ভারতে এক বছরে ৬ কোটিরও বেশি ‘সম্ভাব্য কন্যা সন্তান’ হত্যা

ভারতে এক বছরে ৬ কোটিরও বেশি ‘সম্ভাব্য কন্যা সন্তান’ হত্যা

ভ্রূণ হত্যা পৃথিবীর কোনাে দেশেই স্বীকৃত নয়। এটি আইনত অপরাধ ও অমানবিক কাজ। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে হরহামেশাই। তবে ভারতে এর পরিমাণ আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। ভারতীয় সমাজে লিঙ্গবৈষম্য ভ্রূণ হত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। সেখানে ছেলে সন্তানদের গণ্য করা হয় সম্পদ ও আলো হিসেবে এবং মেয়েদের ধরা হয় অযাচিত। গর্ভে থাকা সম্ভাব্য কন্যাসন্তানকে অনেক পরিবার জন্মের আগেই লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষা করে গর্ভপাতের মাধ্যমে মেরে ফেলে।

ভারতের একটি সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভারতের জনসংখ্যায় ছেলে ও মেয়েদের তারতম্য আশঙ্কাজনক। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা  হয়,  প্রতি ১০০ জন মেয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করলে ছেলে সন্তান জন্ম নেয় ১০৭.৬ শতাংশ।

ভারতের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭-১৮-এর তথ্য মতে, মেয়ে সন্তান ভারতে ‘জাতীয়ভাবে অযাচিত’। ওইসব পিতা-মাতার ধারণা, ছেলেরা যেহেতু পরিণত বয়সে উপার্জনক্ষম হয় মেয়েরা পরের ঘরে চলে যায় এবং সঙ্গে নিয়ে যায় যৌতুক যা পরিবারের জন্য অলাভজনক সেহেতু ছেলে সন্তানের প্রয়োজন বেশি।

সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের অনেক বিবাহিত দম্পতি ছেলে সন্তান না পাওয়া পর্যন্ত সন্তান নিতে থাকেন এবং গর্ভের সন্তান মেয়ে হলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দেখতে দেয়া হয় না পৃথিবীর আলো। তাদের ছেলে সন্তান নেয়ার ওই প্রবণতার স্বীকার হয় প্রায় ২১ মিলিয়ন অযাচিত মেয়ে সন্তান। তাদের ওই ছেলে সন্তানের আশায় সন্তান নিতে থাকা এবং লিঙ্গ নির্ধারণের পরীক্ষা করে ভ্রূণ হত্যার ফলে ভারতে প্রায় ৬ কোটি ৩০ লাখ নারীর অনুপস্থিতি ঘটেছে।

হিউম্যান লাইফ ইন্টারন্যাশনাল-এর মিলাগ্রেস পেরেইরা ‘লাইফসাইট নিউজ’কে একবার ইমেইল-এ লেখেন, ‘আমার বাড়ির দুই মাইল দূরেই এক শিক্ষিত চাকরিজীবী দম্পতি বসবাস করেন যারা ছেলে সন্তানের আশা পূরণ না হওয়ায় লিঙ্গ নির্ধারণের পর তিনবার গর্ভপাত করান।’

অবশ্য ভারতের সব হাসপাতালেই স্লোগান দেখা যায়, ‘সন্তান জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ অপরাধ’। এ জন্য আইন ও জেল-জরিমানার ব্যবস্থা থাকলেও কেউ এসবের ধার ধারেন না।

পেরেইরা বলেন, ‘ভারতের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মেয়ে শিশুদের মুখে চামচভর্তি আঁকাড়া চাল পুড়ে দেয়া হয় যেন চাল ভিজে গলায় আটকে থাকে এবং সন্তান দম আটকে মারা যায়। এটি ভয়ানক শোনালেও সত্যি।’

‘অ্যাবরশন ফ্রি নিউ মেক্সিকো ফাউন্ডেশন’-এর তারা শেভার বলেন, ‘ভারতের জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের জন্ম হারের বৈষম্যের পেছনে দায়ী আধুনিক যুগের নিয়ন্ত্রিত প্রজনন ব্যবস্থা। মানুষের মূল্য কম বা বেশি অথবা কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গকে সমাজের বোঝা ভাবা- ওই ধারণার তীর্যক প্রতিফলনই দেখা যায় ভারতের নারী-পুরুষের জন্ম হারের বৈষম্যের ওপর।’

ভারতের ওই ভ্রূণ হত্যা চর্চার নিন্দা জানিয়ে ড. মাইকেল পারকার বলেন, ‘তারা একটি লিঙ্গ বা নারীদের বেঁচে থাকার জন্য অনুপযুক্ত মনে করে। ক্যাথলিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ওই চর্চার তীব্র নিন্দা জানায়। লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেক শিশুরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে।’

এভাবে একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের হত্যা দেখেও ভারতের ‘নারী অধিকার’-এর আইনজীবীরা নিশ্চুপ। নিউ জার্সির ‘রাইট টু লাইফ’-এর ম্যারি ট্যাসি ওই বিষয়ে প্রশ্ন করেন- ‘কেন ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ নারীবাদীরা শৃঙ্খলিত লিঙ্গীয় হত্যার ওই নিষ্ঠুরতার বিরূদ্ধে আন্দোলন করছেন না?’

সেক্রোমেন্টোর আইনজীবী মেগান ফেরা বলেন, ‘লিঙ্গ কেন্দ্র করে গর্ভপাতের ওই চর্চা একটি লিঙ্গভিত্তিক বিশ্বাসের সমর্থন দেয়। তাদের ধারণা, মেয়েদের বেঁচে থাকতে হলে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। যারা নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাসী তাদের উচিৎ ওই চর্চা বন্ধ করার জন্য আওয়াজ তোলা।’

রাইট টু লাইফ অফ গ্রেটার সিনসিনাতির নির্বাহী পরিচালক পলা ওয়েস্টউড বলেন, ‘গর্ভপাতের প্রধান শিকার বানানো হয় শিশু মেয়েদের। নারীবাদী প্রত্যেক কর্মীর উচিৎ তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। কিন্তু সবাই নিশ্চুপ। কারণ কোনো শিশুর জীবন বাঁচানো অপেক্ষা গর্ভপাতের দেবতার উদ্দেশ্যে তাদের ওই ত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ।’

হার্টবিট ইন্টারন্যশনাল-এর প্রেসিডেন্ট জর-এল গডসের মতে, গর্ভপাত হচ্ছে নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম উদাহরণ। শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে কোনো শিশু হত্যা কাম্য নয়। প্রত্যেক নারীর জন্মানোর অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক মায়ের অধিকার রয়েছে তার সন্তানকে দেখার।