রন্ধন শিল্পের পিকাসো গ্রান্ট অ্যাজাৎস

রন্ধন শিল্পের পিকাসো গ্রান্ট অ্যাজাৎস

রূপকে বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম তুখোড় কবি রেজাউল করিম রনি আখ্যা দিয়েছিলেন বিষাদ হিসেবে। বেশ সহজ ব্যাখ্যাতেই তিনি বলেছিলেন, রূপের অারেক নাম বিষাদ। আজ থেকে কয়েক বছর আগে পৃথিবীর অারেক প্রান্তে রূপের বিষাদ অনলে দগ্ধ হচ্ছিলেন জগৎ বিখ্যাত শেফ গ্রান্ট অ্যাজাৎস। শিকাগো-র কোনো এক আর্ট গ্যালারিতে চোখ ধাঁধানো সব চিত্রকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে বিষাদের রাজ্যেই যেন ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। না, চিত্রকলায় নিজের অক্ষমতার কারণে নয়, বরং চিত্রের ওই সৌন্দর্য খাবারের প্লেটে তুলে ধরতে না পারার বিষাদে। খোয়াবিদা এই আদমি দমে গেলেন না, তলিয়ে গেলেন না বিষাদের অতল রাজ্যে। নিজেই বরং রাস্তা বের করে নিলেন। সহাস্যে বললেন, রুলস? দেয়ার ইজ নো রুলস। ডু হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট!

গ্র্যান্ট অ্যাজাৎস

প্রথার প্রতি অন্ধ আনুগত্য হয়তো পরম্পরাকে জিইয়ে রাখে। কিন্তু প্রথা ভাঙা আদমিরা হয়ে ওঠেন প্রবাদপুরুষ। গ্রান্ট তেমনই একজন। আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে বিষাদের ভারে ন্যুব্জ গ্রান্ট সেদিন প্রথার প্রাচীরে আটকা না পড়ে ভেঙে ফেলেছিলেন সব নিয়ম। তাই তার হাতে জন্ম নেয়া ‘অ্যালেনিয়া’ আজ যুক্তরাষ্ট্রের সেরা রেস্টুরেন্ট। অ্যালেনিয়া-য় প্রবেশের ক্ষণ থেকে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। খাবার যে শুধুই উদরের জ্বালা মেটানোর জন্য নয়, বরং এর যে আলাদা একটি শিল্পগুণ থাকতে হয় সেটিই যেন দেখিয়ে যাচ্ছেন গ্রান্ট।

অ্যালেনিয়া-র প্রবেশপথ

রক্তেই যার রসনার নেশা তিনি যে এ জগতে মহীরুহ হবেন তা তো অনুমিতই। ১৯৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল জন্ম নেয়া ওই শেফ কিশোর বয়সেই রসনার রসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন নিজের বাবার রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকে কালিনারি ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকা, হাইডি পার্ক, নিউ ইয়র্ক থেকে ১৯৯৪ সালে সম্পন্ন করেন গ্র্যাজুয়েশন। রন্ধনশিল্পে গ্রান্টের আগমনটা রসনার প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়। অদম্য কৌতূহলই তাকে কালিনারি বিশ্বে বিখ্যাত করে তুলেছে। তাই তিনটি মিশেলিন স্টার জয়ী ওই শেফ অনেক দিক থেকেই আলাদা।

রসনার রসে অ্যাজাৎস মজেন আরেক বিখ্যাত শেফ টমাস কেলার-এর সাহচর্যে এসে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োন্টভিল-এ অবস্থিত ফ্রেঞ্চ লন্ড্রির হেড শেফ টমাস কেলার তখন কালিনারি বিশ্বে আবির্ভূত এক বিস্ময়কর নাম হিসেবে। দেখতে দেখতে সেখানেই চারটি বছর কেটে যায় গ্রান্টের। নিজ যোগ্যতায় দ্রুততম সময়ে হয়ে ওঠেন স্যু শেফ। টমাস কেলারে এতটাই ডুবে ছিলেন গ্রান্ট যে, পুরো মনোযোগ দিয়েছিলেন টমাসের মতােই হওয়ার জন্য। এতটাই যে, নিজের প্রথম সিগনেচার ডিশটিও অবলীলায় দিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ লন্ড্রির নামে। গ্রান্টের প্রথম সিগনেচার ডিশ ছিল ‘ক্যাভিয়ার ক্যানালপ লেমন ডিশ’ যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন টমাস কেলার স্বয়ং। কেলার তখন অহং নিয়ে অ্যাজাৎসকে বলেছিলেন, এটি তুমি আর কখনোই করতে পারবে না। তিনি দাবি করেন, এটি এখন থেকে ফ্রেঞ্চ লন্ড্রির। সহাস্যে গ্রান্ট বলেছিলেন, ‘কোনাে ব্যাপার নয়, এমন বহু কিছুই আমার মাথায় আছে।’ প্রজন্মের দুই প্রতিভাবান শেফের সম্পর্কটি ছিল অদ্ভুত রকমের। গ্রান্টকে আরো পরিণত করার জন্য টমাস কেলারই তাকে পাঠান আরেকটি বিখ্যাত হেঁসেল ‘অ্যাবলি’তে। সেখানেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন গ্রান্ট। রেস্টুরেন্টে প্রবেশের পরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় খাবারঘরে। খোয়াবিদা গ্রান্টের খোয়াব যেন আফতাবের আলোর দেখা পেল শেষ পর্যন্ত। পুরোই নতুন পরিবেশনে পুরনো খাবার। যে মাশিয়াত কেড়ে নিয়েছিলে গ্রান্টের সুকুন এরই যেন দেখা পেলেন অবশেষে। অ্যাবলি থেকে ফেরার পর বদলে যায় কেলার আর গ্রান্টের পথ। শিকড়ে আটকে থাকা কেলার আর কল্পনাপ্রবণ গ্রান্টের রসায়ন রূপকথা সৃষ্টির বদলে ভিন্ন করে দিল দু’জনের পথ।

অ্যাবলি থেকে ফেরার পর গ্রান্ট হয়ে ওঠেন আরো কল্পনাপ্রবণ। হাত দেন নিজের প্রথম সিগনেচার ডিশ ‘ব্ল্যাক ট্রাফল এক্সপ্লোশন’-এ। এটি তৈরি করার সময় ডিশটি ফ্রেঞ্চ লন্ড্রির আরেক শেফের নজরে পড়ে। গ্রান্টকে তিনি জানান, কেলার এটি তার মেনুতে স্থান দেবেন না। কেলারের ওই অবস্থানটাই আলাদা করে দেয় দুই অমিত প্রতিভাবান শেফের পথ। ফ্রেঞ্চ লন্ড্রি ছেড়ে অ্যাজাৎস যোগ দেন ট্রিও-তে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে। সেখানেই খাবার নিয়ে খেলা শুরু তার। ইনসান যখন স্বীয় কর্মকে ইবাদত জ্ঞান করে তখন স্বয়ং খোদাও যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ওই ট্রিওতেই একদিন সস্ত্রীক আহার পর্ব সারতে আসেন ব্যবসায়ী নিক কোকোনাস। ওয়েটারকে ডেকে অ্যাজাৎস-এর রান্নায় মুগ্ধ নিক দেখা করতে চান এক্সিকিউটিভ শেফ অ্যাজাৎসের সঙ্গে। একেই বলে মেঘ না চাইতেই বাদলা। নিক সরাসরি গ্রান্টকে প্রস্তাব দেন যৌথভাবে একটি রেস্টুরেন্ট খোলার। লোকে বলে, ‘আগার কোই কুচ পুরে সিদ্দাৎসে মাঙ্গে তো সারে কায়েনাত জুড় জাতি হ্যায় উসে মিলানে কে লিয়ে।’ আর গ্রান্টের শয়ন-স্বপন সবই তাে ছিল এইটা। ব্যস, যাত্রা শুরু হলো অ্যালেনিয়া-র।

অ্যালেনিয়া-য় পা রাখার পর থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিস্ময়। লাল আলোর রাজ করা অদ্ভুৎ করিডোরই আপনাকে প্রাথমিক একটি ধারণা দেবে, এটি আর বাকি দশটি রেস্টুরেন্টের মতো নয়। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যখন আসন গ্রহণ করবেন তখন আপনাকে সহাস্যে বেলুন হাতে স্বাগত জানাবে অ্যালেনিয়ার ওয়েটার। এটি যদি স্বাভাবিক বেলুন ভেবে এড়িয়ে যান তাহলে প্রথমেই অ্যালেনিয়ার রূপ মিস করবেন। হিলিয়াম ও গ্রিন আপেলের তৈরি ওই বেলুন শুধুই শোভা বর্ধনের জন্য নয়, বরং এটি দিয়েই শুরু হয় আহার পর্ব। শুরুটাই যখন এমন তখন সহজেই অনুমান করা যায় বাকি সময়টায় কী বিস্ময় অপেক্ষা করে রয়েছে আপনার জন্য।

বহুল প্রচলিত ডিশগুলোকেই সৃজনশীলতার অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে অ্যালেনিয়া। প্রথা ভাঙা পিনাট বাটার অ্যান্ড জেলি, সালাদ সেন্টার পিস, পটেটো ট্রাফল এক্সপ্লোশন, ক্লিয়ার পামকিন পাই কিংবা ল্যাম্ব এইট্টি সিক্স। প্রতিটি ডিশই ধাক্কা দেবে আপনার চিন্তায়। এটুকুই যদি যথেষ্ট মনে করেন তাহলে অ্যাজাৎসের ফাঁদে পা দিয়ে বোকা বনেছেন আপনি। মাইন্ড খেলা যার নিত্যকার অভ্যাস- এটুকুতেই দমে যাবেন তিনি? স্ট্রবেরির রূপে টমাটোর ডিশ কিংবা চেরির মতো দেখতে স্ট্রবেরি চূড়ান্ত পরীক্ষা নেবে আপনার কল্পনাশক্তির। অ্যালেনিয়ার সবচেয়ে বড় মজা হচ্ছে, অজান্তেই আপনার সামনে রান্না হবে খাবার। জলন্ত আগুন যেটিকে আপনি শুধুই শোভাবর্ধনের অংশ ভেবে বিমোহিত হচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে ওই আগুনের নিচেই রান্না হচ্ছিল আপনার চাহিদার খাবার!

অবশ্য অ্যালেনিয়ার সবচেয়ে বড় বিস্ময়টি হচ্ছে এর টেবিল ডেজার্ট। আর্ট গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে যে বিষাদে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরেছিলেন অ্যাজাৎস থেকে সেটিকেই পরে রূপান্তর করেছেন কালিনারি ওয়ান্ডার-এ। সব জমাট চিত্রনাট্যেই একটা ‘টুইস্ট’ থাকে। অ্যাজাৎসও এর ব্যতিক্রম নন। ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই অ্যাজাৎস জানান তার শরীরে বাসা বেঁধেছে লেভেল ফোর ওরাল ক্যানসার। প্রাথমিক অবস্থায় ডাক্তার যা বলেছিলেন এতে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। তিনি চিরতরে হারিয়ে ফেলতে পারতেন খাবারের স্বাদ বোঝার ক্ষমতা। ভগ্ন হৃদয়ে অ্যাজাৎস যখন পরাজয় মেনে নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই আবার দৃশ্যপটে পার্টনার নিক। তিনি যোগাযোগ করলেন ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো মেডিকেল সেন্টারের সঙ্গে। বাধ্য করলেন গ্রান্টকে কেমোর মুখোমুখি হতে। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর ডাক্তাররা গ্রান্টকে ঘোষণা করলেন ক্যানসারমুক্ত হিসেবে।

অ্যালেনিয়ার সিগনেচার ডিশ

ফিরে এসে বিশ্রাম নিয়েছে ভাবছেন? না, বরং একের পর এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন ওই বিশ্ব বিখ্যাত শেফ। তিনটি মিশেলিন স্টার শেফের তিনটি মিশেলিন স্টার পাওয়া ওই রেস্টুরেন্টটি ভোজনরসিকদের উপহার দিয়ে যাচ্ছে ‘পিচ উইথ কাভা’, ‘বাসিল’, ‘মারে’, ‘রিভারসল্ট’, ‘স্প্যানিশ টাপাস’, ‘স্টলহেড রো উইথ ইংলিশ পি’, ‘অলিভ অয়েল’, ‘চ্যামোমিল’, ‘গ্রাফিতি, ‘ক্যারট স্প্রে’, ‘ওয়াইল্ড মাশরুম’, ‘বেকন উইথ বাটারস্কচ’, ‘অ্যাপল অ্যান্ড থাইম’’, ‘ল্যাম্ব উইথ ক্যাপার লিভস’, ‘গ্রেপস অ্যান্ড অলিভস’’, ‘চিজকেক’, ‘ট্রপিকাল ফ্রুট উইথ রাম ভ্যানিলা’, ‘ক্যাফিয়ার লাইম’-এর মতো মুখরোচক সব খাবার।

ব্ল্যাক ট্রাফল এক্সপ্লোশন

যুগে যুগে বহু শেফ রন্ধন শিল্পটাটিকে নিয়ে গিয়েছেন ভিন্ন উচ্চতায়। কিন্তু সবার মধ্যে গ্রান্ট অ্যাজাৎসের নামটি আসবে আলাদাভাবে। শুধু ক্যানসার থেকে ফিরেছেন বলেই নন, বরং রান্না যে একটি শিল্প তা নতুন করে নতুনভাবে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। রূপের থেকে শুধু বিষাদই নয়, কখনো কখনো বিস্ময়ও জন্ম নেয়। এর জ্বলন্ত প্রমাণ অ্যাজাৎসই। তাই তাকে রন্ধন শিল্পের পিকাসো বললে কোনাে অংশেই অত্যুক্তি হয় না।