ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি এক ধরণের দার্শনিক শূন্যতায় ভুগছে। এখনো মুসলমানদের মধ্যে অনেক দার্শনিক এবং চিন্তক থাকলেও কেউ তাদের পূর্বসুরিদের জুতায় পা গলাতে পারেন নি। প্রয়োজন এমন চিন্তাবিদের যারা মুসলিমদের চিন্তাশীল করে তুলবে, সংকটের সময় নিরাপদ থাকার খেলায় না থেকে সকল বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় একটা সংকটের যায়গা হচ্ছে তারা মুসলমান দার্শনিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান সম্পর্কে অবগত না। আর এই সংকট উত্তরণের উপায় হচ্ছে বেশি বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় আশয় পড়া এবং গভীর মনো নিবেশের চেষ্টা করা। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে আসার আগ্রহ তৈরি করতে এই ৫ জন মুসলমান দার্শনিকের কাজের সাথে পরিচিত হওয়া আবশ্যক।
এই বিখ্যাত দার্শনিকদের পড়ার জন্য দর্শনের শিক্ষক বা শিক্ষার্থী হওয়া জরুরি নয়। তাদের কাজের জটিলতা এবং সুক্ষ্মতা দেখেই বোঝা যায় কেন সেই সময়কে ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা হতো। এবং প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিৎ তাদের কাজের খোজখবর রাখা এবং এর মধ্য দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে বোঝাপড়া থাকা।
আল-ফারাবি (৮৭২-৯৫১ খ্রি:)
আল-মুয়াল্লিম আল-থানি তথা আবু নাসের মুহাম্মাদ আল-ফারাবি সন্দেহাতীত ভাবেই পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকদের একজন। আধুনিক কালের দর্শনে তার অবদান অপরিমেয় কারণ গ্রীক দর্শনের সংরক্ষণে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। মধ্য এশিয়ান পলিম্যাথ শুধু গ্রীস সাহিত্যের সংরক্ষণই করেননি করেছেন উন্নয়নও। তার অবদান রয়েছে দর্শনে, গণিতে, সঙ্গীত, কসমোলজি ও অধিবিদ্যায়। কিন্ত তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল রাজনৈতিক দর্শন। তার বিখ্যাত ‘আরা আহলুল-মাদিনা আল-ফাদিলা’ (দ্যা ভিউজ অব দ্যা পিপল অব দ্যা ভার্চুয়াস সিটি) বইয়ে তিনি এমন একটা শহরের কথা বলেন যার নেতৃত্বে থাকবে দার্শনিকেরা, যেই শহরের পরম লক্ষ্য হবে নাগরিকের খুশি। আল-ফারাবি ছিলেন প্রথম মুসলমান দার্শনিক যে গণতন্ত্রের যথার্থতা বিবেচনা করেছেন। ইসলাম এবং গণতন্ত্র একসাথে যায় কিনা এটা নিয়া কারো সন্দেহ থাকলে অবশ্যই গণতন্ত্র নিয়ে ফারাবির দর্শন পড়া উচিৎ।
আল-ফারাবির কাজ একজন চিন্তককে উদ্ভাসিত করবে। তার কাজ শুধু একটা যথাযথ রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনা জাগ্রতই করে না, নিজেকেও ভাবতে শেখায়।
ইমাম আল-গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রি:)
ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী একজন চিন্তক। সে ছিল একজন দার্শনিক, একজন পন্ডিত এবং ধর্মতত্ত্ববিদ। অনেক মুসলমানের জন্যে সে আলোকবর্তিকা, ইসলামের সংস্কারক, মুজাদ্দিদ।
গাজ্জালি এমন একটা সময়ে আসেন যখন নানা বিতর্ক চলছিল দার্শনিকদের সাথে ধর্মতাত্ত্বিকদের, আধুনিকতাবাদের সাথে কট্টরবাদিদের; এবং তখন তিনি চেষ্টা করেন এই সুতাগুলোকে এক সাথে বাঁধতে।
পরিণত গাজ্জালির কাজ আরো কৌতুহল জাগানিয়া। তার বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট পরবর্তী আধ্মাতিক উন্মেষের পরে তার কাজ অনেকটা ভারতের শেইখ রাব্বানিদের সাথে মিলে যায়। কারণ রাব্বানি, শরিয়া ও তরিকার মধ্যে ভারসাম্য করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ‘ইহয়া উলুমুদ্দীন’ প্রত্যেকটা মুসলিম পন্ডিতের পড়া উচিৎ। প্রত্যেকটা মুসলমান ছাত্রের একবার হলেও ‘আলমুনকিদ মিনাদ্দলাল’ (ডেলিভারেন্স ফ্রম পিস) পড়া দরকার। এই বইয়ে গাজ্জালি তার বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আধ্মাতিক সন্দেহ এবং সত্যান্বেষী হৃদয়ের নানাবিধ সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। সমগ্র ‘উদার শিল্পকলা’র তার এই এক বইয়েই পাওয়া যায়।
ইবনে রুশদ্ (১১৬৫-১২৪০ খ্রি:)
ইবনে রুশদ, পশ্চিমে এভেরোস হিসেবে পরিচিত এই দার্শনিকের ইসলামিক চিন্তার থেকে বেশি প্রভাব ছিল পশ্চিমা ধর্ম এবং দর্শনে। কিছু মুসলিম ঐতিহাসিক বর্তমানের আধুনিক পশ্চিমা সমাজকে ইবন রুশদ এর কল্পনাপ্রসূত বিষয় আকারে ব্যাখ্যা দেন। ইবন রুশদ ছিলেন একজন অসাধারণ চিন্তক। তিনি ছিলেন একজন বিচারক, ইসলামিক আইনশাস্ত্রে (মালিকী) পণ্ডিত, চিকিৎসক এবং একজন দার্শনিক।
তার ‘ফাসলুল মাকাল’ (দ্যা ডিসিসিভ ট্রিটিজ) বইয়ে তিনি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শন এবং ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। ‘তাহাফাতুল তাহাফাত’ (ইনকোহেরেন্স অব ইনকোহেরেন্স) বইটা আল-গাজ্জালির ‘তাহাফাতুল ফালাসিফাহ’কে (ইনকোহেরেন্স অব ফিলোসফি) খন্ডন করে এবং এরিস্টটলীয় দর্শনকে সমর্থন দেয়। ইবনে রুশদ এবং ইমাম গাজ্জালি দুই দার্শনিকের এই দুইটা ক্লাসিক গ্রন্থ ইসলামি দর্শনের ঐতিহ্যে নক্ষত্র হয়ে আছে এখনো।
ইবনুল আরাবি (১১৬৫-১২৪০ খ্রীঃ)
ইবনে আরাবিই সম্ভবত সবচেয়ে অনুপম, সবচেয়ে জটিল এবং একইসাথে অসামান্য ইসলামিক চিন্তাবিদ। তিনি আল-ফারাবি বা ইবন রুশদ এর মত আধুনিকতাবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন আধ্মাতিক, দূরকল্পী এবং জ্ঞানের অস্পষ্ট বিষয়গুলোতে ওস্তাদ। ইবনে আরাবি ছিলেন সম্ভবত বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে প্রথম পোস্টমডার্ন এবং নারীবাদী চিন্তার সমর্থক। তাঁর ‘ফুসুসুল হিকাম’ (বেজেলস অব উইজডম), ‘ফুতুহাতুল মাক্কাহ’ (দ্যা মেককান ওপেনিংস) বই দুইটাকে এখনো দেয়া হয় ইসলামের আধ্মাতিক এবং দার্শনিক চিন্তার সর্বোচ্চ স্থান। ইবন আরাবির দর্শন না জেনে কেউ ইসলামী দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হতে পারবে না।
সৌভাগ্যবশত প্রফেসর উইলিয়াম চিটিক ইবন আরাবির কাজ নিয়ে কতিপয় বই রচনা করেছেন যার ফলে ইবন আরাবির কাজ সবার জন্য কিছুটা বোধগম্য হয়েছে। শায়খুল আকবর বলেন, “আপনি যদি মুসলিম হন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রেষণা থাকে তাহলে ইবন আরাবির দর্শন পড়া কর্তব্য। না পড়াটা হবে দুঃখজনক।”
ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি:)
ইবনে খালদুন হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন ইতিহাসের দার্শনিক এবং মানবেতিহাসের প্রথম সমাজবিজ্ঞানী। তিনি আদর্শগত তত্ত্বের তুলনায় প্রায়োগিক তত্ত্বের প্রতি বেশি জোর দেন। সমাজবিজ্ঞানে ইবনে খালদুন এর তিনটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
তিনি সর্বপ্রথম প্রায়োগিক/গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি সমাজের পরিবর্তন দেখতে যেয়ে পরিবর্তনের তত্ত্ব প্রদান করেন।
এবং তিনি দেখান এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সংহতি।
বর্তমানে ইস্তানবুলে ইবন খালদুন সোসাইটি নামে একটি সংগঠন রয়েছে। তারা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় খালদুনীয় দর্শনের গুরুত্ব নিয়ে কাজ করছে।
ছোট এই লেখাটার উদ্দেশ্য ইসলামী দর্শনের প্রতি নতুনদের আগ্রহ সৃষ্টি করা। একসময় মুসলমানদের সভ্যতা এবং দর্শন ছিল সমৃদ্ধ, এই আস্ফালন মূল্যহীন হয়ে পড়বে যদি না আধুনিক প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে অবগত না থাকে।
হাফিংটনপোস্ট এ প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক মুক্তাদের খান এর লেখা অবলম্বনে।