গোটা ক্রীড়া জগতে তার চেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী চরিত্র দ্বিতীয়টি নেই। দেশের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেও তার মতো দেখা যায়নি কাউকে। আফিগানিস্তান-নেপালের মত দলগুলোও যখন বাংলাদেশকে হারের স্বাদ দেয়া শুরু করেছিলো তখনই দলের হাল ধরেন তিনি। শুধু হাল ধরেই ক্ষ্যান্ত দেননি। সঠিক নির্দেশনায় দলকে ভিড়িয়েছেন এমন সব তীরে একসময় যা শুধু কল্পনাই মনে হতো। ভারত-পাকিস্তান-আফ্রিকাকে ঘরের মাটিতে উদোম করেই থামেননি, বিদেশে গিয়েও বাংলার পতাকা উড়িয়েছেন সগৌরবে। দলকে প্রথমবারের মতো তুলেছেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি ফাইনালে।
শেষ বছর শ্রীলঙ্কা সফরে যখন বোলিং করার আগে ট্রাউজারটা হাটুর ওপরে তুললেন অঝোরে অশ্রু ঝরেছে অসংখ্য তরুণ ক্রিকেট ভক্তের নয়ন থেকে। তার পরিচয় দিতে হবে? তিনি একজনই, মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশের সমান যার কলিজা। সেই সিরিজ থেকেই শুরু গোলমালের। বাংলার ক্রিকেটকে যিনি নিয়ে গেলেন নতুন উচ্চতায়, কথিত যে দলের আরেক সিনিয়র খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার বাঁচাতে নিজের ক্যারিয়ারটাকেই বিসর্জন দিলেন তিনি। শেষ ম্যাচের সে দৃশ্যরগুলোর কথার পুনরাবৃত্তি নাই করি আর।
এমন নিদারুন অবহেলার পরেও মানুষটি কেমন যেন আশ্চর্য রকমের। দেশের হয়ে খেলার তারনায় যেন কোনো অবহেলাকেই অবহেলা মনে হয় না তার। তাই, দলের হতাশাজনক বোলিং পারফরম্যান্স দেখে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন ঝুকি নিয়ে হলেও টেস্টে ফেরার। লঙ্কার বিপক্ষে তার হাটুর সে দৃশ্যটি যদি আপনার মনে থাকে তাহলে মাশরাফির ওপর আপনার রাগ হতে বাধ্য। এত অবহেলার পরেও এমন ঝুঁকি নিতে চায় কেউ? কিন্তু দেশের প্রতি তার এই অন্ধ ভালোবাসা ভক্তদের চোখে অশ্রুর জন্ম দিলেও অন্ধ হয়েছিলেন বোর্ড কর্তারা। কি নিদারুন নিষ্ঠুরতায় সামান্য সৌজন্য ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করলেন সে প্রস্তাব। যে মানুষটির জন্য বাংলাদেশকে এখন সমীহের চোখে দেখে ক্রিকেট বিশ্ব এই আচরণ কি তার প্রাপ্য ছিলো? বরাবরই বিস্মিত করা মাশরাফি এ ব্যাপারে টু শব্দটিও করেননি। হয়তো বুকের মাঝে ক্ষরণ হয়েছে, তবে তা বুঝতে দেননি কাউকেই।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। যে মাশরাফিকে এক রকম ছুড়ে ফেলা দেয়া হয়েছে টি টোয়েন্টি দল থেকে আজ সে মাশরাফিকেই ফেরানোর তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লঙ্কা সিরিজ শেষে বলেছিলাম যে সিরিজটিতে মাশরাফির অভাব বোধ করেছে বাংলাদেশ। হাথুরুর প্রেস্কিপশনে যে মাশরাফিকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিলো সেই হাথুরুর হাতেই দুমরুশ হবার পর মাশরাফির শূণ্যতা অনুধাবন করছেন বোর্ডপ্রধান? গতি নেই বলে যাকে বাদ দিতে দুবার চিন্তা করা হলো না, আচমকাই তিনি হয়ে উঠলেন নতুন বলের এক কার্যকর বোলার! সত্যিই সেকুলাস।
মাশরাফিকে নাকি দলে ফেরার জন্য অনুরোধ করা হবে। এ প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে ভালো, তবে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে মাশরাফিকে ফেরানোর চেষ্টা চলছে কি শুধুই খেলোয়াড় হিসাবে? বাংলাদেশ তো দূর, পুরো ক্রিকেট দুনিয়াতেই কে আছে যে মাশরাফির মতো দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবে? সাকিবের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি বিশ্বের সেরা অল-রাউন্ডার হতে পারেন কিন্তু অনুপ্রেরণাদায়ী হিসাবে মাশরাফির সমকক্ষ তো দূর, কাছাকাছিও না। তাই, একান্তই যদি মাশরাফিকে ফেরানো হয়, তবে পুনোরায় অধিনায়কের পদেই ফেরানো উচিত। নতুবা, অহেতুক এই সূর্যসন্তানকে আরো একবার অপমানের কোনো মানে হয় না।
বিপিএল শেষেই জবান প্রশ্ন তুলেছিলো যে, সময়ের আগেই মাশরাফিকে অবসর নিতে বাধ্য করলো কি না বোর্ড? অবশেষে বোর্ডপ্রধান নাজমুল হাসান পাপনের অনুধাবনে জবানের কথা কবুলেরই প্রতিফলন দেখা গেল। আমরা অবশ্যই চাই মাশরাফি ফিরে আসুন, কারণ এখনো দলকে তার বহুকিছু দেয়ার আছে। তবে, সেটি যদি বোর্ড তাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে পুনরায় অধিনায়কের পদে বহাল করে ফেরায় তবেই। নতুবা, আমরা আবারো মাশরাফিকে হেনস্তা হতে দেখতে চাই না। কারণ, মাশরাফি শুধুই একজন খেলোয়াড় নন, অামাদের একটি আবেগের নাম। আর এই আবেগ নিয়ে খেলার ধৃষ্টতা জনগণ বারবার সহ্য করবে না।