কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে লড়াই-বিভেদ বেশ পুরনো। আজ একজনকে কেউ বলছেন তার কবিতা হচ্ছে না, কাল অন্যজনকে আরেকজন বলছেন তার উপন্যাসের প্লটে ঝামেলা আছে কিংবা কেউ তুলে আনছেন ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা করছেন আক্রমণ। আজকাল সামাজিক মাধ্যমে এসব হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগে কবি-সাহিত্যিকদের বিরোধিতা এবং ওই তর্কাতর্কি ছিল অনেকটাই খোলামেলা। এছাড়া ওই বিরোধ কারো কারো তো ছিল প্রায় বারোমাসি। এ রকম ঐতিহাসিক কিছু বিরোধ দেখা যাক—
জন লে কার ও সালমান রুশদি
দ্বন্দ্বের শুরু হয় ১৯৯৭ সালে যখন গার্ডিয়ান-এর চিঠিপত্র বিভাগে জন লে কার অভিযোগ আনেন, ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ অবস্থানের কারণে তাকে আমেরিকার পাঠকরা অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছেন।
অভিযোগের জবাব দেন সালমান রুশদি। তিনি বলেন, “আমি তার প্রতি সহানুভূতি জানাই। কিন্তু তিনিও তার মতােই এক লেখককে নিন্দা করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ‘দি স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার দায়ে আমার ওপর যে ইসলামপন্থীদের আক্রমণ হয়েছিল ওই আক্রমণকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছিলেন লে কার।”
এর উত্তরে লে কার জানান, “রুশদির ওপর করা আক্রমণের বৈধতা নিয়ে আমার কোনাে সমর্থন ছিল না। আমি ছিলাম ধর্মের পক্ষে। কোনো আইনই বৈধতা দেয় না এমন মহৎ ধর্মকে অপমান করার।”
পরবর্তীকালে ২০১১ সালে দু’জনই নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক করে নেন। অবশ্য লে কার-এর বইয়ের প্রশংসা করে শুরুটা করেছিলেন রুশদিই। পরে লে কার ‘দি টাইমস’-এ লেখেন, “আমি অনুতপ্ত যে, আমরা এমন একটা বাজে তর্কে লিপ্ত ছিলাম। রুশদির সাহসের প্রসংশা করি এবং তার অবস্থানের প্রতি সম্মান জানাই।”
জন কিটস ও লর্ড বায়রন
জন কিটস ও লর্ড বায়রন-এর মধ্যকার বিরোধটিকে বিরোধ না বলে শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলা যেতে পারে। বায়রন ছিলেন উন্নাসিক ও উচ্চবিত্ত। অন্যদিকে কিটস ছিলেন নিতান্তই মধ্যবিত্ত। ফলে বায়রনের সফলতা কিটস-কে ঈর্ষান্বিত করতাে সব সময়। কেউ কারো কাজের প্রশংসা করতেন না। জন কিটস উচ্চতায় বেশ খাটো। একবার বাইরনের একটি কাজের ইতিবাচক সমালোচনা শুনে তিনি মন্তব্য করেন, ‘৬ ফিট লম্বা একজনের লর্ড হওয়ার কত সুবিধা!’
অপমান শুনে বায়রনও বসে থাকার পাত্রনেন। তিনিও একবার এডিনবার্গ-এর এক কলামে কিটস-এর প্রসংশা দেখে তার বন্ধুকে লিখলেন—
“বদমাশ কিটসের প্রশংসা করেছনে এডিনবার্গ। অভিনেতা শেরিডান যখন পেনশন পান তখন জনসন বলেছিলেন, ‘শেরিডান পেনশন পেয়েছে? তাহলে এখনই আমার উচিৎ আমারটা ছেড়ে দেয়া।’ আর এডিনবার্গ এই পর্যন্ত যত মানুষের প্রশংসা করেছেন, আজ কিটসের প্রশংসা করে তিনি বাকি সবাইকে অপমান করলেন। এখন এডিনবার্গ-এর তো ‘সলোমনের সুস্বাস্থ্য গাইড’-এরও প্রশংসা করা উচিৎ, তাই না? এটি তো কিটসের কবিতার চেয়ে ভালো।”
এভাবে উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্য দিয়েই চলতাে তাদের বৈরিতা। অবশ্য জন কিটস কম বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন- মাত্র ২৫ বছর বয়সে। অন্যদিকে বায়রন বাঁচেন মাত্র ৩৬ বছর। বেঁচে থাকলে হয়তো দু’জন আরো বিবাদে জড়াতে পারতেন বা পারতেন বন্ধুত্বের বাঁধনে আঁটকে যেতে।
আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে ও স্কট ফিতজেরাল্ড
আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে ও ফিতজেরাল্ড-এর প্রথম দেখা হয় ১৯২৫ সালে। খুব দ্রুতই তারা বন্ধু হয়ে ওঠেন। হ্যামিংওয়ে-কে ফিতজেরাল্ড বেশ প্রতিভাবান সাহিত্যিক পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু বেশিদিন টেকে না তাদের এই বন্ধুত্ব। এরপর থেকে ফিটজেরাল্ডকে হ্যামিংওয়ে নানানভাবে অপবাদ দিতে থাকেন। ফিতজেরাল্ড-এর মৃত্যুর ১০ বছর পর হ্যামিংওয়ে লিখেন—
“ক্ষয়িষ্ণু প্রতিভা ছাড়া ফিতজেরাল্ডের কোনাে কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা ছিল না। যদি তার যথার্থ শিক্ষা থাকত এবং একটু কম আত্মকেন্দ্রিক হতেন তাহলে তিনি হয়তাে তার প্রতিভা আরো কাজে লাগাতে পারতেন।”
ড্যারেক ওয়ালকট ও ভি এস নাইপল
২০০৮ সালে এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে ড্যারেক ওয়ালকট একটা কবিতা ‘দি মনগুজ’ পাঠ করেন। কবিতাটি শুরু হয় এভাবে—
‘আমাকে কামড়েছে। আমার ইনফেকশন এড়াতে হবে
নয়তাে আমি মরে যাব; নাইপলের উপন্যাসের মতোই।
তার শেষ উপন্যাসটা পড়লেই বােঝা যাবে যা বলছি আমি।’
নাইপল কি এমন করেছেন যে জন্য ওই কবিতা দিয়ে আঘাত করলেন ওয়ালকট? গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে, কয়েক বছর ধরেই ওই দুই লেখক একজন আরেকজনকে প্রিন্ট মিডিয়া বা সাক্ষাৎকারে গালমন্দ করে যাচ্ছেন। নাইপল-এর উপন্যাস ‘অ্যা রাইটার্স পিপল’-এ তিনি ওয়ালকট-এর উদ্দেশে বলেন, ‘একজন মানুষ যার অনেক প্রতিভা থাকলেও তিনি উপনিবেশিক ধারণা দ্বারা বেষ্টিত।’
ওই ধরনের অপবাদই ওয়ালকট-এর প্রভাবিত করে নাইপল-কে নিয়ে কবিতা লিখতে। ফলে ওই দু’জনের বিরোধ চলছেই।
মার্সেল প্রাউস্ট ও জা লরেইন
খুব কম সাহিত্যিকের বিরোধিতাই বন্দুকবাজি পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু ১৮৯৬ সালে প্রাউস্ট-এর ‘প্লেজারস অ্যন্ড ডেইজ’ বইয়ের পর্যালোচনায় প্রাউস্ট-কে উদ্দেশ্য করে লরেইন মার্সেল বলেন, ‘প্রাউস্ট নিজেকে সাহিত্য দিয়ে গর্ভবতী করে ফেলেছে।’ এর কয়েক মাস পরই লরেন আবারও আঘাত করেন প্রাউস্টকে। কিন্তু এবার ছদ্ম নামে। এবার তিনি বলেন, ‘প্রাউস্ট প্রেমে মজে আছে লুসিয়েন দোদেট-এর সঙ্গে।’ এছাড়া প্রাউস্টকে ‘গে’ বা সমকামী বলেও দাবি করেন তিনি। এরপরই লরেনকে অস্ত্রের বাজিতে যোগ দেয়ার চ্যালেঞ্জ জানান প্রাউস্ট। যে খেলায় শেষমেশ একজনকে গুলি খেয়ে মরতে হয়। অবশ্য ওই খেলা শেষে দু’জনই বেঁচে যান। কারণ দু’জনের গুলিই লক্ষভ্রষ্ট হয়।
উল্লেখ্য, শোনা যায় প্রাউস্ট ও লরেন দু’জনই সমকামী ছিলেন।
আলবেয়র কামু ও জাঁ পল সার্ত্রে
দু’জনই তৎকালীন সময়ের তুখোড় ও প্রভাবশালী দার্শনিক। অথচ মানুষের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ওই দুই বন্ধুর মত দু’ধরনের। দু’জনই সমাজতান্ত্রিক চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও চিন্তার পার্থক্য ছিল অভাবনীয়। এভাবেই দু’জনের বিরোধের শুরু। নোবেল পুরস্কার জেতার পর কামু একবার বলেছিলেন, ‘সার্ত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অসাধারণ। কারণ আমরা কেউ কারো মুখ দেখি না।’
এক অতর্কিত গাড়ি দুর্ঘটনায় কামু মারা গেলে সার্ত্রে ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন, কামুই ছিল তার শেষ বন্ধু। তাদের সম্পর্ককে ছোট এ ভিডিওটি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
Philosophy Feuds: Sartre vs Camus from Aeon Video on Vimeo.
বিখ্যাত ম্যাগাজিন লিটারারি হাব অবলম্বনে