প্রত্যাবাসন নয়, দরকার ‘স্বায়ত্বশাসিত রোহিঙ্গা অঞ্চল‘

প্রত্যাবাসন নয়, দরকার ‘স্বায়ত্বশাসিত রোহিঙ্গা অঞ্চল‘

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গণহত্যার চিত্র উঠে আসার পর স্বভাবতই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিরাপদ হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেনা ও সশস্ত্র বৌদ্ধদের অত্যাচার নির্যাতনের মুখে ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছে বার্মিজ সরকার। তারপরও উদ্বেগ কমছে না।

রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নিপীড়নে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। তাই দেশে ফিরে যাবার পর রোহিঙ্গাদের ওপর আবারো যে অত্যাচার শুরু হবে না সে নিশ্চয়তাও দিতে পারছে না কোনো পক্ষ। পরিস্থিতি সমাধানে স্বায়ত্তশাসিত রোহিঙ্গা অঞ্চলের আওয়াজ তুলছেন কেউ কেউ। এমনই একজন ব্রিটেনভিত্তিক বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের প্রধান তুন খিন। গত সোমবার আলজাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে তুন খিন রোহিঙ্গাদের উপর চলমান অত্যাচার থামাতে স্বায়াত্তশাসিত রোহিঙ্গা অঞ্চলের কথা বলেন।

তুন খিন বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি একটি তামাশা মাত্র। প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনার সময় এখনও হয়নি। এর আগে তাদের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারে আমেরিকা ব্রিটেন সব কিছুই জানে। তাদের চোখের সামনেই সব কিছু ঘটেছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ দেখা যায়নি।’

তুন খিনের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স এর প্রাক্তন ফেলো মং জারনি। চলমান প্রত্যাবাসন চুক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আলজাজিরাকে তিনি বলেন, “যেকোনো পদক্ষেপের আগে বাস্তবতা চিন্তা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও অধিকার দিতে চায় না মিয়ানমার সরকার। আন্তর্জাতিক মনোযোগকে ঘুরিয়ে দিতেই তারা প্রত্যাবাসনের কথা বলছে। রোহিঙ্গাদের জন্য এমন অঞ্চল দরকার যেখানে তাদের হত্যা করা হবে না। বিশ্ব নেতাদের কোনো উদ্বেগ দেখি না রোহিঙ্গাদের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠনের বিষয়ে: কিন্তু এটা ছাড়া কোনা সমাধান কাজ করবে না।”

তুরস্ক, মিসর ও ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণের ঘটনাকে নির্যাতন ও অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দেশই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জাতিসংঘ সবাই খোলাখুলি ভাবে এই অত্যাচার দেখেছে। তবুও তারা কেনো স্থায়ী সমাধানে পৌছাতে পারছে না তা নিয়েও প্রশ তুলছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গা নেতারাও। টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে এ নিয়ে প্রকাশ্যেই বিক্ষোভ দেখিয়েছে তারা। প্রত্যাবাসনের এই প্রক্রিয়াকে রোহিঙ্গারা দেখছে ‘অনিরাপদ এবং বিপদজনক’ চুক্তি হিসেবে। প্রত্যাবাসনের পরে আবারো অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করছেন তারা।

এদিকে প্রত্যাবাসন চুক্তির পরও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ কমছে না। দাতব্য সংস্থা মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার তাদের নিজেস্ব অনুসন্ধানের বরাতে জানিয়েছে, এখনো প্রতি সপ্তাহে শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ক কেট নোলার জানিয়েছেন, “এখনও প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশে শতাধিক রোহিঙ্গা আসছে। তিনি বলেন, আগের মতো এত বিশাল আকারে রোহিঙ্গা ঢল না হলেও এখনও প্রতি সপ্তাহেই রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তারা রাখাইনে নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ বোধ করছে না।”

দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে গড়িমসি করছে মিয়ানমার কতৃপক্ষ। মিয়ানমারের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও সমাজসেবামূলক মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয় বলেছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে পাঠানো ৮ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করে দেখবে তারা। অনির্দিষ্ট এই প্রক্রিয়া কত বছর যাবত চলবে সে সম্পর্কে মুখ খোলেনি কোন পক্ষই। এদিকে আরাকান সালভেশন ফ্রন্ট (আরসা) কে বাংলাদেশ তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ করেছে মিয়ানমার কতৃপক্ষ। আশংকা করা হচ্ছে, এই অভিযোগের প্রভাব প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতেও পড়তে পারে।

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের ওপর অত্যাচারেরও নজির রয়েছে। এর আগে বহুবার তারা সরকারি ভাবে নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে। ১৯৭৮ সালে অত্যাচারের মুখে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। পরে আন্তর্জাতিক চাপে এবং সরকারি তৎপরতায় ১৯৮২ সালে মিয়ানমার তাদের ফেরত নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বা স্বায়াত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মত স্থায়ী সমাধান না করে এভাবে ফেরত নেয়ার ফলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।