৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রায় রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করবে। এ ব্যাপারটি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যেহেতু বছরের শেষে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
অবশ্য ওই গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বেশ খুশি মনে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস-রাজনীতি সাক্ষ্য দেয়, নির্বাচনে আগ পর্যন্ত রাজনীতির মাঠের ওই দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসতেও পারে।
রাজনীতি বোদ্ধারা ওই ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ভুল করেননি। তারা বলছেন, একটি রায় কেন্দ্র করে এভাবে কোনাে বিরোধী দলকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। এ রকম ঘটনা উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রায়ই হয় বলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ইন্ধিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, এমনকি বাংলাদেশের আজকের প্রধানমন্ত্রীও ওই অবস্থার মধ্য দিয়েই গেছেন। ফলে খালেদা জিয়াকে খাটো করে দেখা বা দেখানোর সুযোগ নেই। তিনি তার দল নিয়ে যে কোনো সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। তারা সহসাই হয়তো বেশ বড়সড় বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের কারণ হতে পারে বিএনপি।
অন্যভাবে বললে, ওই রায় খালেদা জিয়াকে সবার সামনে ‘আসল নায়ক’ হিসেবে প্রতিভাত করতে পারে। অবশ্য রাজনীতির মাঠে তিনি অনেকটা হারিয়ে গেছেন। তিনি যখন আদালতের শুনানিতে যান তখনই তার জনপ্রিয়তা বেশ কিছুটা আন্দাজ করা যায়। কিছুদিন আগে লন্ডন থেকে ফেরার পরও ঠিক তা-ই হয়েছিল। তার ব্যক্তিত্বের কারিশমা আগের চেয়ে কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবে তা হারিয়ে গেছে বলে মনে করার কারণ নেই। দেশের বাইরে তার ভক্ত-কর্মীরা বেশ আলোচনায় ছিলেন। রায়ের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে মিশনের সামনে বেশ প্রতিবাদও দেখিয়েছেন তারা। এসব তার জনপ্রিয়তার ভিত্তির দিকেই নির্দেশ করছে।
একইভাবে বাংলাদেশি পর্যবেক্ষকরা আন্দাজ করেন- অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে শেখ হাসিনা পার পেয়ে যেতে পারেন। অন্যদিকে ধারণা করা হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে নানান সুবিধা পাবেন খালেদা জিয়া। এ জন্য রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা পর্যন্ত ঠিক করা আছে পাকিস্তানের। শুধু ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শত্রুতা নয়- উদার ও সেকুলার বাংলাদেশও তার শত্রু।
ওইসব পর্যবেক্ষণ আমলে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যাবে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বিএনপি ইস্যু। অথচ বিএনপি নাকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছে। দুটি দলের দুটি শাসনকাল (১৯৯১-৯৬) ও (২০০১-০৬) আমলে নিয়ে বিএনপির ভারত প্রতি অতটা আগ্রহী নয়, এমনকি ভারতের উত্তর-পূর্বে উত্তেজনা সৃষ্টির দায় বিএনপির বলে বিশ্বাস করে ভারত। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর পৃষ্ঠপোষক, দেশটিকে ইসলামীকরণসহ দেশের প্রগতিবাদী শক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হওয়া কট্টরপন্থি দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য রয়েছে বেশ কিছুকাল ধরে।
এক প্রতিবেদন মতে, খালেদা জিয়া ও তার পুত্রকে ভারত বিরোধী অবস্থান নেয়ার জন্য নানানভাবে কাজ করেছে পশ্চিম এশিয়াভিত্তিক কিছু পলাতক ভারতীয়। এ ধরনের ভারত বিরোধী শক্তিগুলোকে দূরে রাখতেই খালেদা-বিএনপিকে খুব ভালাে পছন্দ বলে মানছে না ভারত। এর উপর খালেদা জিতে গেলে কিংবা নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ পেলে তিস্তা ও গঙ্গার পানি ইস্যুটি নতুনভাবে জাগতে পারে। শুধু তা নয়, সার্ক-এর অন্যান্য দেশের সমর্থন নেয়ার চেষ্টা খালেদা জিয়া করলে ভারত বেশ চাপে পড়বে। এখানে উল্লেখযোগ্য, খালেদার প্রয়াত স্বামী সার্কের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
খালেদা জিয়ার রায়ের ব্যাপারে ফিরে আসি। রায় ঘোষণার পর অন্তত তিন দিন খালেদা জিয়াকে জেলে থাকতেই হবে। তার আইনজীবীরা যদি ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রায়ের কপি সংগ্রহ করতে পারেন তাহলে হয়তো জামিন পাওয়া যেতে পারে। তবে নজর দেয়ার মতো ব্যাপার হলো, এ দেশের আইন বলছে, দু’বছরের বেশি কেউ সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
খালেদার নামে মামলা আছে ৩৭টি। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি মামলাটাই এতিমের অর্থ বিষয়ক। ফলে মনে হচ্ছে, খালেদার জিয়ার ওইসব আইনি জটিলতা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে না। তাই মির্জা ফখরুল অথবা আমির খসরুকে দলের দেখভালের দায়িত্ব দিতে পারেন তিনি।
যাহোক, দলে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি থাকলেও দলের গতিবিধি ভারতের জন্য কোনাে লাভ বয়ে আনবে না।
অন্যদিকে এরশাদের জাতীয় পার্টি আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। উত্তর অঞ্চল ও সেনাবাহিনীতে তার ব্যাপক প্রভাব আছে। এর উপর জানুয়ারির মাঝামাঝি প্রণব মুখার্জীর সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে তার সঙ্গে এরশাদের ব্যাপক দহরম-মহরম সবার চোখে পড়ে।
এসব দৃশ্যপটের বাইরে ভারতের নানান সুযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগ বুঝে পা ফেলতে চাইছে। আসলে ভারতের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার দাবিদার আওয়ামী লীগ যাতে তার সরকার ভারত বিরোধী শক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে রাষ্ট্রের সব শক্তি ব্যয় করে যাতে আগামীবার আবার ক্ষমতা পায়।
এক্ষেত্রে হাসিনার আগামীর পথগুলো অবশ্যই আরো কঠিন হবে। এ জন্য তাকে বুঝে-শুনেই পা ফেলতে হবে।
লেখক শান্তনু মুখার্জি ভারতের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। লেখাটি ভারতীয় মতামতের সাইট ‘ডেইলি ও’তে প্রকাশিত হয়। এটি ‘জবান’-এর জন্য অনুুবাদ করেছেন মিনহাজ আমান।