস্তাফিজ-তাসকিনদের। স্ট্রিকের সময় বাংলাদেশের পেসাররা কতটা কার্যকর ও সাহসী হয়ে উঠেছিলেন এর স্পষ্ট নজির হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলাদেশের হাতে ভারতের ইজ্জত হারানো সিরিজটিকে। উপমহাদেশের কন্ডিশনে চার পেসার এক সঙ্গে নামিয়ে ভারতের শুধু ভড়কেই দেননি, বরং সিরিজ হারিয়ে অম্লান বদনে মুম্বাইয়ে ফেরত যেতে বাধ্য করেছিলেন। পেসারদের ওই ধারাবাহিকতার ধারা দেখা গেছে তার মেয়াদের পুরোটা সময়েই। বাংলাদেশকে বিশ্ব কাপের কোয়ার্টারে নিতেও পেসারদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
একটু পরিসংখ্যান-এর জিকির করি। তাহলে হয়তো বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। স্ট্রিক-এর সময়কালটায় বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা খেলেছেন ৩৮টি ম্যাচ। এতে ২৮ দশমিক শূন্য ৯ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৫৪টি। ইকনমি রেট ৪ দশমিক ৭৯। আল-আমিন ওই সময়ে ১৪ ম্যাচে ২৪ দশমিক ৯০ গড়ে নিয়েছেন ২১ উইকেট। ইকনমি ৫ দশমিক ২০। রুবেল ২৬ ম্যাচে ৩২ উইকেট নিয়েছেন ৩৫ দশমিক ৬৮ গড়ে। ইকনমি ৫ দশমিক ৭২। অভিষেকেই আশাজাগানো তাসকিন ওই সময়কালে ২৩ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ৩৫টি। গড় ২৭ দশমিক ৭৯। ইকনমি ৫ দশমিক ৭০। আর বিস্ময় বালক মোস্তাফিজ ১১ ম্যাচেই পেয়েছিলেন ৩০ উইকেট। মাত্র ১৩ দশমিক ৮৩ এভারেজ এবং ৪ দশমিক ৩৮ ইকনমিতে। ৫ উইকেটও আছে তিনবার। আন্তর্জাতিক মানের বিচারে এক রুবেলের বাদে প্রত্যেকের গড়ই যথেষ্ট ভালো ছিল। আর বর্তমান সময়ের বিবেচনায় ইকনমি রেটটিও খুব একটা খারাপ বলার সুযোগ নেই।
পরিসংখ্যান অনেক সময়ই সঠিক তথ্য দেয় না সত্য। তবে ওই পরিসংখ্যানে চোখ রেখেই পরিস্থিতির অনেকটাই আঁচ করা যায়। ২০১৬ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বোলিং কোচের দায়িত্ব নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ। বাংলাদেশ মিশন শেষ করে অক্টোবরে নিজ দেশে প্রধান কোচের দায়িত্ব নেন স্ট্রিক।
যেহেতু ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্ট্রিক দায়িত্বে ছিলেন সেহেতু ওয়ালশ-এর ক্ষেত্রে ২০১৭-১৮ সময়কালটার পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেবো একটু। এ সময়ের মধ্যে মাশরাফি খেলেছেন ১৮টি ওয়ানডে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ওই ১৮ ম্যাচে ৪০ দশমিক ৯৪ গড়ে তার সংগ্রহ মাত্র ১৯টি উইকেট। ইকনমিও ৫ দশমিক ৪০। মোস্তাফিজ ১৬ ম্যাচে ২৬ দশমিক ৮৫ গড়ে পেয়েছেন ২১ উইকেট। ইকনমি ৪ দশমিক ৮৪। তাসকিন ৯ ম্যাচে ৪২ দশমিক ৭৯ গড়ে উইকেট পেয়েছেন মাত্র ১০টি। ইকনমিও ভয়াবহ ৬ দশমিক ৬০। উন্নতির ছাপ শুধু রুবেলের বোলিংয়েই। ১৬ ম্যাচে ৩২ দশমিক ৭৮ গড়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ উইকেট। ইকনমি ৫ দশমিক ৬৯।
বিস্ময়করই বটে। এক বছরের মধ্যে এক- দু’জনের অফফর্ম চলতে পারে। কিন্তু পুরো দলের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিম্নমুখী হতে দেখাটি স্বাভাবিক হতে পারে না। পরিসংখ্যানের বোবা সংখ্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে শুধু একটু ধারণা দিচ্ছে, পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারছে না। যারা নিয়মিত বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন তাদের চোখে এটি ধরা পড়তে বাধ্য যে, বাংলাদেশের বোলারদের শরীরের ভাষাটাও আগের মতাে আক্রমণাত্মক নেই। যেই মোস্তাফিজের ভেলকিতে ভড়কে গিয়ে বিরাট কোহলি ফ্রি হিটেও ডিফেন্ড করেছিলেন সেখানে তাকে বলে-কয়ে কুশন মেন্ডিস করেছেন সীমানা ছাড়া। তাসকিন তো ছিটকেই গেযছেন দল থেকে। আল-আমিনের মতো সম্ভাবনাময় বোলার কেন প্রায় নির্বাসিত এর সবচেয়ে ভালো জবাবটি দিতে পারবেন টেকনিকাল ডিরেক্টর মহোদয়। একই দোষে দোষী হয়েও তিনি যখন পদ-পদবীর ভারে ন্যুব্জ প্রায় সেখানে প্রায় ভুলতে বসা এক নাম আল-আমিন। তরুণ সাইফুদ্দিনকে দিয়ে চেষ্টা চলছে। কিন্তু তিনিও পারফরম্যান্স দিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এখনো ওই পর্যায়ে ক্রিকেটের ভার বহন করার মতাে যথেষ্ট পরিপক্ব নন তিনি।
নাম, ধার ও ভারে ওয়ালশ স্ট্রিকের চেয়ে আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকলেও দু’জনের আমলে বাংলাদেশের বোলারদের নৈপুণ্য বিবেচনায় নিলে স্ট্রিক শুধু পাসই নন, লেটার মার্কস নিয়েই পাস করবেন। সেখানে ওয়ালশের আমলে শোনা যাচ্ছে ওই পুরনো গীত- বাংলাদেশ স্পিন নির্ভর দল। এদিকটি নিয়েও একটু কথা বলা যাক তাহলে।
বাংলাদেশের বর্তমান স্পিন কোচ সুনিল যোশি। ভদ্রলোকের নাম না শুনে থাকলে সেটি আপনার কসুর নয়। কারণ নব্বইয়ের দশকের ক্রিকেটের একান্ত অনুরাগী না হলে তাকে চেনার কোনো কারণও নেই।
যাহোক, ভালো বোলার হলেই যে ভালো কোচ হবেন এটি যে সত্য নয় এর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে। যোশি-র আমলে স্পিনারদের আমলনামাও তো আহামরি কিছু নয়। এক সাকিবকে সরিয়ে নিয়ে বোলিংয়ের জন্য বরাদ্দ কোটা পূরণে সক্ষম বোলার খুঁজে পেতেই হিমশিম খেতে হয়। মিরাজ স্পিনিং ট্র্যাকের বাইরে একদমই অকার্যকর। নাসিরের মধ্যে সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যায়নি সঠিকভাবে। নতুন কোনো স্পিনারও উঠে আসছেন না সেভাবে। তাই বাংলাদেশ যে স্পিন নির্ভর দল এটি শুধু কাগজ-কলমেই। ব-কলমের মতো যে কাউকেই নামিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়া বিচিত্র কৌশল কতটা বুমেরাং হতে পারে তা তো ওই সিরিজেই স্পষ্ট। ওয়ালশ বোলার হিসেবে কিংবদন্তি। তার যোগ্যতা বা অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলাও এক প্রকার ধৃষ্টতা। কিন্তু যোশি তো তেমন নাম নন। তিনি যে ফল দিচ্ছেন সেটিই যদি কাম্য হয় তাহলে মোহাম্মদ রফিককে সুযোগ দিয়ে দেখতে দোষ কোথায়? কারণ বোলার হিসেবে যোশির চেয়ে রফিক বহুগুণ যোগ্য।
এটি দিনের আলোর মতােই স্পষ্ট যে, আচমকাই বাংলাদেশ ব্যাক গিয়ার-এ চলা শুরু করেছে। এ থেকে উত্তরণে শুধু মাথা নয়, বরং সবার পারফরম্যান্সই বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এ মুহূর্তে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার খেসারত তো আমরা ওই সিরিজেই দিলাম অযোগ্য একজনকে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বসিয়ে। তাই হেড কোচ নিয়োগের আগে প্রতিটি বিভাগের পারফম্যান্স গ্রাফ বিবেচনায় এনে স্বীয় করণীয় ঠিক করবে বোর্ড- এমনটিই আশা বিশ্লেষকদের।