“হারিয়ে যাইনি দেখ এখনো চলছে হৃৎপিন্ডটা
অামি স্বপ্ন দেখি তোমায় নিয়ে সময় বাকী কিছুটা”
অারাফাত সানি। সাভারঘেঁষা অামিন বাজারে ১৯৮৬ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এক মাঝবয়সী তরুণ। সে এখনো স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার। তবে অর্থহীনের গানের কথার মতো অাক্ষরিক অর্থেই তার সময় কম। বয়স একত্রিশের ঘর পেরিয়েছে অারো চারমাস অাগে। ৩১ বছর অাহামরি নয়। দলটা বাংলাদেশ বলেই অাহামরি। সানির প্রত্যাবর্তনের পথটা তাই সুগম নয়। অতীত কিংবা ইতিহাসও তার বিপক্ষে। স্পিনার সানি অবৈধ বোলিং অ্যাকশনে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। অাবার কয়েকমাস পর নিজেকে বদলে ছাড়পত্রও পেয়েছেন। এর অাগে অারো দুই স্পিনার অাবদুর রাজ্জাক এবং সোহাগ গাজীও নিষিদ্ধ হয়ে ফিরেছিলেন। রাজ্জাক সুবিধা করলেও গাজী পারেননি। সানির অনুপ্রেরণার অধ্যায়টা বিভক্ত। অাশায়, নিরাশায়।
অাশা নিরাশার দোলাচলে এগিয়ে চলে জীবন। কখনো দুর্গম পথ কখনো সুগম। মাঝেমধ্যে নিজেকে মনে হয় সবচেয়ে সুখী, পরক্ষণে ডুবে যায় হতাশার অন্ধকারে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ১৬ ওয়ানডেতে ২৫ গড়ে ২৪, টি-টুয়েন্টিতে ১০ ম্যাচে ১৯.১৭ গড়ে ১২ উইকেট শিকারি অারাফাত সানি দেখেছেন মুদ্রার দুটো পিঠই। ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেট পাওয়া হয়নি কিন্তু ২০১৪ সালের নভেম্বরে টিম বাংলাদেশের কামব্যাক সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টানা দুই ম্যাচে চার উইকেট করে পেয়ে নিশ্চিত করেছেন বিশ্বকাপগামী বিমানের টিকিট। খেলেছেন মোটে একটি ম্যাচ। ইংলিশবধের অনন্য ইতিহাসের প্রত্যক্ষ এগারো যোদ্ধার একজন তাতেই। তবু তিনি সাদামাটা। হারিয়ে গেলেন। ২০১৪’র ফ্রেব্রয়ারিতে অভিষেক টি-টুয়েন্টিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন উইকেট পেলেও পারেননি থিতু হতে।
বাঁ’হাতি স্পিনারের স্বর্গ বঙ্গদেশে একজন অারাফাত সানির প্রতিভা ফেলে দেয়ার মতো নয়। ১৫ বছর বয়সে অনুর্ধ্ব-১৫ দল দিয়ে যাত্রার সূচনা। ২০০১-০২ মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রথম পদার্পণ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি, ধাপে ধাপে এগোনো। প্রতি মৌসুম শেষে উইকেট শিকারির তালিকায় নামটা উপরের দিকেই থাকে। মাঝে ২০১০-১১ মৌসুমে অালোচনার বাইরে, পরের মৌসুমেই অর্ধশতাধিক উইকেট প্রাপ্তিতে মনে করিয়ে দিলেন তাকে না ভোলার কথা। অনুর্ধ্ব-১৫ হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯, বাংলাদেশ ‘এ’ দল, বিপিএলে চিটাগাং কিংস, রংপুর রাইডার্স এবং জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা অারাফাত সানিকে মানুষ ভুলতে বসেছে। দলের বাইরে প্রায় দুইবছর হলো তার।
তিনি কি এতটা অবাঞ্ছিত! কুঁড়িবিশ ফরম্যাটে শ্রীলঙ্কার সাথের এই সিরিজেও কি দলে একটা সুযোগ পেতে পারতেন না তিনি? টেস্টে সুযোগ পেয়ে রাজ্জাক প্রমাণ দিয়েছেন আরেকপ্রস্থ, সানি কেন নয়? ডিপিএলের গেল ম্যাচে কলাবাগানের বিপক্ষে প্রাইম দোলেশ্বরের জয়ে অবদান রেখেছেন দুই উইকেট নিয়ে। তরুণ বাঁহাতি স্পিনার বিপিএলের চমক আফিফ হাসানের সুযোগ মিলেছে। বেশ, হি ইজ ইন ফর্ম। সাব্বির রহমানের ফর্মের গ্রাফ কতটা ঊর্ধ্বমুখী? সব দিক মিলিয়ে আরাফাত সানি অন্তত একটা চান্স পেতেই পারত!
২০১৬ সালের ৯ই মার্চ ভারতের ধর্মশালায় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তাসকিন এবং সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে রিপোর্ট করেন ম্যাচ অফিসিয়ালরা। এর প্রেক্ষিতে ১২ ও ১৫ মার্চ চেন্নাইয়ে পরীক্ষা দিলেও সন্দেহভাজন বোলিং অ্যাকশনের দায়ে নিষিদ্ধ হন দুজন। এরপর নিজেদের ঢেলে সাজিয়ে সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ ব্রিসবেনে ফের পরীক্ষা দেন। পরিশ্রম কখনো বেঈমানি করে না। ফলস্বরূপ দুজনই উর্ত্তীর্ণ হয়ে যান। ক্রিকেটাঙ্গনে ফেরে স্বস্তি। এর পরই ছিল ঘরের মাঠে অাফগান সিরিজ। সেখানে তাসকিন ফিরলেও সানির ফেরা হয়নি। তার ভাষ্যমতে, “অামার ভাবনায় এখন জাতীয় দল নেই। বোলিং অ্যাকশনেও কিছুটা পরিবর্তন এনেছি। এখন অাগে জাতীয় লীগে খেলে যাবো।” বোর্ডও তাই তাকে সময় দিয়েছে। একটু পরখ করার সুযোগ চেয়েছে। জাতীয় লীগে ভাল করলেও সানির ফেরা হয়নি। এ বছরের শুরুতে অারাফাত সানি জড়িয়ে পড়েন নারীঘটিত মামলায়। নাসরিন সুলতানা নামের একজন সানির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন অাইনে মামলা করেন। তার অভিযোগ, সানি তাকে বিয়ে করেছেন কিন্তু স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। এমনকি ফেসবুকে তাদের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি সানি ভাইরাল করেছেন। এ মামলায় ক্রিকেটার ৫৩ দিন শ্রী ঘরে বন্দী থাকেন। পরে অবশ্য দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় তিনি মুক্তি পান এবং নাসরিনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।
জীবন ছাপিয়ে ক্রিকেট। ক্রিকেটারদের দর্শন এমনই। ক্রিকেটে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অাবেগ ছাপিয়ে পেশাদারিত্ব হয়ে উঠছে প্রবল। পা হঁড়কালে বন্ধ চৌকাঠ। বৈচিত্র্যময়, মিতব্যয়ী বোলার অারাফাত সানির পা হঁড়কে গেছে। দলটা বদলে যাওয়া বাংলাদেশ বলেই তার ফেরার সম্ভাবনা অাছে। পারফরমেন্স কথা বলে সবসময়। সানি কি ফিরতে পারবে অাবার? বাঁ’হাতি অর্থোডক্স স্পিনে সাড়ে চারেরও কম ইকোনমি রেটে বল করা সানি কি দেখাতে পারবে ভেল্কি? নাকি ন্যুব্জ হবে বয়সের ভারে? সবকিছুর মতো এসব প্রশ্নের উত্তরও সময়ের হাতেই।