নেপথ্য নায়ক ডি মারিয়াকে একগুচ্ছ ভালােবাসা

নেপথ্য নায়ক ডি মারিয়াকে একগুচ্ছ ভালােবাসা

ফুটবল মানেই গোলের খেলা। দিন শেষে সবাই মনে রাখের গোল দেয়া হিরোদেরই। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবলভক্তরা আলাদা। তারা নজর ছড়িয়ে দেন মাঠের সর্বত্র, বিশেষত মধ্যভাগে যেখানে থাকেন অর্কেস্ট্রাতুল্য কয়েকজন তাদের অমূল্য পা দুটি নিয়ে। ‘ডি মারিয়া’ তেমনই একজন। রোজারিও-র কয়লা খনি থেকে উঠে আসা ওই তারকার আজ জন্মদিন। পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ নয়, পুরো লেখাই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। শুভ জন্মদিন মারিয়া।

★ এজনজরে

• নাম : অ্যাঞ্জেল ফ্যাবিয়ান ডি মারিয়া হার্নান্দেজ

• জন্ম তারিখ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮

• জন্মস্থান : রোজারিও, আর্জেন্টিনা

• উচ্চতা : ৫ ফিট ১১ ইঞ্চি

• পজিশন : অ্যাটাকিং মিডফিল্ড

• ‎জাতীয় দলে অভিষেক : ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮; ‎বিপক্ষ : প্যারাগুয়ে

• জাতীয় দলে মোট খেলা : ৯২ ম্যাচ, ১৯ গোল

• বর্তমান ক্লাব : পিএসজি

• জার্সি নাম্বার : ১১

 

★ লা দেসিমা, রিয়াল মাদ্রিদ ও ফাইনালের সেরা

রিয়াল মাদ্রিদ-এর লা দেসিমা জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি মানা হয় রামোস-কে। অন্তিম মুহূর্তে এমন কালজয়ী গোল দেয়া একজনকেই তো মানা হবে মহানায়ক। যে গোলের কাছে ম্লান টুর্নামেন্টজুড়ে দেয়া ক্রিশ্চিয়ানো-র রেকর্ড ভাঙা ১৭ গোলও সেখানে ফাইনাল সেরার পুরস্কার নিয়ে মাথা কেই বা ঘামাবে? ফুটবলে আবেগের সঙ্গে দেয়া হয় সেরার সম্মানও। তাই এক যুগ পর রিয়ালের আকাঙ্ক্ষিত শিরোপার বন্ধ পথ খুলে দেয়া রামোস নন, ১২০ মিনিটের যুদ্ধের সেরা সৈনিকের অর্ঘ্য স্যার ফার্গি তুলে দিয়েছিলেন ডি মারিয়ার হাতে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২০১৪ সালের ফাইনালে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন লিকলিকে দেহের মারিয়া’ই।

 

★ নির্ভার ভালােবাসা

উপরওয়ালা যখন দেন তখন সবটিই নিংড়ে দেন- কারো জন্য বসে থাকেন বরের নৈবেদ্য সাজিয়ে, কারো থেকে কেড়ে নেন সর্বস্ব। অামাদের কাছে একেকজনের একেক জিনিস ঈর্ষণীয়। কারো হাতের কারুকাজে অামরা মুগ্ধ, কারো মস্তিষ্ক বহিভূর্ত দূরন্ত অাইডিয়া দেখে-শুনে তার মতোই হতে চাই। অাবার কারো নামটিই এমন যেটা শুনলে ঈর্ষা হয়। ঈর্ষার সঙ্গে অাবার খুঁনসুটিতে মাতে ভালোবাসাও।

টিভি টেলিকাস্টের স্বর্ণ জমানায় মেসি-রোনালদো-র শিল্পে অামরা বা বার অবাক হই! তাদের ভূরি ভূরি সাফল্যে বিস্ময়ের ঘোরে ঘুরপাক খাই। সবাই তাদের মতো হতে চান। সবাই নন, ফুটবল দেখা কেউ কেউ ডি মারিয়াও হতে চাইবেন। যখন ফুটবলের অাজকের সময়টা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হবে তখন রন লিও-দের ঘাঁটবো অামরা। ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাদের পার্শ্বচরিত্র হিসেবে অাবির্ভূত হবেন নেইমার, ইব্রা, কাভানি, রুনি-রা। অতি উৎসুক জনতা তাদের মধ্যে মিল-অমিল খুঁজবে। অজস্র অমিলের ভিড়ে পাওয়ার মতো একটি মিলও পাবেন। নির্ভরশীলতা! ডি মারিয়া-র প্রতি তাদের নির্ভরশীলতার গল্পের সারাংশ ওই বইয়ে উল্লেখ থাকবে।

 

★ বিশ্ব কাপের বছর

চার বছর আগের বিশ্ব কাপে এত কাছে তবু কত দূরের যন্ত্রণা তাকেও পোহাতে হয়েছে সোনালি আভার ছোঁয়া পাওয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষায়। চারব ছর পর বিশ্ব কাপ-এর বছর এসেছে আবার। তাকে ছাড়া আর্জেন্টাইনদের আক্রমণভাগের ‘জাদুকরী চতুষ্টয়’ অসম্পূর্ণ। এরপরও নিজেকে এখনই বিশ্ব কাপের দলে দেখছেন না তিনি। কোচ হোর্হে সাম্পাওলি-র কথা তার কন্ঠেও প্রতিধ্বনিত- ‘দলে কেবল একজনের জায়গাই পাকা। রাশিয়া বিশ্ব কাপ জেতার সুযোগ রয়েছে মেসির। এটি তার প্রাপ্য।’

 

★ শিকড় থেকে সময়ের ডালে

মাত্র বছর চারেকেই ফুটবল পাঠ নেয়া একজন তো আর যেনতেন হতে পারেন না। চার বছর! অবাক না হয়ে থাকা যায় না। যে বয়সে বইপত্র ঘুচিয়ে প্রথমবার বিদ্যালয় গমনের রোমাঞ্চে ভরপুর থাকে শিশুমন ওই বয়সে মারিয়ার সখ্য চর্মগোল-কে। ১৯৯১ সালে পাড়ার ক্লাব টরেটো-য় প্রথম পরিচয় ফুটবলের সঙ্গে। পরের বছর আসল পাঠটি নেয়া শুরু হয় স্থানীয় নামকরা ক্লাব ‘রোজারিও সেন্ট্রাল’-এ। অতটুকুন এক শিশুর ফুটবল গুণমুগ্ধতাই হয়তাে আজকের ডি মারিয়ার প্রভাবক। ১৯৯২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চার বছরের শিশু পরিণত উনিশ বছরের তরুণে। ১৫ বছরে বদলেছে অনেক কিছু, বদলায়নি রোজারিওর জার্সিতে এক উঠতি তারার মাঠে নামা। ২০০৫ পর্যন্ত ছিলেন যুবদলে, ফুটবল বিশ্বে চিরস্থায়িত্বের মন্ত্র জপে আগমন পেশাদার জগতে। ২০০৫ সালেও হাত ছাড়েনি রোজারিও। মমতায় ধরে রেখেছিল ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ৩৫ ম্যাচে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রিয় দলের।

ডি মারিয়া শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি স্বদেশে। ভবিষ্যতের নেশায় পাড়ি জমান পর্তুগাল-এ। খেলেন বেনফিকা-য়। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিন মৌসুমে খেলেছেন ৭৬ ম্যাচ। সামর্থ্যের চূড়ান্ত প্রতিফলনে নজরে পড়েন রিয়াল মাদ্রিদ-এর। স্বপ্নের ক্লাবের ধবধবে সাদায় নিজেকে রাঙিয়ে নেন ২০১০ সালে। ২৫ মিলিয়নে তাকে ভিড়িয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। চার বছর পর তা হয়ে যায় বড্ড কম। রোনালদো, বেনজেমা, ওজিল, ক্যাপি-র মতো নক্ষত্রপুঞ্জের ভিড়েও ডি মারিয়া ছিলেন আপন আলোয় প্রদীপ্ত। সবুজ ক্যানভাসে বাঁ পায়ের তুলিতে এঁকেছেন রাশি রাশি সাফল্যচিত্র। চার মৌসুমে ১৯১ ম্যাচে নেমেছিলেন গ্যালাক্টিকো-দের অন্যতম ভরসা হয়ে- ৩৬ গোল আর চোখ কপালে তোলা ৬৯ অ্যাসিস্ট। ওজিল-এর মতো অ্যাসিস্ট মাস্টারের তকমা জােটেনি তার কপালে। এতে কী? সাফল্য কী মােছে! লা দেসিমা জয়ের পর রিয়াল ছেড়ে দিয়েছে একঝাঁক শিল্পীকে। ওই দলে ছিলেন ডি মারিয়া-ও। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যেতে হয় প্রিয় মাদ্রিদ-কে ছেড়ে। ইংলিশ লিগের তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফারে (৫৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন, তৎকালীন পঞ্চম সর্বোচ্চ ট্রান্সফার রেকর্ড) তিনি হয়ে যান ম্যান ইউনাইটেড-এর। রোনালদো বেস্টদের সাত নম্বর গায়ে চাপিয়েও নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি পরের সিজনেই সাড়ে ৪৪ মিলিয়ন পাউন্ডে ফরাসি জায়ান্ট পিএসজি-তে পাড়ি জমানো ডি মারিয়া। পিএসজিতে নিজের হারানো ছন্দ খুঁজে পাওয়া ওই তারকার শৈল্পিক ফুটবলে মোহিত বিশ্ব। দিন দিন হচ্ছেন আরো ক্ষুরধার, পাচ্ছেন ভক্তদের ভালোবাসা আর ক্লাবের সমর্থন। সবুজ ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনা-র আকাশি-নীল কেতন ওড়ানো ফ্যাবিয়ান হার্নান্দেজ-এর সদম্ভ বিচরণ ছিল অনূর্ধ্ব ২০ ও ২৩ দলেও। জাতীয় দলের হয়ে ২০০৮ সালে অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি।

 

★ পরিবার

অ্যাঞ্জেল ফ্যাবিয়ান মারিয়ার ডাকনাম ফিদেও। স্প্যানিশ ভাষায় এর অর্থ নুডলস! এছাড়া এল আনহেলিতো কিংবা এল ফ্লিকোসহ অনেক নামেই ডাকা হয় মিগুয়েল ও দিয়ানা দম্পতির ওই সন্তানকে। তার দুই বোন রয়েছেন ভেনেসা ও এভলিন। তার বাবাও ফুটবলার ছিলেন। তিনি খেলতেন প্রখ্যাত আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভারপ্লেটের রিজার্ভ দলে। ২০১১ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ডি মারিয়া গাঁটছড়া বাঁধেন বান্ধবী হোর্হেলিনা কার্দোসার সঙ্গে এবং তাদের রয়েছে মেয়ে মিয়া।

সাঁতার কাটতে পছন্দ করা মারিয়ার গাড়ির প্রতি রয়েছে বিশেষ ঝোঁক। তার গ্যারাজের শোভা বাড়াতে আছে ফেরারি, মার্সিডিজ, বিএমডাবলিউ, রেঞ্জ রোভার, অডি’র মতাে নামি-দামি ব্র্যান্ডের কার।

অামরা নিজেদের সুখী ভাবতে পারি! অামাদের ইতিহাস ঘেঁটে ডি মারিয়া-কে জানতে হবে না। সময়ের সবটাই প্রিয় দুই বন্ধু মেসি-রোনালদো বন্দনার মধ্যেও তিনি পার্শ্বনায়ক হয়ে নন, উল্টো নিজের জায়গায় নায়কোচিত গল্প লিখছেন নিজেই। ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম নিয়েছেন। এটি একটি কারণ হতে পারে বাঘা বাঘা তারকার সঙ্গে তার ভালােবাসার। রন তাকিয়ে থেকেছেন কয়েক বছর তার পায়ের দিকে। তাকিয়ে ছিলেন ইব্রা রুনিরাও। মেসি রাশিয়ায় তাকাবেন। নেইমার, কাভানি-রা এখনো তাকাচ্ছেন। কী অাশ্চর্য, তাদের কাউকেই নিরাশ করেননি ডি মারিয়া! গোল করার পর হার্টশেপ সেলিব্রেশনে বােঝাতে চান হয়তাে, হৃদয়টা আকারে ছোট হলেও এতে জায়গা ঢের- অনায়াসেই আপন করা যায় ভক্তদের।