রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ে সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স’-এর দুই সাংবাদিকের করা দুনিয়া কাঁপানো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কথা ইতোমধ্যে অনেকেরই জানা।
কীভাবে জনসমাগম থেকে দিনের আলোয় নিরপরাধ ১০ রোহিঙ্গাকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এর ছবি প্রমাণসহ স্পষ্ট বিবরণ ছিল প্রতিবেদনটিতে। ওই এক রিপোর্টেই সম্পূর্ণ উল্টে গেছে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থানের মিথ্যা গালগল্প। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে এতদিন যে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছিল এর গোমরও ফাঁস হয়ে গেছে। এ প্রতিবেদন নিয়ে সারা দুনিয়ায় ঝড় উঠলে মিয়ানমার সরকার বাধ্য হয়েই ওই গণহত্যার বিচার করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে কাজের কাজ যেটা হলো তা হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার এখন অন্তত স্বীকার করছে যে, রেহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে ওই গণহত্যার খবর প্রকাশের অভিযোগে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লো এবং চ সোয়ে উ-কে গত মাস থেকে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। তাদের অপরাধ ছিল, তারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তথ্য-প্রমাণসহ আরাকান- রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া একটি গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বিরদ্ধে সরকারের করা মামলায় জামিনের বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা। আফসোসের কথা হচ্ছে, তাদের খবর নিয়ে সারা দুনিয়ায় ঝড় উঠলেও তাদের বন্দির খবরে তেমন কোনাে প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশের মিডিয়াতেও কোনাে প্রতিবাদের খবর প্রকাশিত হয়নি। অথচ সচেতন মানুষ মাত্রই ওই ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কথা। সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় তুলে ওই সাহসী ও মানবতার পক্ষের মহান সাংবাদিকদের মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে- এটিই এখন প্রত্যাশা করছে অসংখ্য মানুষ।
ওই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল গত ২ সেপ্টেম্বর। রাখাইন রাজ্যের উত্তর অঞ্চলের ইন দিন গ্রামে। সেখানে স্থানীয় গ্রামবাসীকে নিয়ে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে সেনাবাহিনী। রয়টার্স দাবি করেছে, রাখাইন-এ রোহিঙ্গা নিধনে সেনাবাহিনীর অভিযান থেকে জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গা পুরুষদের একটি দল এক জায়গায় জড়ো হয়। তখন ওই গ্রামের কয়েক বৌদ্ধ পুরুষ একটি কবর খনন করার নির্দেশ দেয়। এরপর ওই ১০ রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা করা হয়। বৌদ্ধ গ্রামবাসী অন্তত দুই রোহিঙ্গাকে কুপিয়ে এবং বাকিদের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। রয়টার্স জানায়, তাদের কাছে ওই হত্যার বিষয়ে সব তথ্য আছে এবং ওইদিন কী ঘটেছিল এর সবই লিপিবদ্ধ করেছেন আটক করা সাংবাদিকরা। এর মধ্যে বৌদ্ধ গ্রামবাসী, নিরাপত্তা বাহিনী ও ফটোগ্রাফারদের সাক্ষাৎকারসহ সব তথ্যই আছে।
মজার ব্যপার হলো, তিন হতোই উ নামে যে পুলিশ কর্মকর্তা ওই দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছেন, আদালতের জবানবন্দিতে তিনি এর বিরুদ্ধে কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি। তিনি দাবি করেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য জোগাড় করেছিলেন এর সবই আগুনে পুড়ে গেছে। কীভাবে আগুনে পুড়লাে ওই জবাব অবশ্য তিন হতোই দিতে পারেননি। ফলে ওই মামলা যে শুধু রোহিঙ্গাদের ওপর চালিত গণহত্যার সত্যতা প্রকাশ করার ক্রোধ থেকে করা হয়েছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
রয়টার্সের ওই সাংবাদিকদের কি রায় দেয়া হবে তা মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে। মিয়ানমার-এর উপনিবেশিক আইনের আওতায় এই ধরনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত মামলায় ৭ থেকে ১৪ বছরের সাজা হয়ে থাকে। কিন্তু সত্য ঘটনা তুলে আনায় সাংবাদিকদের ওপর ওই ধরনের নিপীড়ন আমাদের যে ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না তা এখন পরিষ্কার।
সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রতি মিয়ানমারের ওই আগ্রাসী আচরণ আমাদেরও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এটিও বোঝা যাচ্ছে, যে পরিমাণ নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছে এর খুব কমই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। কারণ সাংবাদিকদের কাজ করার কোনাে স্বাধীনতা ছিল না। রাষ্ট্র সরাসরি ওই হত্যার মদদে ভূমিকা রেখেছে এবং সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী যারাই এটি নিয়ে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে মিয়ানমার রাষ্ট্র শত্রুতাপূর্ণ আচরণ অব্যহত রেখেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার যে দুর্বল চুক্তি করেছে তা নিয়েও স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে আসছে। আরাকান থেকে ক্রমাগত নির্যাতনে অন্যায়ভাবে যেসব রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদের ফিরে যাওয়া নিয়েও এখন রয়েছে অনিশ্চয়তা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা মনে করছে, ওই নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আয়োজন কেবল লোক দেখানো। রোহিঙ্গারা এখনাে নিরাপদ নন মিয়ানমার-এ।
যেখানে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ কর্মীদের জেলে যেতে হচ্ছে, নানান নিপীড়নের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে সেখানে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর আবারও যে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাতন নেমে আসবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবেন?
অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের যে চুক্তি হয়েছে তা নিয়েও আছে অনেক কথা, অনেক ধোঁয়াশা। সরকার ও মিয়ানমার- উভয়পক্ষই নিশ্চিত করেছে, ওই চুক্তি হবে ‘স্বেচ্ছামূলক’ অর্থাৎ ওই চুক্তি মানার ব্যাপারে বাধ্য করা যাবে না। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের খোলাখুলি অত্যাচারের পরও চাপ না দিয়ে ওই রকম অদ্ভুত চুক্তি সম্পন্ন করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে তা বোধগম্য নয়!
ওই চুক্তির এক জায়গায় বলা হয়েছে, মিয়ানমারে প্রতি সপ্তাহে দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। এটি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়য়ি খবর প্রকাশিত হলেও এখন পর্যন্ত আসলে কাউকে ফিরে যেতে দেখা যায়নি। গত ২৫ আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের হামলার মুখে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এখনো মাঝে মধ্যে তাদের আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া চুক্তিটি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও। তাই ওই চুক্তি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে যে ব্যর্থ হবে না তা বলা যাচ্ছে না।
এতকিছুর পর সাংবাদিকদের প্রতি মিয়ানমারের ওই আগ্রাসী ভূমিকা আমাদের সামনে রোহিঙ্গা নিরাপত্তার বিষয়টিও তুলে আনছে। কিছুদিন আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর শরণার্থী ও অভিবাসন অধিকার বিষয়ক প্রধান শারমেইন মোহামেদ চুক্তি নিয়ে বলেছেন, ‘মিয়ানমারে অক্ষত ফিরে যাওয়ার সর্বময় অধিকার রোহিঙ্গাদের আছে। এ ধরনের প্রত্যাবর্তনে দু’দেশের যথাযথ সহায়তা জরুরি, বিশেষ করে মিয়ানমারে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে আয়োজিত প্রত্যাবর্তনের আগে মিয়ানমার-কে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মনোভাবে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের প্রতি জাতি বিদ্বেষ বন্ধ করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর সব অপরাধের যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
মিয়ানমারের আচরণে দেখা গেছে এর উল্টোটা। সেনাবাহিনীর জবাবদিহি তো দূরে থাক, বরং রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করার অপরাধে রয়টার্সের সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। ওই বিচারের অয়োজন যে কতটা প্রহসনমূলক তা পরিষ্কার। সন্ত্রাস ও গণহত্যার পক্ষে যে মিয়ানমার রাষ্ট্র অবস্থান নিয়েছে এটিও এখন পরিষ্কার। ওই ঘটনা শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নয়, আমাদের দেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেও বড় প্রতিবন্ধকতা আকারে কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমার যে তার গণহত্যাকারী ভূমিকা থেকে এখনো সরে আসেনি এ ঘটনা আমাদের সামনে ওই বার্তাই দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হলো ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনাে ভূমিকা রাখতে পারে কি না। অবশ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই সাংবাদিকদের আটকের ব্যাপারে বাংলাদেশ টুঁ শব্দটিও করেনি। সচেতন নাগরিকরা যতই চান বাংলাদেশ অন্তত প্রতিবাদ জানাক, সরকারের কানে কোনাে কথাই এখন ঢুকছে না। সরকার মহাশয় ব্যস্ত তার নিজের মাঠ দখলের লড়াই নিয়ে। আমরা আশা করি, ওই সাংবাদিকদের মুক্তির জন্য বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় বইবে। নিষ্ঠুর মিয়ানমানর সরকার যেন বাধ্য হয় তাদের ছেড়ে দিতে।