ভারতীয় অাধিপত্যের বিরুদ্ধে আরো এক ধাপ এগোলো নেপাল

ভারতীয় অাধিপত্যের বিরুদ্ধে আরো এক ধাপ এগোলো নেপাল

নেপালের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সেখানকার দুই ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট (ইউএমএল) ও মাওবাদী কেন্দ্র গতকাল নিজেদের একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর দলটির নাম হবে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল’ (সিপিএন)।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে দুই দলের মিলিত হওয়ার এমন ইতিহাস অবশ্য নতুন নয়। এর আগে এমন ঘটনা বহুবারই দেখা গেছে। কিন্তু এর মধ্যেও নেপালের দুই ভিন্নধারার কমিউনিস্ট পার্টির এক সঙ্গে মিলিত হওয়া নেপালের স্থানীয় রাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য এক আলাদা তাৎপর্য বহন করে।

নেপালের গণতন্ত্রের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। ১৭৬৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশের এ দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে দেশটি রাজতন্ত্রের অধীন ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রথম নেপালে রাজতন্ত্রের পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়।  চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত মাওবাদীরা সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে রাজন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। গণঅভ্যুত্থানের ফলে ধীরে ধীরে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস পায়। পরবর্তীকালে ২০০১ সালের ১ জুনে তৎকালীন রাজা বিরেন্দ্র বির বিক্রম শাহ দেব ও তার পরিবারের সদস্যরা যুবরাজ দিপেন্দ্র-এর দ্বারা ব্রাশফায়ারে নিহত হন। এরপর ক্ষমতায় আসেন রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্র বির বিক্রম শাহ দেব । প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে তিনি সাতদলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে বাধ্য হন। এরপরই নেপালের রাজতন্ত্র বাতিল করা হয়।

১৯৯১ সালের ৭ মে সাধারণ ভোটে রাজতন্ত্রের অধীন নেপালে প্রথম পার্লামেন্ট গঠিত হয়। অবশ্য ১৯৯৮ সালেই সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ওই পার্লামেন্ট ভেঙে যায়। মূলত এরপর থেকেই চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। গত ১০ বছরে বেশ কয়েকবার ভেঙেছে সংসদ। এর বেশিরে ভাগই হয়েছে বাইরের কোনো শক্তির ইশারায়। কিছুদিন আগেই কেপি শর্মা ওলি-র নেতৃত্বাধীন  ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টির (ইউএমএল) সরকারের পতন হয়। ওই ঘটনায় নেপালিরা সরাসরিই ভারতকে দোষারোপ করে। তাই দুই কমিউনিস্ট পার্টির একীভূত হওয়ার ফলে ওই চলমান অস্থিরতা কমে আসবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে ওই ঐক্যের ফলে নেপালের বর্তমান ভারত বিরোধী অবস্থানের পালেও বইবে জোর হাওয়া।

১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই নেপালের স্বৈরতান্ত্রিক রানা বংশের শেষ প্রধানমন্ত্রী শমসের বাহাদুর রানার নেতৃত্বে তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুত্থানের হাত থেকে নিজেদের রাজবংশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা স্বরূপ ভারতের সঙ্গে ‘শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি’ নামে এক প্রবল অসম চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এরপর থেকেই ভারত বিভিন্নভাবে নেপালের ওপর নিজের কর্তৃত্ব জাহির করে আসছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে নেপালের বামপন্থী সরকার ওই দেশে ভারতের একক আধিপত্য অমান্য করে চলেছে। ২০১৫ সালে নেপালের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে ভারতের সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হয়। ওই সংবিধানে নেপালের রাজতন্ত্র ও হিন্দু রাষ্ট্রের তকমা পুরোপুরি মুছে ফেলার প্রস্তাব করা হয়। এর রেশ ধরে নেপালের ওপর অঘোষিত বাণিজ্য অবরোধ আরোপ রেখেছিল ভারত। নেপালও পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতীয় টিভি চ্যানেলসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞ আরোপ করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকেই নেপাল চরম বিপাকে পড়লে ওই সময় কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন সরকার শেষ পর্যন্ত চীনকে বিকল্প বাণিজ্য বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। এর আগে প্রচন্ড-এর নেতৃত্বাধীন সরকারও ক্ষমতায় থাকাকালীন চীনের সঙ্গে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বুড়ি গান্ধকী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি করেছিল। তাছাড়া চীনের ‘ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড’ মহাপ্রকল্পের জন্য নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য মুখিয়ে আছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নেপাল-ভারত বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র বিরগঞ্জের গুরুত্ব অনেক অংশেই কমে যাবে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ভারত-নেপালের সম্পর্কের ওপর। এদিকে নির্বাচনের আগেই কেপি শর্মা ওলি আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে ১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল করে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক ঘরে তুলবেন।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রচন্ডের মাওইস্ট সেন্টারের সঙ্গে ওলির ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টির একীভূত হওয়ার ফলে ভারতের বলয় থেকে স্পষ্টতই নেপাল সরে গেল এবং বিগত নির্বাচনে বিজয়ী ওই নির্বাচনী জোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেল। আন্তর্জাতিক মহলে ওই দু’নেতাই ভারত বিরোধী বলে পরিচিত। তাই সিদ্ধান্তের পর যে ভারতকে পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গে সিপিএন পরিচালিত সরকার সম্পর্ক গড়ে তুলবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মূলত ৭টি মতাদর্শিক বিষয়ের ওপর ওই দুই কমিউনিস্ট দল একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে তাদের আর আলাদা সংগঠন থাকবে না। সিপিএন নামে একই দলের মধ্যেই সাংগঠিক কার্যক্রম পরিচালনে করবে। এছাড়া সাবেক দুই দলের দুই শীর্ষ নেতা মাওবাদী কেন্দ্রের কমরেড পুষ্প দহল কমল প্রচন্ড ও ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টির প্রধান কেপি শর্মা ওলি পালাক্রমে দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন এমন একজন হলন আদিত্য অধিকারি। ওই ঐক্য নিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি বিরল ঐক্য। দুটি আলাদা পরিবেশে রাজনীতি করা দুটি দলের এভাবে একীভূত হওয়ার ঘটনা দেখা যায় না। তারা যদি ওই ঐক্য বজায় রাখতে পারেন তাহলে তা ভবিষ্যৎ নেপালের রাজনীতিতে এক নতুন পরিবর্তন আনবে।’

অন্যদিকে ওই ঐক্যে শামিল হয়নি নেপালের অন্যতম বড় মাওবাদী সংগঠন কমরেড নেত্র বিক্রম চাদ বিপ্লবের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (সিপিএন)। তারা ওই ঘটনাটিকে সংশোধনবাদের চূড়ান্ত রূপ বলে দুই বুর্জোয়া শক্তির মিলন নামে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে নেপালের জনগণের কোনো উন্নতি হবে না।

উল্লেখ্য, চাদ বিপ্লবের নেতৃত্বে সিপিএন এখনো নেপালে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রেখেছে।

নেপালের নির্বাচনের ঠিক আগে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘নির্বাচনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে, বিশেষত নেপালের কাকরভিটা থেকে মাত্র ৫৪ কিলোমিটার দূরে থাকা বাংলাদেশের আঞ্চলিক সম্পর্কের ওপরও।’