আশা জাগিয়ে শুরু করা বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজ সমাপ্ত হলো হতাশার ষোলকলা পূর্ণ করে। দায়টা কি শুধুই খেলোয়ারদের? নাকি পেছনে আরও কোন কিছু আছে? পতনের শুরু কি শ্রীলঙ্কা সিরিজ থেকেই নাকি আরো আগে? বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে। একে একে খুঁজবো তার উত্তর।
বাংলাদেশ দলে অস্থিরতার শুরু কিন্তু শ্রীলঙ্কা সিরিজে না বরং আফ্রিকা সফর থেকেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যা নগ্নরুপে প্রকাশ পেয়েছে। আফ্রিকা সফরে মুশফিকুর রহিমের মন্তব্যগুলোর কথা যদি মনে থাকে, তাহলে এটি সহজেই বোঝা যায় যে দলের স্বাভাবিক পরিবেশ স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছিলো আফ্রিকাতেই। সিনিয়রদের সাথে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো তৎকালীন কোচ হাথুরুসিংয়ের। সিরিজ শেষে হাথুরুর পদত্যাগে আশা জেগেছিলো পরিস্থিতি উত্তরণের। কিন্তু বিপরীতে দেখা গেলো উন্নতির বদলে অস্বাভাবিক এক অস্থিরতা বিরাজ করছে দল, বোর্ড সবখানেই। সে সময় বোর্ড প্রধানেরা করা একটি উক্তি তো ক্রিকেট ইতিহাসেই অমর হয়ে থাকবে। তিনি বলেছিলেন বোর্ডের নির্বাচন নিয়ে যে পরিস্থিতি চলছে তার প্রভাব পড়ছে খেলোয়াড়দের পারফরমেন্সে! বোর্ডের নির্বাচন খেলোয়াড়দের প্রভাবিত করে এমন অদ্ভুত কথা কেউ কোনো দিন শুনেছেন বলে মনে হয় না।
এফটিপি অনুযায়ী এটা আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলো যে আফ্রিকা সফর শেষে ঘরের মাটিতে একটি ত্রিদেশীয়, একটি টেস্ট এবং একটি টি টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। মূল কোচের পদত্যাগের পর এত স্বল্প সময়ে ভালো মানের কোচ পাওয়া কঠিন বিসিবির এই ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত করবে না কেউই। কিন্তু, অন্তরবর্তীকালীন কোচ নিয়ে নাটকটাও কেউ প্রত্যাশা করে না। হাথুরুকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক এটা নিরেট সত্য যে তিনি একজন বিশ্বমানের কোচ। তার মুখোমুখি হবার আগে দলের শীর্ষ মুখটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিলো বোর্ডের। কোনো এক অজানা কারণে এ ব্যাপারে চরম ঔদাসিন্য লক্ষ করেছি আমরা। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম দু ম্যাচে প্রতিপক্ষের শক্তি, নিজেদের সামর্থ্য বিবেচনায় দল গঠন করতে দেখা গিয়েছিলো। সাফল্যও এসেছিলো হাতেনাতে। কিন্তু, বাংলাদেশের সে কৌশলের পাল্টা জবাব যখন হাথুরু আবিষ্কার করলেন কেমন যেন হতবুদ্ধ দেখালো টিম ম্যানেজমেন্টকে। একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর প্রচেষ্টা যখন বুমেরাংয়ে পরিণত হলো, তখন কোনো দৃশ্যমান প্রচেষ্টা দেখা গেল না তা থেকে উত্তরণের।
আসুন টেস্ট সিরিজে। অস্থিরতার চরম এবং চূড়ান্ত নমুনা দেখা গিয়েছে এখানে। এক সাকিবের অভাব মেটাতে দলে ডাকা হলো ছয়জন স্পিনার! তাও, স্পিন স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে এমন একটি দলের বিপক্ষে। চট্টলা টেস্টের মরা পিচের ফাঁয়দা নিয়ে ম্যাচ বাচানো গেলেও তা থেকে কোনো শিক্ষা যে বাংলাদেশ নেয়নি তার প্রমাণ দেখা গেলো পরের টেস্টেও। ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে স্পিনিং পিচ বানিয়ে বিস্ময়ের বিশাল এক ধাক্কা দিলো পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই। ফলাফল? আড়াই দিনেই বাক্স পাটরা গুছিয়ে হোটেলে নিশ্চিন্ত বিশ্রাম। নাটক তো এখানেই শেষ না। টেস্ট ম্যাচ টেস্টের মেজাজে খেলার খেসারত দিয়ে দল থেকে বাদ পড়লেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক সৈকত। এরপর আসলো ইতিহাসের সেরা তত্ত্ব। টি টোয়েন্টির প্র্যাক্টিসের জন্য টেস্টে পারদর্শী মোসাদ্দেককে বাদ দিয়ে দলে আনা হলো টি টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট সাব্বির রহমানকে। প্র্যাক্টিসটা তিনি অবশ্য খারাপ করেননি। দু ইনিংস মিলিয়ে গোটা পাচেক বল খেলে করেছেন এক রান। স্বল্প দৈর্ঘ্যের খেলার প্র্যক্টিসে যখন নেমেছেন কি দরকার অহেতুক শক্তি ক্ষয় করার? তা যে ম্যাচের জন্য প্র্যাক্টিসের এই আয়োজন তাতে তিনি কেমন করলেন সেটা জিজ্ঞাস না করাই ভালো। হায়া লাজেরও তো একটা বিষয় আছে না কি?
রঙ্গমঞ্চের পুরোটাই এবার দখল করে নিয়েছিলেন জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীন এবং খালেদ মাহমুদ। ক্রিকেটে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল দেয়ার রেওয়াজ নাই। নাহলে টেস্টকে টি টোয়েন্টির প্রস্তুতি মঞ্চ বানানোর অভিনব, অযৌক্তিক, অগ্রহযোগ্য তত্ত্বের জন্য একটি নোবেল পেতেই পারতেন মিনহাজুল আবেদীন। এখানেই থামেননি। শারীরিক শিক্ষাতেও নিজের জ্ঞানের কিছু ঝলক দেখিয়েছেন। মাত্র আড়াই দিনে শেষ হওয়া টেস্টে খেলোয়াড়দের দেখে তার নাকি ক্লান্ত মনে হয়েছে দলকে। ফলস্বরুপ টি টোয়েন্টি হয়ে গেলো কচিঁ কাচার আসর। যার পূর্ণ ফায়দা নিয়ে বেধড়ক পিটুনি দিয়ে কল্পনার জায়গা যে ক্রিকেট না সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন লঙ্কানরা।
ম্যানেজমেন্টের যে হালত, তাতে নজর দেয়ার জো নেই। লঙ্কান ম্যানেজার (যিনি শুধু ম্যানেজারের পদেই আছেন) তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে বাংলাদেশ হেরেছে তাদের পরিকল্পনার কাছেই। বিপরীতে যিনি আছেন (ধরাধামের একমাত্র আদমি যিনি নিজেই জানেন না ঠিক কতগুলো পদবির মালিক তিনি) সেই সুজন সাহেব এটুকুই অনুধাবন করতে পারেননি যে টেস্ট স্ট্রোক মেকিংয়ের জায়গা না, বরং বলের মেরিট বুঝে খেলাটাই এখানে মূখ্য।
অস্থিরতার নমুনা তো এখানেই শেষ না। সমশক্তির একটি দলের বিপক্ষে যখন আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত ম্যাচ জয়ের সম্ভাব্য সুযোগ নিশ্চিত করা সেখানে আপনি টি টোয়েন্টিতে নামিয়ে দিলেন আনকোরা সব নতুন মুখ। যার ফলে বাংলাদেশের নাড়ি নক্ষত্র জানা হাথুরুর সামান্য সমস্যাও হয়নি সঠিক পরিকল্পনা খুঁজে বের করে চাপে ফেলে এদের চিড়ে চ্যাপ্টা করতে। ক্লান্ত টেস্ট খেলোয়াড়ারাও তাও কিছুটা ম্যাচে ছিলো, কিন্তু তরতাজা তরুণরা কেবল একাদশের কোটাই পূরণ করেছে। দোষটা আসলে কাকে দিবেন? আপনি মেহেদী হাসান এর কথাই ধরুন। এখনো কৈশোরই পার না করা এক বোলারকে আপনি নামিয়ে দিলেন এমন একটি দলের বিপক্ষে যারা ঘুমের ঘোরেও স্পিন খেলে। ত্রিদেশীয় সিরিজে লঙ্কানদের বিপক্ষে প্রথম দু ম্যাচে যখন আপনি তিন পেসার নিয়ে সফল হয়েছিলেন তখন ঠিক কি কারণে সে পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে স্পিন নির্ভর দল সাজাতে হবে এটা একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না। ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে জবান বলেছিলো পেসারদের ওপর ভরসা রাখুন। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিলো কিন্তু এই পেসারদের হাত ধরেই। কিন্তু সে পথ থেকে ইউটার্ন নিয়ে স্পিনই বাংলাদেশের শক্তি এই মুখস্ত ওয়াজ আমাদের ক্রমাগত পেছনেই ঠেলে দিচ্ছে। অস্থিরতার নমুনা কোন পর্যায়ে পৌছেছে সেটি স্পষ্ট হয়ে যায় একটি তথ্যতেই। এই একটি সিরিজেই বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নেমেছেন মোট ২৮ জন ক্রিকেটার! এমন অবস্থায় খেলোয়াড়রা যে ক্রিকেট খেলার নিয়মটা মনে রেখেছেন এই তো ঢের।
আরো একবার পিচের জিকির করে সামান্য বিরক্ত করতে চাই। ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসারীরা ইতোমধ্যেই জেনে গিয়েছেন যে, ঢাকা টেস্ট শেষে মিরপুরের নামের পাশে আরো একবার যোগ হয়েছে ডিমেরিট পয়েন্ট। তার আগে চট্টগ্রাম এর বিপক্ষেও একই হালত দেখেছি আমরা। বোর্ড কতটা উদাসীন হয়ে উঠেছে এটি তার আরো একটি অকাট্য প্রমাণ। একই সিরিজে দুটি মাঠের নামের শেষে ডিমেরিট পয়েন্ট যুক্ত হবার নজির বোধ করি এটাই প্রথম। এখানেও মজা আছে। বোর্ড এর চাওয়া ছিলো একরকম, খেলোয়াড়দের একরকম আবার টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের আরেক রকম। কিউরেটর বেচারা কোন দিকে যাবে বুঝতে না পেরে নিজের খেয়ালেই পিচ বানিয়ে খেয়েছেন শো কজ!
বিষয়টিকে ঠিক অপ্রাসঙ্গিক বলা ঠিক হবে কি না জানি না, তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি। মাশরাফির অবসরের পরেই অনেক বিশ্লেষকই বলেছিলেন যে, টি টোয়েন্টি থেকে বেশ আগেই অবসর নিতে বাধ্য হলেন মাশরাফি। দুটো ম্যাচেই বোলারদের হতশ্রী নৈপুণ্য এ কথাটিকে আরো শক্ত জামিনের ওপর দাড় করিয়ে দিচ্ছে। হ্যা, মাশরাফি হয়তো একাই ফল বদলে দিতে পারতেন না, কিন্তু মাঠে তার অণুপ্রেরনাদায়ী নেতৃত্বে এই শ্রীলঙ্কাকেই তাদের মাটিতেই উড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো বাংলাদেশ।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি, তা হলো বোর্ডের অপেশাদারিত্ব এখন বেশ চোখে লাগার মত। সামনেই আরো একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ। অথচ, এখনো কোচের বিষয়টির কোনো সুরহা হয়নি। পাওয়া যাচ্ছে না পূর্ণাঙ্গ ব্যাটিং কোচও। এই সিরিজটির ফল যদি বিসিবি গুরুত্বের সাথে অনুধাবনে সক্ষম হয় তাহলে পদবীর ভারে ন্যুজ্ব খালেদ মাহমুদের বদলে যোগ্য কারো হাতেই দল তুলে দিবে বলে বিশ্লেষকদের বিশ্বাস। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, সারোয়ার ইমরানরা যথেষ্ট যোগ্য এ পদ সামাল দিতে। এ অনুধাবনটুকু বোর্ডের হলেই হয়, নতুবা বহু পদের অধিকারীদের বাহারী বুদ্ধি সামনে আরো বড় লজ্জাই উপহার দিতে পারে।
প্রশ্ন করতে পারেন পুরোটা সময় খেলোয়াড়দের আড়ালে রেখে বোর্ডের সমালোচনায় কেন ব্রতী হলাম? আপনি ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট যে কাউকে জিজ্ঞাসা করেন, প্রত্যেকেই একমত হবেন যে, দলের নৈপুণ্যের অনেকটাই নির্ভর করে অন্দরের পরিবেশের ওপর। অন্দরেই যখন এরুপ অস্থিরতা বিদ্যমান তখন খেলোয়াড়দের কাছ থেকে ব্র্যাডমানিয় নৈপুণ্য আশা করাও বাতুলতা।
পুরো সিরিজে ইতিবাচক দিক একটিই। বোর্ড কর্তা বহুদিন বাদে অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, মিডিয়ার মুখোমুখি হবার জন্য বোর্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ব্যাক্তি রয়েছে। আর তাই এই অনুধাবনের ফলে শেষ পর্যন্ত আবারে জালাল ইউনুসকে দেখা গেল নিজের কর্ম পালনের সুযোগ পেতে। আর কেউ দেক না দেক, জালাল ইউনুস অন্তত একটি ধন্যবাদ দিতেই পারেন বোর্ড কর্তাকে।