রোহিঙ্গা গণকবরের ছবি ও তথ্য-প্রমাণ

রয়টার্সের দুনিয়া কাঁপানো প্রতিবেদন

রোহিঙ্গা গণকবরের ছবি ও তথ্য-প্রমাণ

গত ২ সেপ্টেম্বের বৌদ্ধ গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের সেনারা ১০ রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রাখাইন রাজ্যের ওই ঘটনার ছবি, তথ্য-প্রমাণসহ হাজির করেছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। কীভাবে তারা এসব প্রমাণ হাতে পেয়েছে এরও বিস্তারিত তুলে ধরেছে রিপোর্টটিতে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সংস্থাটির চার সাংবাদিক ওয়া লো, চ সোয়ে উ, সাইমন লুইস ও অ্যান্টোনি স্লোডকোস্কি ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ওয়া লোন এবং চ সোয়ে উ-কে গত মাস থেকে গ্রেফতার করে রেখেছে মিয়ানমারের পুলিশ। জবান এর পাঠকদের জন্য রয়টার্স এর এই বিশেষ প্রতিবেদনটির পুরোটা অনুবাদ করে দেয়া হলো।


ইন দিন, মিয়ানমার– দুইজন কবরখোদক-এর ভাষ্য মতে, ‘১০ রোহিঙ্গা মুসলমান এক সঙ্গে বন্দি অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছিল তাদেরই প্রতিবেশী বৌদ্ধরা তাদের জন্য কবর খুঁড়ছে। এরপর খুব শিগগিরই ২ সেপ্টেম্বর সকালে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কমপক্ষে দুইজনকে গ্রামবাসী কুপিয়ে এবং বাকিদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।’

রাখাইন রাজ্যের ইন দিন-এর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের  সো চে (৫৫) জানায়, সেই ওই কবর খননের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং ওই হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে। ১০ জনের জন্য মাত্র একটি গর্ত করা হয়। প্রত্যেককে মিয়ানমারের সেনারা দুই-তিনটি করে গুলি করে। তাদের যখন মাটিচাপা দেয়া হচ্ছিল তখনো কয়েকজন গোঁঙাচ্ছিল আর অনেকে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া জাতিগত নিধনের ঘটনায় ইন দিনের উপকূলবর্তী গ্রামের ওই ভয়াল হত্যাকাণ্ডটি আরেকটি রক্তাক্ত ইতিহাস হয়ে আছে। ওই সময় আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিকটস্থ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নেন। অক্টোবর পর্যন্ত ৯ দিনে গ্রামগুলোয় মাত্র ছয় হাজার রোহিঙ্গা অবশিষ্ট ছিলেন।

রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমেরের সেনাবাহিনী তাদের ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ ও তাদের গৃহত্যাগে বাধ্য করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনে জাতিসংঘ। আর যুক্তরাষ্ট্র ওই কর্মকাণ্ডকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এটিকে অস্বীকার করে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী উল্লেখ করে দমন অভিযান হিসেবে আখ্যা দেয়।

রোহিঙ্গারা রাখাইন-এ কয়েকশ’ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। মিয়ানমারিয়নিরা মনে করে, তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে সেখানে পাড়ি জমিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বাঙালি হিসেবে অভিহিত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অজুহাতে মিয়ানমার সরকার প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে একটি ছোট অঞ্চলের মধ্যে অনেকটা বন্দি অবস্থায় রাখে। সেখানে খাবার, বাসস্থান, ওষুধ, শিক্ষা ইত্যাদির অভাবে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

রয়টার্স এও নিশ্চিত করে, যে ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে আটজন ছিলেন প্রাপ্ত বয়স্ক আর দুইজন কিশোর।

এখন পর্যন্ত ওই সংঘাত সম্পর্কিত তথ্য কেবল আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। কিন্তু রয়টার্স প্রথমবারের মতাে অত্র এলাকার বৌদ্ধ গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার নেয়। তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার, নীপিড়ন, হত্যা, অগ্নিসংযোগের কথা স্বীকার করে।

রয়টার্স-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনীর কয়েক সদস্য ওই অপারেশন-এর ভ্যন্তরীণ নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তাদের ভাষ্য মতে, ইন দিন থেকে মুসলিম রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ ছিল একটি সুপরিকল্পিত ঘটনা। এর মূল নেতৃত্বে ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

নিহতদের পরিবারগুলো এখন বাংলাদেশে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে। রয়টার্সের কাছ থেকে সরবরাহকৃত ছবির মাধ্যমে তাদের স্বজনদের শনাক্ত করেছেন তারা। নিহতদের মধ্যে দুই তরুণ ছাত্র, এক ইসলামি স্টাডিজের শিক্ষক এবং বাকিরা জেলে ও দোকানদার।

রয়টার্স-কে বয়স্ক বৌদ্ধ এক গ্রামবাসী ওই তিনটি ছবি হস্তান্তর করেন। এর প্রথমটি তোলা হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর বিকালে যখন তাদের বন্দি করা হয়। পরেরটি ২ সেপ্টেম্বর তাদের হত্যার আগ মুহূর্তে। এরপরেরটা হত্যাকাণ্ড শেষ হওয়ার পর যখন তাদের সবাইকে একই গর্তে ফেলা হয়।

রয়টার্সের অনুসন্ধানে ওই গণহত্যার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর মিয়ানমারের পুলিশ কর্তৃপক্ষ ওই সংবাদ সংস্থার মিয়ামারিয়ান বংশোদ্ভূত দুই প্রতিবেদকে রাখাইন সংক্রান্ত স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহের অভিযোগে গত ১২ ডিসেম্বর থেকে গ্রেফতার করে রেখেছে।

সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সাংবাদিক চ সোয়ে উ এবং তার সহকর্মী ইন দিন গ্রামে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ঘটে যাওয়া গণহত্যা নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেন এর কিছু অংশ সত্য বলে সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে। সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে, সেদিন বৌদ্ধ গ্রামবাসী তরবারি দিয়ে আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করে এবং বাকিরা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন।

বাম থেকে ডানে যথাক্রমে আবুল হাসিম (২৫), আবদল মালেক (৩০), নুর মোহাম্মদ (২৮), রসিদ আহমেদ (১৮), হাবিজু (৪০), আবুলু (১৭), সাকের আহম্মেদ (৪৫), আবদল মাজিদ (৪৫), সোকেত উল্লাহ (৩৫) ও দিল মোহাম্মাদ (৩৫))

 

আবুল হাসিম (২৫)

তিনি ইন দিন গ্রামের পশ্চিম হ্যামলেট-এর অন্যতম ধনাট্য অধিবাসী। স্থানীয়রা ওই গ্রামকে ফসিনপাড়া নামে জানে। আবুল হাসিম মেশিন পার্টস ও মাছ ধরার জাল বিক্রির দোকান চালান। এছাড়া বেসরকারি সংস্থার জন্য চাল গুদামজাত করতেন। ইন দিন গ্রামে পাহাড় ঘেঁষা তার তিন একর জমিজুড়ে গাছ আছে যেগুলো জ্বালানি ও নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হতো। তার ১৬টি ষাঁড় ছিল যেগুলো ফেলে রেখে আসতে হয়েছে। তার স্ত্রী হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি না তারা (সেনাবাহিনী) কেন লোকজনকে ধরে নিয়ে গেল। যাদের ধরে নেয়া হয়েছিল তারা সবাই ভালো মানুষ।’ হাশিম ও হাসিনার সংসারে তিন সন্তান আছে। তাদের মধ্যে মাজিদ একজন। মাজিদের জন্ম গত নভেম্বরে বাংলাদেশের তেলিখালী শরণার্থী শিবিরে।

আবদুল মালেক (৩০)

একজন ধর্মীয় শিক্ষক বা মাওলানা যিনি ২০ বছর ধরে ওয়েস্ট হ্যামলেট মসজিদের ইমাম হিসেবে কাজ করতেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গ্রামবাসী জানায়, বছর কয়েক ধরে মধ্য হ্যামলেটের পুরনো ভবনের ওই মসজিদ থেকে মাইকে আজান দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এছাড়া পাঁচ সন্তানের জনক আবদুল মালিক ফ্ল্যাক্সে করে চা ও জেলেদের কাছে কেরোসিন বিক্রি করতেন। তার স্ত্রী মারজান (২৫)-এর মতে, সেদিন কয়েক গ্রামবাসী একটি খবর শুনে দোকানের পাশে ভিড় জমিয়েছিল।

নুর মোহাম্মদ (২৮)

তিনি এলাকায় ‘বাঙ্গু’ নামে পরিচিত ছিলেন। মাছ আর চালের পিঠা বিক্রি এবং ছোট্ট বাগানে সবজি ও ডাল চাষ করতেন। তার স্ত্রী রেহেনা খাতুনের মতে, নিজের পরিবারকে দেখা-শোনার বাইরে তার কোনো চিন্তা ছিল না। তিনি পরিবারের ভাগ্য পরির্তনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতেন।

রসিদ আহমেদ (১৮)

সে ইন দিন হাই স্কুলের মেধাবী ছাত্র ছিল। তার মা সুবিয়া হাতু আর বাবা আবদুস সাকুর জানান, তার ছেলের ইংলিশ ও মিয়ানমারিয়ান-এ চমৎকার দখল ছিল। রসিদের বাবা সাকুর (৫০) আশা করতেন, তার ছেলে পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে উচ্চ শিক্ষা নিতে যাবে। তিনি বলেন, তার রেজাল্ট ভালো ছিল। আমিই পরিবারের সবকিছু দেখা-শোনা করতাম যাতে সে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারে।

হাবিজু (৪০)

তিনি মাছ বিক্রি করতেন। তাছাড়া তার ১৫টি ছাগল ও ছোট এক টুকরো জমি ছিল। তার স্ত্রী সুনা খাতু (৩০) এখন বাংলাদেশের বালিখালী রিফিউজি ক্যাম্পে আছেন। তিনি এখনো হাবিজুকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। বাংলাদেশের আসার পর তার তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তার নাম রেখেছেন সাদিক। প্রতিবেদকের কাছে মুনা খাতু বলেন, হাবিজু একটি গরু কেনার জন্য টাকা জমাতেন। তাছাড়া তিনি চাইতেন তার সন্তানরা যেন লেখাপড়া করে অনেক বড় হয়।

আবুলু (১৭)

২০১৬ সালে রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আগে ইন দিন হাই স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল আবুলু। তার ভালো পুরো নাম আবুল হাসিম। তার মা নুরজান (৪০) জানান, তার ছেলে পড়া-শোনা শেষ করার পর গ্রামে ফার্মাসি দিতে চাইতো। সে খুব ভালো ও ভদ্র ছেলে ছিল। তিনি একটু হেসে জানান, তার ছেলে মাংস পছন্দ করতো। মাছ ভাজি মোটেই পছন্দ করতো না সে। ‘যেদিন আমি মাছ রান্না করতাম সেদিন সে দৌড়ে চলে যেত এবং ওই রাতে সে পাশের কোনো বাড়িতেই খেয়ে আসতো’- বলেন নুরজাহান।

সাকের আহম্মেদ (৪৫)

তিনি মাছ বিক্রি করে প্রতিদিন পাঁচ হাজার কেইত আয় করতেন। তাঁর স্ত্রী রেহমা খাতুন বলেন, ‘আমি ও আমার স্বামী আমাদের ৯ সন্তান নিয়ে অনেক সুখে ছিলাম।’ তার নবম সন্তান সাদিকুর রহমানের জন্ম হয় গত নভেম্বরে কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর।  তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানরা যখন তার বাবার কথা জানতে চায় তখন কিছুই বলতে পারি না। এখন আমার ভয় হয়। তাদের বাবার অনুপস্থিতিতে ৯ সন্তানকে নিয়ে জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে উঠছে।’

আবদুল মাজিদ (৪৫)

তিনি ছোট্ট একটা দোকান চালাতেন। তার স্ত্রী আমেনা খাতুন (৪০) এখন তেলিখালী রিফিউজি ক্যাম্পে আট সন্তানসহ বাস করেন। তাদের বয়স এক থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘তিন একর জমির ওপর আমাদের ছয়টি বাড়ি ছিল। এখন আর আমাদের কিছুই নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার আগে নিজের চোখেই আমার বাড়িঘর আগুনে জ্বলতে দেখেছি।’

সোকেত উল্লাহ (৩৫)

তার প্রতিবেশীরা বলেন, সেতারা-কে বিয়ে করার পর সোকেত উল্লাহ তিন বছর ধরে পশ্চিম হ্যামলেট ছেড়ে দিন মিন গ্রামে থাকতেন। সেখানে মাছ ধরার কাজ করতেন এবং মাঝে মধ্যে বাড়তি টাকার জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতেন তিনি।

দিল মোহাম্মাদ (৩৫)

ইন দিন গ্রামে দিলু নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে তা বিক্রি করতেন। গ্যাসট্রিকের সমস্যা ছিল তার। এখন তার স্ত্রী ১৫ বছরের সন্তান নিয়ে বালুখালী রিফিউজি ক্যাম্পে বাস করেন।


ওই ঘটনায় ওয়ে লোন এবং চ সোয়ে উ-এর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইনের আওতায় অভিযোগ করা হয়েছে। ওই অভিযোগে ১৪ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। কিন্তু রয়টার্স-এর কাছে স্থানীয় বৌদ্ধ গ্রামবাসী ও রোহিঙ্গা মুসলিমরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন এতে উল্টো ঘটনা দেখা গেছে।

সেনাবাহিনী জানায়, আটককৃত ১০ জন ওই ‘২০০ জনের সন্ত্রাসী গ্রুপ’-এর সদস্য। যেহেতু ওই সহিংসতার মধ্যে তাদের নিয়ে গ্রামের বাইরে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সেহেতু সেনারা তাদের গ্রামের মধ্যেই মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ওই প্রতিবেদকের কাছে স্থানীয় বৌদ্ধ গ্রামবাসী সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় জানায়, ইন দিন-এ যাদের বিদ্রোহী বলে নিয়ে আসা হয়েছে তারা নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করেনি। রোহিঙ্গাকে হত্যাকাণ্ডের গণকবর দেয়ার ঘটনার  প্রত্যক্ষদর্শী একজন রয়টার্সকে জানান, সৈন্যরা শত শত মানুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে থেকে ওই ১০ জনকে আটক করে আনে। তারা সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় কাছাকাছি সমুদ্রপাড়ের দিকে নিরাপদ আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলেন।

অন্যদিকে সূত্রটি রাখাইন বৌদ্ধ গ্রামবাসী, সৈন্য, আধা সামরিক পুলিশ, রোহিঙ্গা মুসলমান ও স্থানীয় প্রশাসকের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে তা থেকে যে ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে সেটি হলো-

  • বৌদ্ধ ১২ গ্রামবাসী জানায়, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর তছনছ করার জন্য সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী ইন দিন ও পার্শ্ববর্তী আরো কমপক্ষে দুটি গ্রামের বৌদ্ধ বাসিন্দাদের সংগঠিত করেছে। এছাড়া বৌদ্ধ ১১ গ্রামবাসী জানায়, ওইসব সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড বৌদ্ধদের দ্বারাই হয়েছে। অবশ্য সরকার ও সেনাবাহিনী বার বার দাবি করছে, রোহিঙ্গা জঙ্গিরা গ্রাম ও বাড়ি দখল করার জন্য সহিংসতার সৃষ্টি করছে।
  • রাখাইনের রাজধানী সিত্তয়ে-র গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করা তিন আধা সামরিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সেনা কমান্ড চেইন থেকে ইন দিনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো ‘পরিষ্কার বা নিশ্চিহ্ন’ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। এক আধা সামরিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অভিযানের সময় শনাক্তকরণ এড়ানোর জন্য অসামরিক পোশাক পরতো।
  • গ্রামীণ প্রশাসক মং থিন চ্যা ও আধা সামরিক পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন,  আধা সামরিক বাহিনীর কয়েক সদস্য বিক্রি করার জন্য মোটরসাইকেলসহ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সম্পত্তি লুটপাট করেছে।
  • চার পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ইন দিনের ওই অপারেশন সেনাবাহিনীর ৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের সাহায্য করেছে আধা সামরিক বাহীনীর অষ্টম পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।

আমেরিকার আইনজীবী মাইকেল জি কারভ ওই ঘটনায় হেগ-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন।  তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য সামরিক বাহিনীই বৌদ্ধ নাগরিকদের সংগঠিত করেছে। যেহেতু আক্রমণ রোহিঙ্গাদের বা তাদের অন্তত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে মনে হয় সেহেতু এটি নির্দিষ্টভাবে গণহত্যার অভিপ্রায়।’

কারভ বলেন, যদি এটি দেখা যায়, ওই হামলা রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে করা হয়েছে এবং সরকারি হেফাজতে (রোহিঙ্গা) পুরুষদের মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সামরিক কমান্ডারদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলা করা যেতে পারে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক কেভিন জন হেলার যিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সাবেক বসনিয়া-র সার্বে-র নেতা রাডোভান করাদজিক-এর আইনি সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সামরিক কমান্ডের মাধ্যমে গ্রামগুলাে পরিষ্কার করার জন্য একটি আদেশ ছিল। এর মানে, ‘জোর করে নিশ্চিহ্ন করা’র পদক্ষেপ যা মানবতা বিরোধী অপরাধ।

গত ডিসেম্বরে রাখাইনের ওয়েস্টার্ন কমান্ড বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মং মং সোয়ে-র ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়নি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশটির নেতা অং সান সু চি কথা না বলায় তার পশ্চিমি সমার্থকরা হতাশ হয়েছেন। তারা আশা করেছিলেন, ২০১৫ সালে নির্বাচনে তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্রেসি গণতান্ত্রিক সংস্কার করবে। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, ২০১০ সালে গৃহবন্দি হওয়া থেকে সু চি-র মুক্তি- সব হয়েছে জেনারেলদের ইচ্ছায়।

সরকারের মুখপাত্র জ তেও বলেন, ‘কোথাও কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘন অভিযোগের বিষয়টি আমরা অস্বীকার করছি না এবং এড়িয়েও যাচ্ছি না। যদি শক্ত ও নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই সরকার তদন্ত করবে। এরপর যদি মানবাধিকার লঙ্ঘণের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে প্রচলিত আইন অনুসারেই শাস্তি দেয়া হবে।’

যখন জ তেও-কে বলা হয়, আধা সামরিক পুলিশ কর্মকর্তারা জানেয়েছে, ইন দিনের রোহিঙ্গাদের ‘নিশ্চিহ্ন’ করার আদেশ তাদের দেয়া হয়েছে তখন বলেন, ‘আমাদের যাচাই করতে হবে। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মিয়ানমার পুলিশ বাহিনীকে ওই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’ এছাড়া আধা সামরিক পুলিশ কর্মকর্তাদের লুটপাটের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেও এসবের পুলিশি তদন্তের আশ্বাস দেন তিনি।

আশ্চর্য হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ গ্রামবা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানোর জন্য স্বীকার করে জ তেও বলেন, ‘আমরা স্বীকার করছি যে, আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু আমাদের এটি যাচাই করতে হবে, কে বা কারা করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি আসলে খুব কঠিন।’

অন্যদিকে রাখাইনের সামরিক অভিযানটিকে জ তেও সমর্থন করেন। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, প্রথম কারা  সন্ত্রাসী হামলা করেছে।’ ওই ধরনের সন্ত্রাসী হামলা যদি ইউরোপিয়ান দেশগুলো বা যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনে ঘটে তাহলে মিডিয়া কী বলবে বলে প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।

সেনাবাহিনী তাদের ওই কাজে ইন দিন গ্রামের একটি বৌদ্ধ গ্রুপের সহায়তা পায়। গ্রামবাসীর ভাষায় ওই গ্রুপে ছিল ৯ জন। ২০১২ সালে রাখাইনের বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে ওই সশস্ত্র গ্রুপটি গঠিত হয়। মূলত ওই সংঘাতের শুরু হয় তিন মুসলিম যখন এক বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। পরে অবশ্য মিয়ানমার গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তাদের তিনজনের ফাঁসির রায় হয়।

ইন দিনের ওই নিরাপত্তারক্ষী গ্রুপটি বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চলে পাহারা ঘাঁটি স্থাপন এবং নিজেরা গার্ড হিসেবে কাজ করে। ওই গ্রুপে আছে যোদ্ধা, স্কুল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বেকার তরুণরা। সেনাবাহিনীর কাছে তারা খুব দরকারি। কারণ তারা স্থানীয় রাস্তাঘাট খুব ভালাে চেনে- এমনটিই দাবি ইন দিনের বৌদ্ধ প্রশাসক মাউন থে চায়।

ওই গ্রুপের ৮০ থেকে ১০০ জনের কাছে সব সময়ই রামদা ও লাঠি থাকে। ওই গ্রুপের একজনের মতে, তাদের কাছে বন্দুকও আছে। অনেকে আবার সেনাবাহিনীর পোশাক পরা অবস্থাতেও থাকে।

৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি আসার পর পরই কিছুদিন ধরে সৈনিক, পুলিশ ও বৌদ্ধরা ইন দিনের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়- স্থানীয় ১২ বৌদ্ধ এ কথা জানায়।

অষ্টম পুলিশ ব্যাটালিয়নের প্যারা মিলিটারি দুই পুলিশ অফিসার তাদের বাহিনীকে ওই ৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রির সঙ্গে মিলে রোহিঙ্গা পল্লীতে অভিযান চালাতে বলে। তাদের একজন জানায়, উচ্চ পদস্থ এক কমান্ডার তাদের ‘গো অ্যান্ড ক্লিয়ার’-এর আদেশ দেন। এর মানে দাঁড়ায় রোহিঙ্গাদের বাড়িতে ব্যাপক আগুন দেয়া।

রাখাইনের গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে রয়টার্স-এর সাংবাদিক ওয়া লোন এবং চ সোয়ে উকে গত ১২ ডিসেম্বর আটক করা হয়। এ মাসের শুরুতে আদালত থেকে হাজিরা দিয়ে বের হওয়ার সময় তোলা ছবি REUTERS/Jorge Silva

 

ইন দিনে উত্তরের পল্লীগুলোয় অভিযানের ঘটনা বর্ণনা করেন দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার। ওই অভিযানে কাজ করেছে ২০ সৈনিক ও পাঁচ থেকে সাত পুলিশ। সেনাবাহিনীর কোনাে এক ক্যাপ্টেন অথবা মেজর ওই বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়। তেমনি পুলিশের দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশ। ওই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের ফিরে আসার ক্ষেত্রে ভয়-ভীতি দেখানো।

‘যদি থাকার একটু জায়গা পেয়ে যায়, খেতে পায় তাহলে তারা আরো হামলা করতে পারে। এ কারণে আমরা নিরাপত্তা ইস্যুতে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছি’- এ কথা ওই দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার।

ইন দিনের বৌদ্ধ প্রশাসক মাউং থে চায় ও দ্বিতীয় পুলিশ অফিসারের মতে, সৈনিক এবং আধা সামরিক বাহিনী সাধারণ নাগরিকের পোশাকে গ্রামবাসীর সঙ্গে মিলে যায়। যদি কোনােভাবে মিডিয়া হামলার ব্যাপারটি ধরে ফেলত তাহলে ‘আমরা হয়তাে ভাল বিপদে পড়তাম।’

পুলিশের এক মুখপাত্র কর্নেল মিয়ো থু সো জানান, বাহিনীর কেউ নাগরিকের পোশাকে হামলা করার ব্যাপারে কোনাে তথ্য তার জানা নেই। তিনি ওই ঘটনাটিকে ‘অসম্ভব’ দাবি করে রয়টার্স-কে বলেন, এমনকি গ্রামে ‘গো অ্যান্ড ক্লিয়ার’ বা ‘সেট ফায়ার’-এর উদ্দেশ্যে কোনাে হামলার আদেশ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। যদি এ রকম কোনাে আদেশ দেয়া থাকে তাহলে সেটির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে এবং যথাযথ তদন্তও হবে।

মিয়ো থু সো বলেন, আমি যা বলতে চাই তা হলাে, এখানে নিরাপত্তা বাহিনী সব সময় আদেশ ও নিয়মের অধীন কাজ করে এবং তারা এক্ষেত্রে বাধ্য। ফলে আমি মনে করি না, এসব অভিযোগের কোনাে সত্যতা আছে।’ ওই বিষয়ে আর কোনাে মন্তব্য করতে রাজি নয় তারা।

ইন দিন গ্রামের হাসপাতালের এক সহকারী মেডিকেল অফিসার অং মায়াত তুন (২০) জানান, তিনি এ ধরনের অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মুসলিমদের ঘরে আগুন দেয়া বেশ সহজসাধ্যও। কেননা তাদের খড়ের ছাদ, হালকা আগুনেই বিনাশ। গ্রামের বয়স্ক বৌদ্ধ সাধুদের পোশাক লাঠির আগায় আটকিয়ে কেরোসিনে ডুবানো হতাে। তবে আমাদের মোবাইল ফোন আনা নিষেধ ছিল। বলা ছিল, কেউ যদি ছবি তোলেন তাহলে পুলিশ সোজা গুলি করবে।’

এ ছবিটি এক বৌদ্ধ গ্রামীণ বৃদ্ধের কাছ থেকে সংগ্রহ করে রয়টার্স -ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফন্ডারব্রিডার-কে রয়টার্স  ছবিটি পাঠালে তিনি বলেন, এখানে কমপক্ষে দু’জনকে চাপাতি, চাকু বা এ ধরনের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে

পাহারাদার সান থেইন ও গ্রামের নিরাপত্তা বিষয়ে দায়িত্বশীলদের একজন বলেন, ওই বাহিনী প্রথমে মুসলিমদের ঘরে আগুন দেয়। পরে তারাই আবার বৌদ্ধদের গ্রামে আগুন দেয়ার কাজটি করে।

‘কালারা পালিয়ে গেলে সেখানে গ্রামের বাজার থেকে বিনামূল্যে কেরোসিন সংগ্রহ করি।’ কালার বলতে তারা দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসাদের নিন্দার্থে বােঝায়।

রাখাইন এক তরুণ বৌদ্ধ জানায়, রোহিঙ্গাদের জ্বলন্ত একটি ঘর থেকে এক শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনেন তিনি। আরেকজন জানান, তিনিই ওই আগুন দেয়ার কাজে ছিলেন। সু চ্যা যিনি ১০ লাশের কবরটি খোঁড়ার কাজ করেছেন। তিনি জানান, একটি হত্যায় অংশ নিয়েছেন। রয়টার্সকে তিনি জানান, ইন দিনে তারা ২৮ আগস্ট আবিষ্কর করেন এক পুরুষ ও এক নারী খড়ের গাদার আড়াল থেকে কি যেন দেখছেন এবং স্মার্টফোনে ছবি তুলছেন।

সৈনিকরা সু চ্যা-কে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বলে। তিনি বলেন, ‘ আমরা ওই পুরুষের দিকে ইশারা করে দাঁড়িয়ে যেতে বলি। তাকে আমি ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করলে তিনি শুয়ে পড়েন। তখন আরেকজন তাকে গুলি করে।’

উত্তর রাখাইনেও ওই ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকটা ঘটেছে। ১০-১২ বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা নিবাসী এমনটি জানিয়েছেন।

রাখাইনে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি না দাঁড়ানোয় তার বহু পশ্চিমি সমর্থকদের হতাশ করেছে  -REUTERS/Adnan Abidi

জাতিসংঘ অপারেশনাল স্যাটেলাইট অ্যাপ্লিকেশন কার্যক্রমের তথ্য থেকে জানা গেছে, ১১০ কিলোমিটারজুড়ে রোহিঙ্গা আবাসভূমি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মতে, গত ২৫ আগস্ট থেকে ৩ মাস ধরে ৩৫০টির বেশি গ্রাম ওই হামলার শিকার হয়েছে।

ইন দিন থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে লংদু গ্রামের থার নগ (৩৮)-এর ওপর পুলিশের ডাক পড়ে। তাকে ওই বৌদ্ধদের গ্রুপে যুক্ত হতে বলা হয়- ‘সেনাবাহিনী আমাদের পো তি কৌংয়ের কালার গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার আদেশ দেয়।’  তার বর্ণনা মতে, চারজন গ্রামের এবং ২০ জনের বেশি সৈনিক ও পুলিশ ওই কাজে জড়িত ছিল- ‘পুলিশ ঢুকেই গ্রামে গুলি করে যাতে গ্রামের লোকজন আগেই পালিয়ে যায়। পুলিশ মূলত ওই কাজ করে এ জন্য যে, তারা অনেক গ্রামবাসী রোহিঙ্গা ‘সন্ত্রাসী’দের সমর্থন দিচ্ছে। তাই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়াটাই উচিৎ।’

লংদু থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে তা মান থা গ্রামের এক বৌদ্ধ শিক্ষার্থী জানায়, সেও রোহিঙ্গা হামলায় অংশ নিয়েছে। ‘কালার’ গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে আর্মি অফিসার ৩০ সহকারী নিয়োগ করে। বাকি ৫০ জন মোটরবাইক ও বাজার থেকে তেল সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিল।

‘তারা আমাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়। এমনকি আমাদের গ্রামে ঢুকতেও দেয়া হতাে না। আমাদের আগে গ্রাম ঘেরাওয়ের কাজ করতে এবং সামনে এগোতে হতাে। পরে সেনাবাহিনী হামলা করলে আমাদের এগিয়ে যেতে আদেশ দেয়া হয়’- ওই শিক্ষার্থী সাগ্রহে জানায়।

‘রোহিঙ্গারা ইন দিন থেকে পালিয়ে গেলে বৌদ্ধরা তাদের সম্পত্তি দখল করে নেয়, এমনকি তাদের মুরগি-ছাগলও’- এ কথা রয়টার্সকে জানায় বৌদ্ধ গ্রামবাসী। কিন্তু দামি সম্পত্তি যেমন- মোটরসাইকেল ও গবাদিপশু নিয়ে যায় অষ্টম পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং তা বিক্রি করে দেয়’- এ কথা জানান সেখানের পুলিশ অফিসার ও আদ দিন গ্রাম প্রশাসক মাউং থ্যা চ্যায়। তিনি জানান, অষ্টম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার থান্ট জিন ও এক বৌদ্ধ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ওইসব দখলকৃত সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার চুক্তি করা হয়। ওই পুলিশ অফিসার জানান, তিনিও সেই থান্ট জিন-এর জন্য রোহিঙ্গা গ্রামের চারটি গরু ছিনিয়ে আনেন।

ফোনে পাওয়া গেলে থান্ট জিন ওই ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুলিশের মুখপাত্র কর্নেল মিয়ো থু সো অবশ্য জানান, তিনি ওই লুটপাটের ব্যাপারটি তদন্ত করবেন।

রয়টার্স প্রত্যক্ষদর্শীদের যেমন- ইন দিনের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও রোহিঙ্গাদের যারা বাংলাদেশে আশ্রিত আছে তাদের কাছ থেকে প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক এই ১০ জনের পরিচয় বের করা গেছে।

তাদের মধ্যে ৫ জনই বয়স্ক ব্যক্তি। তারা হলেন দিল মোহাম্মাদ (৩৫), নুর মোহাম্মেদ (২৯), সোকেত উল্লাহ (৩৫), হাবিজু (৪০) ও শাকের আহমেদ (৪৫)। তারা মূলত জেলে ও মাছ বিক্রেতা। তাদের মধ্যে ধনী হিসেবে আছেন আবুল হাসিম (২৫) যিনি জাল ও নানান যন্ত্র বিক্রি করেন। আবদল মজিদ (৪৫) যিনি ৮ বছর বয়সী সন্তানের পিতা। আছে স্কুলছাত্র আবুলু (১৭) ও রসিদ আহমেদ (১৮)। এছাড়া আবদল মালিক (৩০) হলেন আলেম।

গত ২৭ ও ২৮ আগস্ট সেনাবাহিনীর আগমন এবং রোহিঙ্গাদের পলায়ন : ২৭ আগস্ট প্রায় ৮০ সদস্যের সেনাদল সেখানে আসে এবং গ্রামবাসীকে জানায়, তারাও চাইলে সেনাদের সঙ্গে নিরাপত্তা অভিযানে অংশ নিতে পারে। ৫ গ্রামবাসী এমনটি জানিয়েছে। ওই সময় রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রায় সবার বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়। তবে বৌদ্ধদের একটি ঘরেও হাত দেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রায় ১২ জন এমন বর্ণনা দিয়েছেন। ২৮ আগস্ট পশ্চিম হ্যামলেট এলাকার মুসলমানরা সেখান থেকে পূর্ব দিকের পাহাড়গুলোয় আশ্রয় নেন। পশ্চিম হ্যামলেটের কয়েক ডজন রোহিঙ্গা মুসলমান এমন বর্ণনা দিয়েছেন যারা এখন বাংলাদেশরে আশ্রয় ক্যাম্পগুলোয় অবস্থান করছেন।
১ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপ ও গ্রেপ্তারের দিন : পাহাড় থেকে নেমে আসতে শুরু করেন রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের দিকে রওনা হওয়াদের দলেই ছিলেন গণকবরে ঠাঁই হওয়া হতভাগা রোহিঙ্গারা। নিহতদের স্বজন ও প্রতিবেশীরা এটি নিশ্চিত করেন। সেনা ও বৌদ্ধদের একটি যৌথ দল তাদের সামনে চলে আসে। তারা ১০ রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আলাদা জায়গায় নিয়ে যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এটি। গ্রামের স্কুলঘরের কাছেই ১০ জনকে দু’হাত মাথার পেছনে করে হাঁটু গেঁড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় তাদের জামা-কাপড় ও খাবার দেয়া হয়। বৌদ্ধ প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য এটি।
২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ধাপ ও ভোরে হত্যা : ওই ১০ জনকে বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের জন্য কবরস্থানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ রোহিঙ্গা মুসলমানকে খেদাতে খেদাতে হত্যাস্থলে নিয়ে যেতে দেখেছেন এমন ৩ বৌদ্ধের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। ১০ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী স্বীকার করে নেয়, বৌদ্ধ গ্রামে ১০ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, গ্রামবাসী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর কয়েকজনকে সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে।

 

গত ১০ জানুয়ারির সেনাবাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনী সামুদ্রিক অঞ্চলের দিকে ধাবিত হচ্ছে যেখানে তারা লাঠি-রামদাসহ ২০০ বাঙালির দ্বারা হামলার শিকার হয়। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নিরাপত্তা বাহিনী আকাশের দিকে গুলি করলে বাঙালি বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে যায়। ১০ জনকে গ্রেফতারও করা হয়।’

তিন বৌদ্ধ ও ডজনের বেশি রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শী ওই ঘটনার সঙ্গে একমত নন। ঘটনা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। বৌদ্ধরা বলতে চেয়েছে, সৈনিকদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপাড়ে সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অজানা রয়ে গেছে, কেউ বলেননি ইন দিনে সেনাবাহিনীর হামলাটির ব্যাপকতা কতটা ভয়াবহ ছিল।

রয়টার্সকে ১০ জানুয়ারির বিবৃতির দিকে ইশারা করে আর কথা বাড়াতে রাজি হননি সরকারি মুখপাত্র জ তেও। অন্যদিকে সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোনাে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সমুদ্রপাড়ের কাছাকাছি থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, আবদুল মালিক তার ছেলেসহ বাঁশ আর আশ্রয়ের সন্ধানে গ্রামে ফিরে যান। যখন ফিরে আসেন তখন সাত সৈনিক ও সশস্ত্র বৌদ্ধরা তাকে অনুসরণ করে। তখন আবদুল মালিককে তাদের কাছাকছি আসতে দেখে রক্তাক্ত শরীরে। অন্য প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, আসলে তাকে মাথায় ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, তারপর সেনাবাহিনী বন্দুকের ইশারায় ৩০০ রোহিঙ্গাকে ধান ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বলে। সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গা মূলত মিয়ানমারের ভিন্ন অঞ্চলের সন্তান, ভাষাও ভিন্ন। শিক্ষিত গ্রামবাসী আবার রোহিঙ্গাদের ভাষা তাদের কাছে ব্যাখ্যা করে।

‘আমি বেশি দূর শুনতে পারিনি। কিন্তু তারা আমার স্বামী ও আরো পুরুষকে থামতে এবং কাছে যেতে বলে’- নুর মোহাম্মদের স্ত্রী রেহেনা খাতুন (২২) এ কথা জানান। নুর মোহাম্মদ ওই ১০ জন নিহতের একজন- ‘আমরা শুনতে পাই, পুরুষদের সঙ্গে সেনাবাহিনী আলাপের কথা বলে এবং বাকিদের পাড়ে আসতে বলে।’

সেনাবাহিনী ওই ১০ জনকে ইন দিনের একটি স্কুলে সারা রাত জিজ্ঞাসবাদ করে। এক সেনা কর্মকর্তার মতে, রসিদ আহমেদ ও আবুলু ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গা বিদ্রোহের আগ পর্যন্ত রাখাইনে বৌদ্ধ ছাত্রদের সঙ্গেই পড়াশোনা করতাে। পরে স্কুলগুলো সমাপনী পরীক্ষার আগ দিয়েই বন্ধ হয়ে যায়।

‘আমার শুধু স্মরণে আছে, সে বসে ছিল ও কিছু পড়ছিল। এটি আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয়। কারণ আমি তো পড়তে জানি না’- এ কথা বলেন রসিদের বাবা আবদুস সাকুর (৫০)। ‘তাকে পড়তে দেখলেই ভালাে লাগতাে। বেঁচে থাকলে আমাদের বংশের প্রথম শিক্ষিত ছেলে হতো সে’- যোগ করেন তিনি।

একটি ছবি যা সন্ধ্যায় যখন তারা গ্রেফতার হয় তখন তোলা। সেখানে দেখা গেছে, দুই রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ও ৮ পুরুষ গ্রাম্য ক্লিনিকের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে আছেন শরীরে জামাহীন। যখন তাদের উঠিয়ে নেয়া হয় তখন ১০ থেকে ১২ জন তা দেখেছিলেন।অেবশ্য কারণ তখনাে পরিষ্কার নয়। পরে বৌদ্ধ গ্রামবাসী জানায়, মৃত্যুর আগে তাদের মাংস-ভাত দেয়া হয়, পরিষ্কার জামাও।

২ সেপ্টেম্বর তাদের গ্রামের উত্তর দিকে নেয়া হয় কাছে বৌদ্ধদের কবরস্থানের পাশেই- এ কথা জানায় বৌদ্ধ গ্রামবাসী। জায়গাটি পাহাড়ের পাশে গাছগাছালিতে ঘেরা। হাঁটুভাঙা অবস্থায় তাদের ছবি তোলা হয় এবং সেনাবাহিনী মৌং নি এক বৌদ্ধ কৃষক নিখোঁজের ব্যাপারে তাদের নানান প্রশ্ন করে। এক বয়োবৃদ্ধ ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন।

রয়টার্স অবশ্য মৌং নি’র ব্যাপারে তেমন কোনাে তথ্য হাজির করতে পারেনি। তবে বৌদ্ধ প্রতিবেশীদের মতে, ২৫ আগস্ট ওই কৃষক তার গবাদিপশুসহ বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। অনেক রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা গ্রামবাসী রয়টার্সকে জানায়, তারা বিশ্বাস করেন, ওই কৃষককে হত্যা করা হয়েছে। তবে এ হত্যার সঙ্গে ওই ১০ জনের যোগসূত্র আছে কি না তা জানেন না। অথচ ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে দাবি করা হয়, মৌং নি’র হত্যার সঙ্গে ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ জড়িত। কিন্তু কারা জড়িত তা জানাতে পারেনি সেনা কর্তৃপক্ষ।

২ সেপ্টেম্বরের সকালে তোলা এক ছবিতে দু’জনকে দেখা গেছে যারা আটককৃত রোহিঙ্গাদের পেছনে। তারা আসলে অষ্টম নিরাপত্তা পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য। ওই দুজনকে তাদের ফেইসবুক ও সাক্ষাতে এর সত্যতা যাচাই করেছে রয়টার্স ।

ওই দু’জনের একজন অং মিন যিনি ইয়াঙ্গুন থেকে এখানে এসেছেন। আটককৃতদের একদম পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি অস্ত্র হাতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। আরেকজন পুলিশ ক্যাপ্টেন মো ইয়ান ন্যাং একেবারে বাম দিকের জন। তিনি কাঁধে অস্ত্র হাতে হাঁটছেন।

কবর : প্রতিবেদক ওয়া লোন-এর তোলা গণকবরের কিছু ছবি তিনজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। এখানে মানুষের মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড় রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান

 

গত ডিসেম্বরে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক গ্রেফতার হন। এর পরের দিন মো ইয়ান ন্যাং গ্রেফতার হন এবং ১৯২৩ সালের গোপনীয়তা আইনের অধীন মামলা হয়ে তা তদন্তাধীন রয়েছে।

অং মিন যিনি কোনাে আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি নেননি। এছাড়া রয়টার্সের সঙ্গে কথাও বলতে রাজি হননি।

তিন তরুণ বৌদ্ধ জানান, তারা ঘর থেকে ১০ জনকে যেখানে হত্যা হয়েছে সেখানে নিতে দেখেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সো চ্যা যিনি আবার কবর খোঁড়ার কাজও করেছেন। তিনি জানান, মৌং নি’র সন্তানদের সেখানে ডাকা হয় তারা যেন প্রথম আঘাতটি করে।

সো চ্যা-এর বর্ণনা অনুযায়ী ন্যাংয়ের ছেলে প্রথমে ইসলামি শিক্ষক আবদুল মালিক-এর মুণ্ডু ছেদ করে। দ্বিতীয় সন্তান আরেকজনের ওপর হামলা চালায়।

‘দুজনের হামলার পর বাকি বাহিনীর লোকজন গুলি চালায়। প্রত্যেকের শরীরে কমপক্ষে তিনটি করে গুলি লাগে।’ কবর খোঁড়ার কাজ করা আরেকজন জানায়, ‘সেনাবাহিনী কিছু লোককে গুলি করেছে।’

১০ জানুয়ারির বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানায়, দুই ভাই ও আরেকজন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’দের মধ্যে রামদা নিয়ে মারামারি হয়। এরপর সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেখানে বন্দিদেরওিপর গুলি চালায়- ‘গ্রামবাসীসহ যারাই ওই হত্যায় অংশ নিয়েছে তাদের বিচার হবে এবং সেনাবাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে ওই অনুযায়ী বিচার হবে।’ কিন্তু ওই আইন কেমন আইন তা জানা যায়নি।

তুন আয়, মৌং নি’র সন্তান ওই হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়- এ খবর জানা গেছে গত ১৩ জানুয়ারি তার আইনজীবী মারফতে। ৮ ফেব্রুয়ারি ওই আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে নারাজ থাকে। তবে অভিযুক্ত অন্য ভাইকে পাওয়া যায়নি।

অক্টোবরে ইন দিনের আবাসিক লোকজন সাংবাদিকদের ওই হত্যার জায়গাটি দেখায়। সেখানে তারা নতুন লাশ দেখতে পায় যা ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে আছে। কিছু হাড় পুরনাে কাপড়ে পেঁচিনো অবস্থায় পড়ে আছে। হাতে বাঁধা ওই কাপড়ের সহায়তাতেই  ছবির ব্যক্তিদের চেনা সহজ হয়েছিল।

রয়টার্স ওই ছবি বিদেশি তিন ফরেনসিক গবেষকদের দেখিয়েছে। হোমার ভেনটার্স যিনি ফিজিশিয়ানস ফর হিউমেন রাইটস-এর পরিচালক। দেরিক পাউন্ডার যিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংঘ-এর পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া লুই ফন্ডেব্রিডার যিনি আর্জেন্টিনা ফরেনসিক এনথ্রোপলজি দল-এর সভাপতি এবং আর্জেন্টিনায় সত্তর ও আশির দশকের সেনা সরকার আমলে নিহতদের কবর নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা ওই ছবির হাড়গুলো মানবদেহের বলে স্বীকার করেছেন। এমনকি বুকের হাড়সহ মেরুদণ্ড, রিবস, স্ক্যাপুলা ইত্যাদিও সেখানে আছে। পন্ডার সেখানে কোনাে প্রাণীর হাড় পাননি।

এক রাখাইন বৌদ্ধ প্রবীণ ব্যক্তি হত্যার পরের ছবি রয়টার্সের সাংবাদিকদের পাঠান। সেখানে ওই ১০ জনের পোশাক আগের ছবির মতােই আছে এবং ওই হলুদ দড়ি দিয়েই হাত বাঁধা। একটি গর্তে তাদের ফেলা আছে। রক্ত চারপাশে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষক আবদুল মালিকের মুণ্ডু ছেদ দেখা যাচ্ছে এবং আবুলুর ঘাড়ে দেখা গেছে বিশাল আঘাত। কবর খোঁড়ার কাজ করা সেই সো চ্যায়ের বর্ণনার সঙ্গে ব্যাপক মিল পাওয়া গেছে ছবিতে।

গলুই ফন্ডেব্রিডা-র ওই ছবি বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, দুটি দেহই ব্যাপক ‘ধারালো কিছু দিয়ে গলা বরাবর আঘাত’-এর মধ্য দিয়ে গেছে।

তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রিয়জনদের হত্যার খবর সেভাবে জানতেন না।গেত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে রয়টার্সের সাংবাদিকরা তাদের কাছে খবর পৌঁছে দেন।

‘আমি বুঝাতে পারছি না কেমন লাগছে! আমার স্বামী নেই’- রেহানা খাতুন, নুর মোহাম্মদের স্ত্রী। ‘তিনি তো আর ফিরবেন না। আমি আর কিছু চাই না। চাই খালি ন্যায়বিচার।’

ইন দিন-এ ছবি সরবরাহকারী বৌদ্ধ ওই ব্যক্তির ছবিটি  হস্তগত করার ব্যাপারে উদ্দেশ্য কী ছিল জানতে চাইলে বলেন, ‘এক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকতে চাই। আমি চাই না ওই নির্বিচারে হত্যা এই ভূমিতে আর ঘটুক।’

১ thought on “রোহিঙ্গা গণকবরের ছবি ও তথ্য-প্রমাণ

কমেন্ট বন্ধ।