স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই পাকিস্তান দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছে। এবং বহু বছর ধরেই তাদের মধ্যে এই সুসম্পর্ক বিদ্যমান। ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান বিষয়েও পাকিস্তান আমেরিকার বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবেই কাজ করেছে।
এসব সহযোগিতার প্রতিদান হিসেবে আমেরিকাও পাকিস্তানকে ভালো মন্দ সব সময় সমর্থন দিয়ে গেছে। পাকস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্র থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি এমনকি দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডকেও আমেরিকা বিনাবাক্যে সমর্থন করে গেছে।
কিন্তু কয়েক মাস যাবৎ আইএসআই এক চতুর খেলা শুরু করেছে যাতে এটা প্রতীয়মান হয় যে তারা দ্রুতই পাকিস্তানের সামরিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে আমেরিকার প্রভাব মুছে ফেলতে চায়। সেখানে পাকিস্তান বেপরোয়াভাবে সেখানকার ইসলামী মৌলবাদীদের মদদ জোগাচ্ছে। পাকিস্তান ইঁদুর বিড়াল খেলার অংশ হিসেবে আমেরিকা আর তালেবান উভয়কেও একজন আরেকজনের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
কিছুদিন আগে পাকিস্তান বিতর্কিত নেতা হাফিজ সাইদকে জেল থেকে মুক্তি দেয়। যাকে ২০০৮ সালের ভারতের মুম্বাই হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। পাকিস্তান বলেছে তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে সাইদের বিরুদ্ধে সকল ‘উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ’ পাকিস্তানি কতৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিলো। কিন্তু হাফিজ সাইদের আইনজীবী দাবী করেছে এরকম কোনো তথ্যই আদালতে হাজির করা হয়নি।
ইসলামী চরমপন্থিদের মদদ দেয়ার পেছনে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ভুমিকা আছে। কখনো কখনো তাদের এই ঐতিহাসিক নীতি উল্টো ফল বয়ে আনতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে যে কোনো লক্ষ্যের থেকে সাধারণ মানুষই বেশি জঙ্গি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। কিন্তু এ সত্বেও আইএসআই ভারত এবং আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রভাব ধরে রাখতে ইসলামী চরমপন্থি এজেন্টদের সাহায্য করাকে বেশি প্রধান্য দিয়ে থাকে।
সাধারণভাবে পাকিস্তান এসব কাজের দ্বারা আমেরিকাকে চাপে রাখতে পছন্দ করে। আবার যখন আমেরিকা হাফিজ সাইদের মত ব্যাক্তিদের “ সর্বোচ্চ আইনের আওতায়” এনে বিচার করতে বলে তারা সেটাই অনুসর করে থাকে।
এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ওসামা বিন লাদেনের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের আর পাকিস্তানের সম্পর্ক আগের জায়গায় নেই। অস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হলেও এটা সত্যি যে এই আল কায়দা নেতা বহুবছর যাবত পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে নিরাপদেই লুকিয়ে বাস করছিলো। যেটা ছিলো মিলিটারি একাডেমি থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বের মধ্যে। তাই তারা যে একে অপরের উপর বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলেছে তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না।
অন্য ব্যাপারটি হলো যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে আফগানিস্তান থেকে তার তল্পিপল্পা গুটিয়ে নিচ্ছে। তাই এই অঞ্চলে তার আর কোনো কৌশলগত স্বার্থ রক্ষারও প্রয়োজন নেই। সম্ভবত ইরানের বিষয়টা ব্যতিক্রম। যেহেতু পাকিস্তান এবং ইরান সাধারণভাবেই জাতীয় এবং প্রতিরক্ষার ব্যাপারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আছে। সুতরাং আমেরিকার সাহায্য নিয়ে বা সাহায্য ছাড়াই পাকিস্তান এই অঞ্চলে ইরানী প্রভাবের বাইরে ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। তাই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে চাচ্ছে। বরং এর বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান বড়শক্তি ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠছে। যেটা এশিয়ায় চীনা সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাকিস্তানের সাথেই চীনের সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, ভারত এবং ইরানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সব সময়ই মার্কিন সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। যা ছেড়ে বর্তমানে দেশটি দ্রুতই পরিষ্কারভাবে চীনা বলয়ে প্রবেশ করছে। চীনও তাদের সিল্ক রুট বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ করছে। যাতে তারা মালাক্কা প্রণালি এড়িয়েই পশ্চিমা বাজার দখল করতে পারে। আর এই বিনিয়োগ বর্তমানে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সাথে সাথে এই চাইনিজ অর্থনৈতিক প্রবেশ পথ সাধারণ পাকিস্তানিদের ভাগ্য উন্নয়নেও সাহায্য করছে। যার ফলে গোটা রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা খাতেও এই নতুন উন্নয়নের প্রভাব পড়ছে।
অন্যভাবে বললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ব্যাপারে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পেরে খুশিই হয়েছে। আর পাকিস্তানও চায়নার দিকে ঝুঁকতে পেরে স্বস্তি অনুভব করছে। হাফিজ সাইদের মামলা আসলে এই পরিবর্তনের একটি প্রতীক। যৌক্তিক ভাবে এটা ভাবা যায় যে এখন দেশের সব দলের সম্মতিক্রমে হাফিজ সাইদকে কোর্টের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিৎ অথবা আইসিসির হাতে তুলে দেয়া উচিৎ। সে যদি দোষী সাব্যস্ত না হয় তবে ভারত যে কোনো কারণ ছাড়াই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসীদের মদদ দাতা হিসেবে অভিযোগ করে আসছে তা ভুল প্রমানিত হবে। আর যদি সে দোষী প্রমানিত হয় তবে পাকস্তান রাষ্ট্রিয়ভাবে সন্ত্রাসের মদদ দাতা বলে বিবেচিত হবে।
কিন্তু সম্ভবত এমন কিছুই ঘটবে না। কারণ পাকিস্তান আর নিজেদের ওপর আমেরিকার ইচ্ছা বরদাস্ত করবে না আর আমেরিকাও নিজের গুরুত্বপূর্ন শক্তির উপর হাতকে গুটিয়ে নিচ্ছে এবং পাকিস্তানকে পাত্তা দিচ্ছে না। এটা মনে হতে পারে দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব বা বিভাজন তৈরি হচ্ছে। স্বভাবতই এর ফলে মুম্বাই হামলার ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায় বিচার ব্যাহত হতে পারে।
ইউএস ওয়ার কলেজ এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইন্সটিটিউট এর অধ্যাপক ড. আজিম ইব্রাহিম এর এই লেখাটি আল আরাবিয়ার মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়।