খলিফা উমার (রা.) এর তাকওয়া

খলিফা উমার (রা.) এর তাকওয়া

একবার আমিরুল মুমিনিন হজরত উমার ফারুক (রা.)-এর পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) কিছু উট ক্রয় করেন এবং তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ‘আল হিমা’ নামক চারণভূমিতে ছেড়ে দেন। উটগুলো যখন স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে তখন আবদুল্লাহ তা বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যান। উমার (রা.) বাজার পরিদর্শনে এসে ওই উটগুলো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেন ওই উটগুলো কার? আবদল্লাহ (রা.) জবাব দেন। উমার (রা.) উটগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলেন, ওই উটগুলো ক্রয়ের পর অন্য নাগরিকদের মতাে তিনিও সরকারি চারণভূমিতে এগুলোকে চরতে দেন। উমার (রা.) এবার বললেন, ‘আর লোকজন বলতে লাগলো এর দেখভাল করো, পানি ও তৃণভোজের সুযোগ দাও। এসব আমিরুল মুমিনিনের পুত্রের উট। এ হয় না। তুমি বরং তোমার মূলধন রাখো এবং যাবতীয় লাভ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করো।’

পৃথক একটি ঘটনা রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা মো. আইকবি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ”একদিন উমার (রা.) ভরদুপুরে আমাকে ডেকে পাঠান। দেখতে পেলাম তিনি তার পুত্র আসিমের কাছ থেকে অর্থ দাবি করছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘তুমি জানো, এ কী করেছে? সে সম্ভবত ইরাকের লোকজনকে বলেছে, আমি খলিফার পুত্র। আমাকে কিছু প্রদান করুন। লোকজন মূল্যবান তৈজস, রৌপ্য, দামি তলোয়ার ও বহুবিধ জিনিস তাকে দিয়েছে।”

আসিম (রা.) বললেন, ‘আমি কী করে এটি করতে পারি? আমি তো কেবল আমার পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি মাত্র। তারা হাদিয়াস্বরূপ আমাকে ওইসব প্রদান করেছেন।’ উমার (রা.) এর কোনাে উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘মো. আইকিব, ওইসব জিনিস রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে নাও।’

আসলে প্রকৃত ঘটনা ছিল, আসিম (রা.) তাদের কাছে কিছুই চাননি, বরং তার বন্ধুরা তাকে স্বপ্রণোদিত হয়ে ওইসব উপহার দিয়েছিলেন। ওই সময়টিতে পারস্যে সুন্দর তৈজসপত্র ও ভালো তলোয়ার তৈরি হতাে। কিন্তু উমার (রা.)-এর মনে আশঙ্কা ছিল, লোকজন যদি আসিম-কে খলিফার পুত্র ভেবে ওই হাদিয়া দিয়ে থাকে! তাই রাজকোষে ওইসব জিনিস জমা করে দেন তিনি।

আরেকবার আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) পারস্যের জালুলা (যা ছিল সদ্য বিজিত) অঞ্চল থেকে ৪০ হাজার দিরহাম-এ কিছু জিনিস কেনেন। তাকে উমার (রা.) বললেন, ‘যদি কাউকে আগুনের মুখে দাঁড় করিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হয় তাহলে তিনি কি তা প্রদান করবে না? অবশ্যই করবনি। যখন এসব ক্রয় করেছ তখন লোকজন ভেবেছে, আল্লাহর রাসূলের সাহাবি তুমি এবং খলিফার পুত্র। তাই তোমাকে তারা অল্প দামেই হয়তাে ওই জিনিস প্রদান করে দিয়েছেন। এ কারণে ওই পণ্য রাষ্ট্রের জিম্মায় বিক্রি করা হবে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে কেবল তুমি এক দিরহাম মূলধনের বিপরীতে এক দিরহাম লাভ করবে।’ ওই মতে, ওই পণ্য বিক্রি করা হয় চার লাখ দিরহামে আর আবদুল্লাহকে দেয়া হয় ৮০ হাজার দিরহাম এবং বাকি অর্থ সা’দ বিন ওয়াক্কাস (রা.)-এর কাছে পাঠানো হয় পণ্যের আদি বিক্রেতাদের তা ফেরত দিতে।

শাসকের ওপর শাসিতের হক প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কাছে এক বেদুইন এসে বললেন, ‘হে মহান শাসক উমার, আমার মেয়ে ও তাদের মাকে সাহায্য করার জন্য আমাকে কিছু দাও, আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দেবেন। নয়তো তুমি আল্লহের ব্যাপারে ভীত থাকো।’

উমার (রা.) বললেন, ‘যদি কিছু না দিই তোমাকে তাহলে কী হবে হে বেদুইন?’ বেদুঈন বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তোমাকে এ ব্যাপারে আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন। আর এর উত্তরের ওপরই নির্ভর করবে তুমি জান্নাতি হবে, নাকি থেকে যাবে জাহান্নামে।’

উমার (রা.) ওই কথা শুনে কাঁদতে শুরু করলেন। এমনকি কাঁদতে কাঁদতে তার দাড়ি ভিজে গেল। ওই বেদুইনকে তিনি পর্যাপ্ত সম্পদ প্রদান করলেন। নিজের গায়ের জামাটিও খুলে দিয়ে দিলেন। এরপর তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, এ জামাটি ছাড়া আমার আর কোনাে জামাও নেই।’

উমার (রা.) ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি তার শাসন আমলে কোনো অবিচার-অনাচার করেননি। অথচ আল্লাহর ভয়ে তিনি বলতেন, ‘যদি একটি মেষশাবকও ফোরাতের তীরে অনাহারে মারা যায় তাহলে আমি ভয় করি, এ জন্য হিসাব চাইতে পারেন মহান আল্লাহ।’

আমাদের দেশে আমরা দেখি এক ব্যবসায়ীর দেয়া জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে হুড়াহুড়িতে ৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বর্তমানে এ দেশের শাসক শ্রেণি, ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা যেভাবে ব্যবস্থাপনা করছেন এতে বোঝার উপায় নেই, ওই পরিমাণ অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে দিন পার করছে দেশের এক শ্রেণির মানুষ।