ত্রিপুরায় কি ফের লাল ঝাণ্ডাই উড়বে

ত্রিপুরায় কি ফের লাল ঝাণ্ডাই উড়বে

মানিক সরকার বামফ্রন্ট নেতা এবং ত্রিপুরা রাজ্যের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। সাধাসিধে চালচলন আর অতি সাধারণ পোশাক-আশাক যেন গল্পের গরিবের নেতা। এসব মিলিয়ে মানিক সরকারও হয়ে উঠেছেন জনতার সরকার। ভারতের বিভিন্ন  রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ যেখানে কোটি কোটি টাকা সেখানে নির্বাচনী হলফনামায় মানিক সরকারের সব সম্পদের আর্থিক মূল্য মাত্র ২৬ লাখ টাকা। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) দলের পলিটব্যুরোর ওই নেতা তার বেশির ভাগ সম্পত্তি দান করে রেখেছেন পার্টিকে। বিভিন্ন খবরে দেখা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় গ্রহণ করেন না সরকারি প্রটোকল। নেননি বলার মতাে তেমন কোনো বাড়তি কোনো সরকারি সেবা। তাই গতকালের ত্রিপুরার নির্বাচনে মানিক সরকারের ওই ইমেজই হয়ে উঠেছে সিপিএম-এর মূল ভরসা।

ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম অবশ্য জানাচ্ছে, এবার লড়াইটা হবে হাড্ডাহাড্ডি। বেশ কয়েক বছর ধরে ত্রিপুরা রাজ্যে কংগ্রেসের অবস্থা বেশ ভালো নয়। সিপিএমের সঙ্গে যেন পেরে উঠছিলেন না তারা। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই রাজনীতিতে আজকের সিপিএম হয়ে উঠেছে প্রধান শক্তি ওই কংগ্রেসেরই দুরবস্থা আজ ত্রিপুরার রাজনীতিতে। তবে কংগ্রেসের ওই দুর্বলতার সুযোগ নিতে বিজেপি একটুও ভুল করেনি। ভালোমতাে দল গুছিয়ে নেমে পড়েছে ত্রিপুরার নির্বাচনী লড়াইয়ে। জোট করেছে ‘ইনডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (আইপিএফটি)-এর সঙ্গে। এরই মধ্যে কংগ্রেসের বেশ কয়েক বিধায়ক যোগ দিয়েছেন বিজেপি-তে। ফলে নির্বাচনী লড়াইটা এখন আর একপেশে নেই।

ওই পরিস্থিতিতে বোঝাই যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে বেশ ভালো চিন্তায় পড়েছে সিপিএম। ১৯৮৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েনি সিপিএম। ১৯৮৮ সালে কংগ্রেস-টিইউজেএস জোটের কাছে রাজ্য নির্বাচনে হেরেছিল সিপিএম। ১৯৯৩ সালে অবশ্য তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এরপর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর সিপিএম-কে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু এবার কেন ওই রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে এত হইচই হচ্ছে তা জানতে হলে অবশ্য আলাদাভাবে নজর দিতে হবে বিজেপির রাজনীতির দিকে।

ত্রিপুরার নির্বাচনে কংগ্রেসের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভালোভাবেই মাঠে নেমেছে বিজেপি। লোকসভার মাত্র দুটি আসন থাকা ওই রাজ্য আদিবাসী ভাবাবেগকে মূলধন করে নির্বাচনে জয়লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা। ফলে নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা-র নেতৃত্বে আইপিএফটি-র সঙ্গে জোট করে আঘাত হানতে চায় লাল ঝাণ্ডার দুর্গে। তফসিলে জাতি ও উপজাতি মিলিয়ে ত্রিপুরায় বিধানসভার সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০। এদিকে রাজ্য বিজেপি সভাপতি বিপ্লব কুমার দেব বেশ আশাবাদীও হয়ে উঠেছেন এরই মধ্যে। তবে ঝামেলাও আছে বেশ। আইপিএফটির জন্মই যেখানে হয়েছিল উপজাতিদের জন্য আলাদা ত্রিপ্রাল্যান্ডের দাবি নিয়ে সেখানে বিজেপি ঐক্যের স্লোগান দিয়ে দাবি করছে ‘এক ত্রিপুরা, শ্রেষ্ঠ ত্রিপুরা’র। তাই নির্বাচনে ফল যাই হোক, জোট নিয়ে বিজেপি বেশ ভালোই বিপদে পড়বে আগামীতে।

অবশ্য ওইসব নিয়ে আর ভাবার সময় নেই বিজেপির। তাদের মূল নজর এখন নির্বাচন ঘিরেই। নির্বাচন কেন্দ্র করে সরব হয়েছে ভারতের সব প্রধান রাজনৈতিক দলই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে বিজেপি প্রধান অমিত শাহ- সবাই ভালোভাবেই নেমে পড়েছেন ত্রিপুরা দখলের লড়াইয়ে। নির্বাচন ঘিরে প্রধানমন্ত্রী মোদির দফায় দফায় ত্রিপুরা সফর ওই কথারই প্রমাণ দিয়েছে। তোড়জোড় চালাচ্ছেন কংগ্রেস নেতারাও। তারা যে খুব ভালো অবস্থানে নেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই পরিস্থিতি সাময়িক বলে দাবি করেছেন ত্রিপুরা রাজপরিবারের বর্তমান প্রতিনিধি ও কংগ্রেস নেতা মহারাজা প্রদ্যোত বিক্রম কিশোর। তার দাবি, কেন্দ্র সরকার ঘুরে গেলে ঘুরে যাবে ত্রিপুরার রাজনীতির চাকাও।

নির্বাচনী ওই ডামাডোলে পিছিয়ে নেই সিপিএমও। তাদের কাছে মানিক সরকার তো আছেনই, সঙ্গে সঙ্গে আছেন গত চারবার নির্বাচিত হয়ে রাজ্যের উন্নয়নের ধারবাহিকতার ‘রেজাল্ট কার্ড’। বিজেপির এত তোড়জোড়ের বিপরীতে সিপিএমও পাল্টা শক্তি নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেরিয়েছে। গণমাধ্যমের সূত্র মতে, মানিক সরকার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ৫০টিরও বেশি ভাষণ দিয়েছেন। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন সরকারে থাকার কিছু ফল তো সিপিএম-এর হাতে আছেই। উপজাতি আসনেও দলটির অবস্থান খারাপ নয়। উপজাতীয় এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী সিপিএম সরকার সেখানে স্বশাসিত জেলা পরিষদ তৈরি করেছে। তাছাড়া উপজাতিদের অন্যতম প্রধান ভাষা ককবরক-কে রাজ্য ভাষার মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি অনেক উদ্যোগ নিয়েছিল। তাই উপজাতি ভোট দখলের লড়াইয়ে সিপিএম যে বিজেপিকে এক বিন্দুও ছাড় দেবে না তা পরিষ্কার। সব মিলিয়ে তারাও আছে বেশ ভালো অবস্থানে।

সিপিএম শাসন আমলে রাজ্যের উন্নতি হয়েছে ব্যাপক, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে মানিক সরকারে উন্নতি ছিল চোখে পড়ার মতাে। কিন্তু শিল্প ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি চোখে পড়েনি। আর এটাকে পুঁজি করেই মাঠে নেমেছে সিপিএম বিরোধীরা। যদিও সিপিএম তাদের ইশতেহারে বলেছে, পরিকাঠামোর উন্নতি করে বাম সরকার জোর দেবে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার ওপর তবুও জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তারা এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। কারণ শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবেন কি না তা নির্ভর করছে কী ধরনের প্রকল্প নির্মাণ করা হবে এর ওপর। অন্যদিকে ত্রিপুরার প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙালি। তাই সিপিএম ভোটের দিকে জোর দিচ্ছে বঙিালিদের ওপর। কিন্তু কিছুদিন ধরে আসামে বঙিালিদের নিয়ে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় সিপিএমের সামনে এটিও নতুন চ্যালেঞ্জ আকারে হাজির হয়েছে। বাঙালিদের অন্যতম বড় দল তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য এসবের মধ্যে হালে পানিই পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ত্রিপুরার আজকের নির্বাচন এক জমজমাট লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে।

ওইসবের মধ্যেও গতকালের নির্বাচনে বেশ আশাজাগনিয়া ঘটনা দেখা গেছে। গত নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসাই ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই সিপিএম নেতা মানিক সরকারের স্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপি নেতা অমিত শাহ কিংবা ইউনিয়ন মিনিস্টার রাজ্যবর্ধন সিং রাথোর- সবাই ভোটারদের মাঠে আনতেই বেশি তৎপর ছিলেন। এর ফল দেখা গেছে ভোট শেষ হওয়ার পর। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এবার ৪১ আসনে এবার ভোট দিয়েছে ৭৬ শতাংশ ভোটার। তা ছিল ওই রাজ্যে রেকর্ড। তবে একটি আসনে সিপিএম প্রার্থীর মৃত্যুতে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানকার নির্বাচন। একই সঙ্গে ভারতীয় নির্বাচনে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে যে সমালোচনা শোনা যায় সেটিও খুব বড় আকারে আলোচনায় আসেনি ত্রিপুরার নির্বাচনে। সব মিলিয়ে ভোট নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে উভয়পক্ষই।

ত্রিপুরায় বিজেপি জোট তাদের সমাবেশে সরকারের পরিবর্তন দাবি করে আসছিল। তবে ওই পরিবর্তনটি সিপিএমকে ক্ষমতায় রেখেই, নাকি বাইরে পাঠিয়ে- তা ভোটের ফলাফলেই বোঝা যাবে। নরেন্দ্র মোদি ত্রিপুরায় তার ভাষণে জনগণকে ‘মানিক (মানিক সরকার) ছেড়ে হীরা নিতে আহ্বান করেছিলেন।’ ইংরেজি অক্ষর ধরে ধরে মোদির কাছে ‘হীরা’র অর্থ হলো ‘এইচ মানে হাইওয়ে, আই মানে ইন্টারনেট, আর মানে রেলওয়ে এবং এ মানে এয়ারওয়ে।’

দেখার বিষয় হলো ত্রিপুরার জনগণ ওই নির্বাচনে মোদির হীরার দিকে ঝুঁকবে, নাকি তাদের ওই পুরনো মানিককে নিয়েই খুশি থাকবে। এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে ৩ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেদিনই ঘোষণা হবে ত্রিপুরা নির্বাচনের ফল।