রাশিয়ায় ১৮ মার্চে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল কি হবে তা প্রায় সবারই জানা। দৃঢ় মনোবলের ভ্লাদিমির পুতিন নিকটতম প্রতিযোগীর চেয়ে কমপক্ষে ৫-৬ গুণ ভোট পেয়ে আবার ক্ষমতায় আসবেন। সোভিয়েত সময় থেকেও কম সুষ্ঠ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় রাশিয়ায়। আগে যেমন একজনই রাষ্ট্রপতি হবার আকাঙ্ক্ষা করতে পারতেন, এখন পাশাপাশি কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়। এতটুকুই যা তফাত।
১৮তে কি হতে যাচ্ছে :
দুনিয়ার বিখ্যাত বিখ্যাত চিন্তক এবং নীতি-নির্ধারকরা রাশিয়ার গত বছরের কার্যক্রম এবং আগামী দিনের পরিকল্পনা বিষয়ে বেশ তৎপর আছে।
আগামী নির্বাচনে একটি ব্যাপার ঘটতে পারে সেটি হল পুতিন গত চার বারের মত এবারও পার পেয়ে যাবেন। যেমন প্রথমবার পেয়েছিলেন অক্টোবর ২০০৩ এ, নির্বাসিত নেতা মিখাইল খোদরকোভস্কির জেলে যাবার পর। তারপর পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে, নিজের বানানো নির্বাচন রীতিতে সফল হয়ে। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর, সদ্য নির্বাচিত দিমিত্রি মেদমেদেভকে বাগে আনার খেলায়ও জিতেছেন। শেষবার পার পেয়ে যান ২০১২ সালে, যুদ্ধকে এরপর আরো কাছে টেনে নেন পুতিন। ঠিক পরেই ইউক্রেন আক্রমণ করার কথা ভাবেন পুতিন। পরে আবার গণবিক্ষোভ দমাতে মস্কোর পোকলোন্যায়া গোরা প্লাজায় নিজের সমর্থকদের নামিয়ে দেন, ফিরে পান রাষ্ট্রপতিত্ব।
বদল আনার পক্ষে পুতিনের বেশ দক্ষতা সত্ত্বেও, তার বিজয়ের পরও তার নীতিতে কোন পরিবর্তন থাকে না। সাবেক উদারবাদী অর্থমন্ত্রী এলেক্সেই কুরদিনের মত আরো যারা স্পষ্ট এবং সুবিধামত সংস্কার চান, পুতিনের ধর্তব্যের মধ্যে তারা থাকেন না। পুতিন চিরাচরিত নিয়ম মানতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, নতুন কোন কিছু তিনি চান না।
পুতিন আগামীবার জিতে কি করবেন, তার একটু ইশারা পাবেন তার ১৮ বছর শাসনের নির্দিষ্ট পাঁচটি প্রবণতা দেখে। প্রথমটা বলা যায়, পশ্চিমের সাথে তার লড়াইকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা যার ফলে রাশিয়া তার প্রতিবেশি দেশগুলোর কাছেও শত্রুভাবাপন্ন হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মুষ্টিমেয় উঁচুশ্রেণীর লোকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া যারা রাশিয়ার আমলাতন্ত্র, সংসদ এমনকি বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত নিজেদের আওতায় এনে ফেলেছে।
তৃতীয়টা পুতিনের নানা বাহিনীর উপর বাড়তি নির্ভরতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক লড়াইয়ে গোয়েন্দা পুলিশের হস্তক্ষেপ। সামান্যতম প্রমাণ কিংবা কখনো কখনো প্রমাণ না পাওয়া সত্ত্বেও ‘বিখ্যাত’ কেজিবির প্রকৃত সহোদর ফেডেরাল সিকিউরিটি সার্ভিস সামাজিক সাইট গুলোতে সরকার বিরোধী মত প্রকাশ করার দায়ে হয়রানি করে। এসবের ভুক্তভোগীর তালিকায় মন্ত্রী, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ, থিয়েটারকর্মী, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী, এমনকি সাধারণ নাগরিকরা পর্যন্ত রয়েছেন।
চতুর্থ হচ্ছে, সাংবিধানিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা, যেমন ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা সভা-সমাবেশ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া। শেষেরটা রাশিয়ায় ক্রমান্বয়ে সম্পত্তির মালিকানা অধিকার কমিয়ে আনা হচ্ছে, যার ফলে খোদ রাশিয়ার ব্যবসায়ীরাই রাশিয়ায় বিনিয়োগ করতে অনীহা দেখাচ্ছে।
এ ধরণের নেতিবাচক ব্যাপারগুলো কমিয়ে আনা হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু এসবগুলোই সেখানে ঘটে। ফলে পুতিনের আবার জিতে আসায় ছয় বছরের জন্যে নতুন করে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং আন্তর্জাতিক অবরোধ চলবে। তিনি হয়তো এসব সংস্কারের কথা বলবেন, কিন্তু এক প্রজন্ম তার ক্ষমতার স্বাক্ষী হিসেবে জানে, তিনি এসবের কিছুই করবেন না। তার উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যত নীতি বুঝতে হলে তার কাজকর্ম অনুসরণ করতে হবে, তার কথায় নয়। আমার মতে, এতে রাশিয়ায় চার ধরণের সম্ভাব্য অবস্থা তৈরি হতে পারে।
প্রথম অবস্থা ধারণা করা যেতে পারে, পুতিন নিজেকে সারাজীবনের জন্যে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে পারেন। এর জন্যে তাকে গণভোটের আয়োজন করে দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধতাকে উঠিয়ে দিতে হবে। কিংবা বেলারুশের সাথে মিলে ইউনিয়ন স্টেট অফ রাশিয়া ঘোষণা করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে পারেন। বেলারুশের বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে পুতিনের অধীনস্থ প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে। ১৯৯৭ সাল থেকেই এই ইউনিয়ন স্টেট এর ব্যাপারটি অতটা প্রকাশ্য ছিল না, তবে পুতিনের স্বার্থে সেটিকে আবার সামনে আনা হতে পারে।
দ্বিতীয় অবস্থা হতে পারে, পুতিন রাশিয়ার দেং জিয়াওপিং হয়ে উঠতে পারেন। তিনি রাশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক মডেলকে অকার্যকর ঘোষণা করে তিনি সারাদেশের সকল জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ‘গোলটেবিল বৈঠক’ এর আয়োজন করতে পারেন, নতুন মডেল তৈরির উদ্দেশ্যে। এই বৈঠক থেকে পুতিনের মেয়াদ আরো দুবছর বাড়িয়ে দিতে পারে, তারপর রাশিয়া নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হবে।
অথবা তার আগের বরিস ইয়েতসিন এর মতো, পুতিন নিজেকে বিশ্রাম দেওয়ার কারণ দেখিয়ে তার যোগ্য উত্তরসূরিকে মনোয়ন দিতে পারেন।
তৃতীয়টা হতে পারে, নির্বাচনের পর নতুন উত্তরসূরী মেদভেদেভ এর মত উদারবাদের দিকে যেতে পারে। যেখানে আবার চতুর্থ দৃশ্য হতে পারে, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি রোগোজিন যিনি এখন আবার প্রতিরক্ষা শিল্পটাও দেখছেন তার মত কট্টরবাদী শাসকও পেতে পারে রাশিয়া।
শেষ দুটি আদর্শিক অবস্থায়, আসলে কট্টরবাদী শাসক আসছে নাকি উদারবাদী আসছে তাতে খুব বেশি হেরফের হবে না রাশিয়ায়। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, ক্ষমতায় যেই আসুক, তারা কেউই রাশিয়ার বর্তমান এই অবস্থা ধরে রাখতে পারবেন না। কিন্তু তারা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নিলেই সেটা ক্ষমতাশীলদের স্বার্থে আঘাত হানতে পারে, সেটি ক্ষমতার ভারসাম্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এমনকি এটিও অস্পষ্ট যে, মেদভেদেভ অথবা রোগোজিন যেই ক্ষমতায় আসুক, সেদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন আছে বা থাকবে। এবং সেই পুতিন-পরবর্তী সময়ে কিভাবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে গোয়েন্দা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা কমানো যায় সে ব্যাপারে কাজ করবে।
আমি ধরে নিচ্ছিনা আসলে এই চারটির কোনটি ঘটবেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাবে- ২০২৪ সালে রাশিয়ার নেতৃত্ব কে নেবে, পুতিন বা পুতিনের কেউ? বা যাই হোক। এতটুকু তো বোঝাই যায়, পুতিনের জন্যে আগামী প্রতিটি দিনই বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন এর অনাবাসিক ফেলো সের্গেই অ্যালেক্সাশেঙ্কো’র এই লেখাটি গতকাল ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট এ প্রকাশিত হয়।