আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তরুণ-তরুণীরা। কিন্তু সে স্বপ্নে বারবার অন্ধকার ঘিরে আসে যখন চাকরির আলাপ আসে। কেবল ভাল ফলাফল দিয়েই চাকরি মিলছেনা আজ, থাকতে হচ্ছে অভিজ্ঞতা, জোর দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রমসহ নানা বিষয়ে। ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন সঙ্কট, তরুণরা হারাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। কিন্তু সারাবিশ্বে চলমান চাকরির বাজারের এই পুরনো ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে চান এমনই একজন হলেন ড্যানি ইয়াং।
ড্যানি ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম শ্রেণী অর্জন করে আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এ ফিনান্সিয়াল ট্রেডার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৭ সালে। যোগদান করেই তিনি বুঝলেন তার এই প্রথম শ্রেনি অর্জনের সাথে তার কর্মক্ষেত্রের শিক্ষার তেমন কোন মিলই নেই। তিনি তখন নিজেকে প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নির্বোধ কর্মচারী মনে করতেন। ফলে নিজের কাছেই নিজেকে নির্বোধ লাগতে থাকলো ইয়াং এর। ট্রেডিং বিষয়ে তার জ্ঞান শূন্য থাকায় হাতে কলমে তিনি তার কাজ নতুন করে শিখতে শুরু করেন।
যেকোন কর্মজীবির ক্ষেত্রে ঘটনাটা খুবই পরিচিত কারণ পেশাদারি ক্ষেত্রে অনেকেরই পড়তে হয় এরকম দুরাবস্থায়। শুধু মাত্র ডাক্তার, আইনজীবী অথবা শিক্ষকতা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন ধরণের সামঞ্জস্য থাকে না। যেমন প্রসাশনিক, বিক্রয়, ব্যবস্থাপনা এমনকি সাংবাদিকতায়ও দেখা যায় অর্জিত জ্ঞানের সাথে কর্মের বিরাট তফাত। অনেকেই ইঞ্জিনিয়ার হয়েও সাংবাদিকতা করে অথবা বায়োকেমিস্ট্রি পড়ে হয় ব্যাংকার। বেশিরভাগ সময়ই চাকরির ক্ষেত্রে আমরা কি নিয়ে স্নাতক করেছি সেটা যেন কোন হেতুও নয়।
তার ওপর চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে আবশ্যিক শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয় তার কারণ কী, এর উত্তর আমাদের কাছে একটাই, ‘এভাবেই তো সব চলছে’!
কিন্ত সবাই এই উত্তরে সন্তষ্ট হলেও ড্যানি ইয়াং চিন্তা করেন একদমই আলাদা ভাবে। তার মতে প্রচলিত এই নিয়ম ভুল। তাই তিনি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ট্যানজেন্ট’ নামের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ট্যানজেন্ট তারই প্রতিষ্ঠিত ‘মেজোরিটি ট্রাস্ট’ এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
তার মতে নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সবার আগে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মীদের পর্যবেক্ষণ করে নির্ধারণ করা যে প্রতিষ্ঠান প্রার্থীদের কাছে কি দাবি করে। এই প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য কর্মীদের মধ্যে কি কি গুণ থাকা চাই। তারপর খুজতে হবে নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যগুলো কোন প্রার্থীর সাথে মিলে। ফলে স্বভাবতই সেই চাকরি-প্রার্থীর ডিগ্রি-ফলাফল-অভিজ্ঞতাকে আমলে নিতে হচ্ছে না।
কিন্তু কিভাবে এই দুঃসাধ্য সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই বাছাই-কার্য পরিচালনার জন্যে ট্যানজেন্ট এর রয়েছে একাটা অতি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া। প্রথমত তারা উক্ত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি সাইকোমেট্রিক পরীক্ষা গ্রহণ করবে যার মাধ্যমে সেই কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির খোঁজে সবার সকল বৈশিষ্ট্য একটি মলাটে আনা হবে। এবং পরে এই একই পরীক্ষা চালানো হবে প্রার্থীদের উপর। ফলে সহজেই সেই গুণগুলির সাথে মিলিয়ে নিলেই পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল।
প্রশ্ন জাগতে পারে, কি কি বৈশিষ্ট্যকে আমলে নেয়া হয় এই সাইকোমেট্রিক পরীক্ষায়। মূলত উচ্চাকাঙ্খা, চতুরতা, সৃজনশীল ব্যাক্তিত্ব, কৌতুহল, সিদ্ধান্তহীনতা, আবেগপ্রবণতা, বুদ্ধিমত্তা, সৃষ্টিশীলতা, মানসিক দক্ষতা, ধৈর্য্য, ঝুঁকি নেয়ার মনোভাব, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ, দলগত কাজ, কাজের নৈতিকতা ইত্যাদি। যেকোন একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্যে সাইকোমেট্রিক পরীক্ষায় চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে এই সকল বৈশিষ্ট্য খোঁজা হয়।
তাহলে এই বৈশিষ্ট্যগুলো কি আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ? হ্যা, ড্যানি নিজে তাই মনে করেন। এবং তার প্রতিষ্ঠান ‘ডাইমন এশিয়া’ এই তালিকার উপর ভিত্তি করেই কর্মী নিয়োগ করছে। ২০০৮ সালে ড্যানি, ডাইমন এশিয়া ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠিত করেন। ডাইমন এশিয়া হবে ‘ট্যানজেন্ট’ এর প্রথম কর্মকর্তা-গ্রহীতা।
ডাইমন এশিয়া প্রতিষ্ঠান নিজেও প্রচলিত নিয়মের মতই বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় স্নাতকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিন্ত এবার এর ব্যতিক্রম ঘটাবেন ড্যানি কারণ তার ট্যানজেন্ট এর কর্মী নিয়োগের এই পরিকল্পনায় শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়া হবে কম। ড্যানি মনে করেন এই প্রক্রিয়া শুধু প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্যেই না, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারাও উপকৃত হবে যারা প্রচলিত নিয়মের বাইরে যেয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে চায়। কারণ তিনি মনে করেন সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে এই সকল সূযোগ থেকে বঞ্চিত হয় শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির অভাবে।
কিন্ত কিভাবে ড্যানির মাথায় আসলো এই অপ্রচলিত ব্যতিক্রমধর্মী প্রক্রিয়া। আসলে নানইয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র আইজ্যাক মুং এর বাবা মারা যায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে, মা ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত। ফলে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে থাকা আইজ্যাককে ডাইমন এশিয়াতে কাজ করার সূযোগ দেন ড্যানি এবং কাজের জন্যে আইজ্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অথচ আজ আইজ্যাক মুং ডাইমন এশিয়ার সেরা গবেষণা বিশ্লেষক।
তাই যদি ‘ট্যানজেন্ট’ সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তাহলে সফলতার প্রচলিত সংকীর্ণ সংজ্ঞা পালটে যাবে। বিরাজমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের একটা প্রচলিত সরু মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছে। এবং সবার ছুটে চলা শুধু এখন শুধু আপাত সফলতার পেছনে। বাক্সবন্দী এই ছুটে চলার গতিকেই বদলে দিতে চায় ড্যানি ইয়াং এবং তার ট্যানজেন্ট।