• কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতই ভরসা
• সবচেয়ে বেশি বিব্রত অবস্থায় শিক্ষিত বেকাররা
• প্রতি ১০০ উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির অন্তত ৯ জনের সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজেরও সুযোগ মিলছে না
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যা এখন ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৪ বছরের নীচে এবং ৬৫ বছরের বেশি জনসংখ্যা সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বয়সী (working age population) জনসংখ্যা প্রায় ৬২ শতাংশ।
এ থেকে লক্ষণীয়, কাজ করতে সামর্থ্যবানদের ওপর কাজ করতে অসমর্থদের নির্ভরতার চিত্র ভয়ানক। প্রতি ১০০ জনে– কর্মসক্ষম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হলো কর্ম-অনুপযোগী জনসংখ্যা। নির্ভরশীল জনসংখ্যার এই অধিক হার কর্মক্ষমদের জন্য কর্মসংস্থানের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরছে। ভবিষ্যতে যেহেতু গড় আয়ু আরও বাড়বে সুতরাং কর্মজীবীদের উপর বয়স্ক নিকটজনকে দেখার দায় আরও বাড়বে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে লক্ষ্যণীয়, ১৫ থেকে উর্ধ্ব বয়সী জনসংখ্যা গত দশকে বছরে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ আকারে বেড়েছে। যা ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৫ কোটি ৯০ লাখ। ২০১৬ সালে হয়েছে ৬ কোটি ২১ লাখ। এর মধ্যে ‘কাজে রয়েছেন’ বা ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত’ ব্যক্তির সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। এদেরও মূল অংশ (৩৩ শতাংশ) কৃষিতে যুক্ত নানারূপ শ্রমিক। ‘কাজ’ দেয়ার ক্ষেত্রে দেশে এখনও কৃষির স্থানই সর্বোচ্চ। প্রায় ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মসংস্থান হচ্ছে কৃষি থেকে। যদিও জাতীয় আয়ে কৃষি হিস্যা বর্তমান মাত্র ১৫ শতাংশ। কর্মসংস্থানে কৃষির পরেই অবস্থান সার্ভিস সেক্টরের, ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ‘শিল্প’ এক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ‘কাজে রয়েছেন’ এমন জনসংখ্যার ৮৬ দশমিক ২ ভাগই নিয়োজিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে।
২০১৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত ২০১৫-১৬ সালের ত্রৈমাসিক লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশের তখনকার জনসংখ্যা (১৫ কোটি ৮৫ লাখ)-এর ৩৩ শতাংশই ছিল ১৪ বছরের কম বয়সী।
এইরূপ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশকে বলা হয়, ‘তরুণদের দেশ।’ ফলে কর্মসংস্থান সুবিধার প্রসার বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে জরুরি এক প্রশ্ন। সর্বশেষ বাজেট বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন “আমাদের শ্রম বাজারে প্রতি বছর ২০ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে।”
কিন্তু দেশে কর্মসংস্থানের চিত্র ২০১৭ সালেও আশানুরূপ ছিল না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি’র) প্রবৃদ্ধি গত এক দশকে ৬ শতাংশ থেকে প্রায় ৭ শতাংশে উত্তরণ ঘটলেও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক প্রভাব কমই দেখা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে উদ্বৃত করে ২০১৭ সালের ২৯ মে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ‘এক দশক আগে দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কর্মসংস্থান বাড়তো, কিন্তু এখন তা কমে বছরে ৯ লাখ ৩৩ হাজারে নেমে এসেছে।’
সদ্য বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশে শিল্প নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বেশি মনযোগ পেলেও– শিল্পে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়া পোশাক খাত ক্রমে অধিকতর যন্ত্রায়িত ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ায় সেখানে আগের মতো আর শ্রমিকদের কাজের সুযোগ ঘটছে না। ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্স এন্ড এমপ্লয়মেন্ট আয়োজিত এক সেমিনারে গবেষক রুশিদান ইসলাম রহমান দেখিয়েছেন, ২০১৩-এর পর থেকে পোশাক খাতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে আছে।
আবার ভিন্ন বিবেচনায় ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতে এবং মাত্র ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ লোক অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত হতে পেরেছেন আনুষ্ঠানিক খাতে। শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে অনানুষ্ঠানিক খাতের বিরাট অংশ যেমন বাদ পড়ে আছে তেমনি আনুষ্ঠানিক খাতেরও বহু শিল্পে শ্রম আইনের বাস্তবায়ন অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ। ফলে কর্মসংস্থান মাত্রই এখানে কর্ম মজুরি ও অসংগঠিত থাকার এক ধরনের স্থায়ী নাজুকতাও বটে। এইরূপ বিবেচনা থেকেই ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিবিসি-বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে পরিসংখ্যানে যাদের ‘কাজ আছে’ ধরা হয় তাদেরও চার ভাগের এক ভাগের কাজটি নিয়মিত হয়।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিল অনুযায়ী শতকরা হিসাবে মোট কর্মসংস্থানের ৪৭ দশমিক ৩০ ভাগ কৃষি-মৎস্য-বনজ খাতে হচ্ছে। এরপরই হোটেল রেস্তোরা খাতের অবস্থান, প্রায় ১৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। দেশে কারখানা সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান মাত্র ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এছাড়া পরিবহন ও নির্মাণ খাত যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩৯ এবং ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কর্মসংস্থানের উৎস।
অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত ২০১৭ সালের বাজেট উত্থাপনকালে বলেছেন, (বাজেট বর্ক্তৃতা, পৃ. ৩৬) আমাদের শ্রম বাজার থেকে প্রতি বছর গড়ে ৪ লাখ শ্রমিক বিদেশ যাচ্ছে কাজের জন্য। কিন্তু ১৬ লাখ আরও নতুন কর্মসংস্থান দরকার দেশে।
বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপে ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত’ ব্যক্তি বলতে জরিপকালে সপ্তাহে অন্তত এক ঘন্টা কাজে যুক্ত ব্যক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এইরূপ অতি উদার মানদন্ড সত্ত্বেও বিবিএস-এর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেখা যায়, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ– যা ২০১৩ সালে ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার।
ক্রমে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপশি এও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দেশে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির মাঝে অন্তত ৯ জনের সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজেরও সুযোগ মিলছে না। অল্প শিক্ষিতদের মাঝে এই হার তুলনামূলকভাবে কম। কোন ধরণের শিক্ষার সুযোগ মেলেনি এমন কর্মক্ষমদের মাঝে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। অর্থাৎ পড়াশোনা কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে গেছে!
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে তাদের ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা’ শিরোনামে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। যার ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। যারা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর যারা অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। উপরোক্ত সমীক্ষায় আরও একটা লক্ষণীয় তথ্য ছিল এই যে, কম শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে; কিন্তু বেশি শিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার খুব দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ঠিক এই সময়েই আইএলও-এর ‘এশিয়া-প্যাসিফিক ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড’ নামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তারা পড়াশোনা করছেন না, আবার কাজও করছেন না। কাজ খুঁজে পেতে কোন প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। নিষ্ক্রিয় তরুণদের সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তৃতীয় খারাপ অবস্থানে রয়েছে।’
গতবছর আইএলও’র ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট সোশ্যাল আউটলুকে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ এর মাঝে বৈশ্বিক কর্মসংস্থান কমবে বিধায়– তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। অর্থাৎ ২০১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জে থাকবে। আইএলও’র এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২ তম। যদিও বাংলাদেশ সরকার বলছে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৫-এর জুলাই থেকে ২০২০ এর জুনের মাঝে ১ কোটি ২৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।
উল্লেখ্য, এখানে গ্রাম ও শহরে জনসংখ্যা হিস্যা বর্তমানে ৭০:৩০। আর সর্বশেষ লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী গ্রাম ও শহরে বেকারত্বের তুলনা হলো ১৮.২ লাখ : ৭.৭ লাখ।
সেইফটি এন্ড রাইটস্-এর তথ্য সহযোগিতায় প্রকাশিত।