ইতালি ও ভ্যাটিকান সিটিতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে সোমবার বিকালে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই সফর শেষে শনিবার ঢাকায় ফেরত এসে প্রধানমন্ত্রীর আয়োজিত সাংবাদ সম্মেলনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেনি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী, তার আশপাশের আমলা মহোদয়রা এবং রাজনৈতিক মুখগুলোও বেশ চেনা। এছাড়া মুখোমুখি আসনে বসা সিনিয়র সাংবাদিকদের মুখগুলোও ওই চিরচেনা, এমনকি প্রশ্নগুলোও চেনা ধাঁচের। সব মিলিয়ে বরাবরের মতোই একটি জাঁকজমকপূর্ণ সাজানো-গোছানো সম্মেলন উপহার পেল জাতি।
ওইসব সাংবাদ সম্মেলনের সবচেয়ে লোভনীয় অংশ থাকে সাংবাদিক নামের দলীয় জনসংযোগ কর্মকর্তাদের মজার মজার প্রশ্ন। আর ওইসব প্রশ্নের জবাবে যে সহাস্য উত্তর আমরা পাই তাকে বিনোদনের জুলুম বলা চলে। মানে, এতটা বিনোদন হজম করা সম্ভব হয় না অনেকের জন্যই।
অবশ্য সবকিছুকে যদি আমরা ঐতিহ্য হিসেবে নিতে পারি তাইলে কষ্ট পাওয়ার আর কোনাে কারণ থাকে না। প্রশ্নফাঁস থেকে ব্যাংক লুট- সবই আমাদের অখণ্ড ঐতিহ্যের অংশ হলে আর কোনাে সমস্যা হওয়ার সুযোগ থাকে না। সমালোচনারও কোনাে প্রয়োজন থাকে না।
শুরুতেই আসি প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নগুলােয়। মোটামুটি চলমান রাজনৈতিক সংকটের গলি ধরে খালেদা জিয়ার রায়-জেল-নির্বাচন হয়ে কিছু জাতীয় সংকট যেমন- চালের দাম, প্রশ্নফাঁস সবই আলোচিত হয়েছে। আমাদের প্রজ্ঞাবান সাংবাদিকরা নরম নরম প্রশ্ন আর প্রকাশ্য গুণমুগ্ধতা প্রদর্শনের সুযোগ পাওয়ার ‘উচ্ছ্বাস’-এ মূল আলাপটিই বেমালুম ভুলে গেছেন। অথচ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে আয়োজিত ওই সফর থেকে বাংলাদেশের কী অর্জন হলো।
সম্মেলনের এক পর্যায়ে যথারীতি খালেদা জিয়ার রায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী একটি মন্তব্য করেন, ‘রায় দিয়েছেন আদালত, সরকারের কিছু করার নেই।’ মূলত ৮ ফেব্রুয়ারি দাতব্য খাতের টাকা আত্মসাতের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া। অথচ ওই রায়ের আগে-পরে ‘যে কেউ দোষী হলে শাস্তি পাবে’ বলে যে ধরনের সহজ-সাপ্টা সমীকরণ সরকারি দল থেকে দেয়া হচ্ছিল ওই ‘শিশুতোষ’ সমীকরণ জনগণ তো দূরে থাক, সাংবাদিকরাও গিলছেন না। ফলে আজকের সম্মেলনেও সাংবাদিকরা নানানভাবে সেটিই আনতে চেয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যজুড়েও সেটির ছায়াই ছিল। তাই ওই রায় যে কেবলই ‘ইনসাফের রায়’ নয় এর আঁচ পাওয়া যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আজকের বক্তব্য থেকেই। তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া এখন যে অবস্থায় আছেন এতে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’ এদিকে এর সূত্র ধরে শেখ হাসিনা বলেন, কেউ নির্বাচনে না এলে তার দায় সরকারের নয়। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, ওই রায় এবং এর পুর্বাপর ঘিরে সরকারি দলের বার্তা-বিবৃতি জনগণ গ্রহণ করছে কি না।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি, খালেদা জিয়া গ্রেফতারের পর সারা বিশ্বে কোনাে প্রতিক্রিয়া হয়নি, কোনাে উদ্বেগ জানানো হয়নি। কিন্তু গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিয় গুতেরেস ওই গ্রেফতার কেন্দ্র করে উদ্বেগ জানিয়েছেন। মহাসচিবের মুখপাত্র ফারহান হক ওই বিশেষ বিবৃতিতে সব পক্ষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রাখার আহবানও জানান। তবে ওই বিবৃতিটিকে সরকার খুব বেশি আমলে নেয়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
খালেদা জিয়ার চলমান বিচার প্রক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এতিমের টাকা খেলে আদালতও শাস্তি দেন, আল্লাহও শাস্তি দেন।’ এর পাশাপাশি জনগণ এও জানতে চায় ব্যাংক খাতে হরিলুট হলে আদালতের শাস্তি কী। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক এবং সর্বশেষ ফার্মারস ব্যাংক থেকে খালেদা জিয়ার ওই দুই কোটির বহু গুণিতক লুটেরারা হজম করছে। এ বিষয়ে সরকারের পর্যবেক্ষণ আপামর জনতাকে জানাতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে স্বভাবতই জনগণকে ইনসাফ প্রশ্নে কোনাে আস্থার বার্তা দেয়া হয়নি ওই সাংবাদ সম্মেলনে।
সাংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নফাঁস বিষয়ে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নফাঁস রোধ করতে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুগ যুগ ধরেই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এ জন্য তিনি প্রযুক্তিকে দোষারোপ করেন। এ কারণে দরকার হলে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন উঠিয়ে দেয়ার কথা বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানান সময়ের বক্তব্যের সঙ্গে সামান্যতম কোনাে মিল নেই। গত সপ্তাহে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার প্রস্তাবও করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এমনকি কোচিং সেন্টারগুলো পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। কেবল বন্ধ করা যায়নি প্রশ্নফাঁস। প্রধানমন্ত্রীর দাবি মতে, এতে মন্ত্রী-সচিবের কোনাে দায়বদ্ধতার জায়গা নেয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে বিচার করবেন। মন্ত্রী-সচিব অর্থাৎ দায়িত্বশীলদের দায়মুক্ত রেখে একটি মন্ত্রণালয় কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত ও শিক্ষা উপযোগী হবে এ বিষয়ে যথেষ্ট আস্থার অভাব রয়েই গেল।
সংবাদ সম্মেলনে আলাপের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ তিনটি সুসংবাদ দিতে চাই। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল দেশে আজ থেকে ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু হচ্ছে। অথচ জাতীয় দৈনিকগুলোয় বেরিয়েছে, ফোরজি সেবা চালুর নামে নতুন তরঙ্গ বিক্রি করেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। মোট চারটি অপারেটরের মধ্যে মাত্র দুটি অপারেটর ওই নিলামের মাধ্যমে তরঙ্গ কিনেছে। ফলে সরকারি অপারেটরসহ রবি নিলামে অংশ না নেয়ায় গ্রাহকদের বিরাট অংশ এ যাত্রায় পাচ্ছে না ফোরজি সেবা। এর উপর ফোরজি গতি চালু করতে যেখানে ৬০ মেগাহার্টজ-এর তরঙ্গ প্রয়োজন সেখানে সর্বোচ্চ মাত্রার তরঙ্গ কিনেছে গ্রামীনফোন, মাত্র ৩৭ মেগাহার্টজ। ফলে প্রায় অর্ধেক তরঙ্গ দিয়ে চারগুণ গতি বৃদ্ধি করে কীভাবে ফোরজি সেবা দেয়া হবে সেটি জনগণের কাছে বেশ ঘোলাটে রয়ে গেল।
বাকি দুটি ছিল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রক্ষেপণ ও আকাশপথে যুক্তরাজ্যে কার্গো পরিবহনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যা জাতীয় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে বলে আশাবাদী অনেকেই।
এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটের পাশাপাশি মিডিয়ার খবরকে দায়ী করলেন প্রধানমন্ত্রী। তার দাবি, মিডিয়ায় বেশি বেশি খবর প্রচার হয় আর দাম বেড়ে যায়। বাজারের হালচাল সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে। গণমাধ্যম কী কেবল সরকারের ইতিবাচক খবরের অংশীদার হবে, নেতিবাচক হলে চুপচাপ! এই যুক্তিও বেশ বিনোদনমূলক। খালেদা জিয়ার সাজগোজ নিয়ে যথারীতি এবারের সম্মেলনে কোনাে আলাপ না হলেও যে অঙ্গভঙ্গি তিনি দেখিয়েছেন তাও উপস্থিত দর্শক ও দেশবাসীকে সামান্য বিনোদন দিতে পেরেছে বৈকি।
মূলত ওই সংবাদ সম্মেলন বাংলাদেশের চলমান সংকট-বিবাদ নিরসনে কোনাে সবুজ সংকেত দিতে পারেনি। অথচ দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির মাঠ ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে। সময়ের টানেলে কোনাে আলোর রেখা জনগণ দেখতে পারছে না।