এক.
রাষ্ট্র ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মার্কেটে রাজনীতির স্বাভাবিক প্রভাব পড়ে সামান্যই। এরপরও দেখা গেছে, ৮ ফেব্রুয়ারি দেশের বিরোধীদলীয় প্রধান নেতা খালেদা জিয়ার বহুল আলোচিত রায়ের পূর্ববর্তী সপ্তাহে ঢাকা স্টক একচেঞ্জের সূচক প্রায় ৩০০-৪০০ পয়েন্ট দর হারিয়ে ৬ হাজারের মনস্তাত্ত্বিক সীমার নিচে চলে এসেছিল। কিন্তু রায়ের দুই দিন পর প্রথম কার্যদিবসেই (১১ ফেব্রুয়ারি) ওই বাজার ১০০ পয়েন্টের বেশি বেড়ে যায়।
প্রথমোক্ত পতনের কারণ ছিল উপরোক্ত মামলাকেন্দ্রিক ভয় ও অনিশ্চয়তা। শেষোক্ত বৃদ্ধির কারণ ছিল রায়ের বিরুদ্ধে খালেদার দল বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র আগোছালো, দুর্বল প্রতিবাদে জনজীবনের ‘স্বস্তি’।
অন্যদিকে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা প্রায় সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত- সূচকের উত্থান-পতনের এটি হলো দীর্ঘ এক সূচনা পর্ব মাত্র। সম্পূর্ণ বছরটি এভাবেই যাবে বলে তাদের বিশ্বাস।
ইতোমধ্যে খালেদার কারাবাসের দু’সপ্তাহ পার হয়েছে এবং তার সমর্থকদের লক্ষণীয় জোরালো কোনাে আন্দোলন ছাড়াই ক্যাপিটাল মার্কেটের উত্থান-পতনও জারি আছে। স্পষ্ট যে, দেশে-বিদেশে যারা বাংলাদেশের রাজনীতির ঐতিহাসিক ‘জাতীয় দ্বিধাবিভক্তি’ নিরসনপ্রত্যাশী তাদের জন্য পলিটিকাল ইকনমির ওই মুহূর্তটি আশাবাদের নয়। কারাজীবন শুরু সত্ত্বেও বিএনপি নেত্রী রাজনীতিতে এখনো এক নির্ধারক ভূমিকায় রয়ে গেছেন। কিন্তু তার দল প্রতিপক্ষকে সংলাপের টেবিলে আনতে পারেনি। রাজনীতির ওই বিপরীতমুখী কুহকের মধ্যেই দুলছে বাংলাদেশে ২০১৮ সাল।
দুই.
প্রয়াত স্বামীর নামে নিবন্ধিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানের তহবিল বিষয়ক মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড শুরু হলেও ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত তার বর্তমানে একমাত্র সন্তান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত থাকায় কারাভোগ এড়াতে পারছেন আপাতত। কিন্তু সর্বশেষ রায়ের মধ্য দিয়ে তারেক রহমানের দেশে আসার সম্ভাবনা আপাতত বহুগুণে কমে গেল। কারণ পূর্ববর্তী এক মামলার রায়ে তার বিরুদ্ধে রয়েছে আরো ৭ বছরের দণ্ডাদেশ। স্পষ্টতই বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল পুরোপুরি নেতৃত্বহীন এক পরিস্থিতিতে রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের বছরে প্রধান বিরোধী দলের ওই নেতৃত্বহীন হয়ে পড়াটিই বাংলাদেশের চলতি রাজনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। গত প্রায় অর্ধদশকের একপক্ষীয় রাজনৈতিক পরিবেশ এতে আরো যে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে সেটিই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
অবশ্য বাংলাদেশের চরম দুর্নীতিপূর্ণ রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আলোচ্য মামলার দুর্নীতির অংকটি নেহাতই সামান্য। কিন্তু ওই রায়ের তাৎক্ষণিক বার্তাটি বিশাল। বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসের এ স্থিতাবস্থা ভেঙে দিল ওই রায় যেখানে বিশ্বাস করা হয়, কারাভোগের নিয়তি রাজনীতিবিদদের জন্য নয়– এমনকি যদি তারা দুর্নীতিগ্রস্তও হন। অন্যদিকে ওই মামলা কতটা শুধুই দুর্নীতিকেন্দ্রিক ও কতটা রাজনৈতিক এ বিষয়ে পুরো দেশের মনস্তত্ত্বে প্রবল দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সর্বশেষ পরিস্থিতিটিও এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। মাত্র কিছুদিন আগেই প্রদত্ত এক রায় নিয়ে বিতর্ক ওঠায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা-কে পদত্যাগ করে অসম্মানজনকভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। সাধারণ নাগরিক হিসেবেও তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যে দুরূহ তা বাংলাদেশের গ্রাম-শহরের সবাই জানেন। তবুও প্রকাশ্যে সজোরে তা কেউ বলতে চাইবেন না।
বলা বাহুল্য, বিএনপি কর্মী-সংগঠকরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করছেন, তাদের নেতার কারাভোগের রায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। তবে খালেদা জিয়া ও বিএনপি এও জানায়, তারা আইনের প্রতি এখনো শ্রদ্ধাশীল এবং ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতেও গেছেন তারা।
যদিও বিএনপির নেতারা মনে করেন, শিগগির খালেদার জামিন পেয়ে মুক্তির সম্ভাবনা কম তবুও উচ্চ আদালতে লড়াই চালানো তাদের জন্য জরুরি। তা এ কারণে যে, খালেদা জিয়াকে ভবিষ্যতে ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনী লড়াই চালানোর উপযুক্ততা রক্ষা করতে উচ্চ আদালত থেকে খালাস পাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এটি এখনো আইনজীবীদের মধ্যে বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে উচ্চ আদালতে দণ্ড চূড়ান্ত না হলে খালেদা ভবিষ্যতে নির্বাচনে লড়তে পারবেন কি না। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকই দৈনিক ইত্তেফাককে ৯ ফেব্রুয়ারি তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে দেশটির হাই কোর্টে দুই রকমের দুটি রায় রয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে, নিম্ন আদালতের ওই রায় উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যে তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা খালেদা জিয়ার আগামীতেও নির্বাচন করতে বাধা নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্মীরা অবশ্য মনে করেন, ওই রায় উচ্চ আদালতে পুনর্বিবেচনা হোক বা না হোক, ইতোমধ্যে বিএনপির মনোবল তারা অনেকাংশে ধসিয়ে দিতে পেরেছেন। এর একটি প্রধান প্রমাণ হলো, রায় ঘোষণার পর বিএনপি কর্মীদের মেঠো প্রতিবাদের দুর্বল আয়োজন। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, খালেদার মুক্তির দাবিতে তার অনুসারীদের পোস্টার-লিফলেট প্রকাশের মতো সাধারণ প্রচার আন্দোলনের ব্যাপক কোনাে আয়োজনও চোখে পড়েনি।
যদিও বিএনপি এটিকে কৌশলগত নমনীয়তা হিসেবে অভিহিত করছে তবুও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের প্রত্যাশা- খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান বাকি তিনটি দুর্নীতির মামলায়ও শিগগির অনুরূপ রায় হবে এবং ওইরূপ মামলার জটে তার রাজনৈতিক জীবন প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
বিএনপির ‘ভাগ্য’ গত প্রায় এক দশক ধরেই মেঘাচ্ছন্ন। প্রতিপক্ষের ধারাবাহিক কঠোরতা ছাড়াও তাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা ছিল অনেক। প্রথমত. ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশটিতে গণতন্ত্রায়ন, দুর্নীতি নির্মূল ও তরুণদের মধ্যে আশাবাদ জাগানোর মতো আবেদনময় কোনাে রাজনীতি নিয়ে রাজধানীর বৃত্তাবদ্ধ গণ্ডির বাইরে যেতে পারেননি তারা। দ্বিতীয়ত. দলীয় সীমান্তের বাইরে রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠীর পরিসরও বাড়াতে পারেনি দলটি। এর পাশাপাশি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা আনতেও ব্যর্থ হয়েছে নেতৃত্ব। ওই নেতৃত্বের রয়েছে আবার গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও খালেদা জিয়া ভুল ও স্ববিরোধী বার্তা দিয়েছেন পুনঃপুন। বিপর্যয়কর গত এক দশকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অভিভাবকতুল্য ভরসা রাখলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বের গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বোকা বনেছেন তিনি। আবার একই দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে ভারতের সখ্য দেখে নিজেও ভারতের আস্থা অর্জনে ব্রতী হয়েছিলেন বার বার। বিএনপির ওই উভয় কৌশল দলটির মেঠোশক্তি ভিতের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তারা চাইছিলেন নেপালের কে পি শর্মা ওলি বা শ্রীলংকার রাজাপাকসে-র মতো খালেদা জিয়াও নতুন মিত্রের সন্ধান করুন যা দলটিকে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি করতে সহায়তা করতো। ভারতের সহানুভূতি আদায় চেষ্টার মধ্যেই খালেদার কারাভোগ তার জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি রাজনৈতিক শিক্ষা যা দিল্লিকেন্দ্রিক নীতি-নির্ধারকরা যে উপভোগ করছে তা ভারতের মিডিয়াগুলোর গত দু’সপ্তাহের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট। বিএনপি কর্মীরা কখনোই বাংলাদেশের জনগণকে বোঝাতে সমর্থ হননি বা বোঝানোর চেষ্টা করেননি কেন জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের ছায়া ছেড়ে ক্ষমতায় আসার জন্য তাদের বর্তমান নেতৃত্ব ভারতের সম্মতি ও সমর্থনপ্রত্যাশী।
অন্যদিকে খালেদা ও বিএনপির ভুল বা ব্যর্থতাগুলো কেবল তাদের জন্যই শুধু চূড়ান্ত বিপর্যকর হয়েছে তা নয়– বাংলাদেশে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর একটা জাতীয় নির্বাচনের স্বপ্নও অধরা থেকে যাচ্ছে এর ফলে। দেশটির অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা জানেন, এক-দুটি নির্বাচন, এমনকি তা অবাধ হলেও তাদের জীবন সংগ্রামের সামান্যই পরিবর্তন আনবে। কিন্তু ‘প্রায় একদলীয়’ অবস্থা দেখে দেখে তারা ক্লান্ত। মিয়ানমার, ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নির্বাচনী রাজনীতির সৌন্দর্য ক্রমেই উজ্জ্বলতর হলেও বাংলাদেশের বর্তমান ভোটার প্রজন্মের জন্য তেমন কোনাে সম্ভাবনার পক্ষে বাজি ধরার আপাতত অবকাশ নেই। অন্তত খালেদার চলমান কারাভোগের মধ্য দিয়ে দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সংলাপের সুযোগ আরো কমে গেল। উপরন্তু প্রচারমাধ্যমের প্রশ্নহীন সমর্থনের মধ্যে প্রতিপক্ষকে ক্রমাগত কোণঠাসা করতে ও রাখতে পারার সুখানুভূতি দেশটির নীতি-নির্ধারক অনেককে আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের ঝুঁকির দিকেও ধাবিত করতে পারে।
তিন.
হয়তো অনেকেরই স্মরণে আছে, খালেদা জিয়ার মামলায় যেদিন রায় হয় সেদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন’। মুশকিল হলো, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই বিশ্বাস করে, এ দেশে রাজনীতিবিদরা আইনের আওতায় রয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিচার হবে! খালেদার ওই রায়ের পরও ‘সমাজ’-এর ওইরূপ বিশ্বাসের সামান্যই নড়চড় হয়েছে।
খালেদা জিয়ার আগে দুর্নীতির দায়ে সর্বোচ্চ রাজনীতিবিদদের আদালতে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার মাত্র একটি দৃষ্টান্ত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও ওই দণ্ড রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ‘অপরাধী’র আবেদন ফুরিয়ে ফেলেনি। নিজ নির্বাচনী এলাকায় জেনারেল এরশাদ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। এ থেকে বার্তাটি স্পষ্ট, রাজনীতিবিদের ভাগ্যের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে জনতার আদালতে।
সম্প্রতি আর্থিক, গণপূর্ত ও শিক্ষা খাতে ক্ষমতাসীন অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে চলেছে। যতক্ষণ ওইসবের নিরপেক্ষ তদন্ত ও কোনাে বিচারিক সুরাহা না হচ্ছে ততক্ষণ ওইসব মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটানো কঠিন যারা বিশ্বাস করতে থাকবে খালেদার কারাভোগের কারণ রাজনৈতিক এবং প্রচুর রাজনৈতিক ভুল সত্ত্বেও একটি দুর্বল দলের শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে নিজের উপস্থিতি জারি রাখতে সক্ষম হবেন তিনি।