কয়েদখানায় ফুটছে ফুল

কয়েদখানায় ফুটছে ফুল

আমাদের দেশে যখন নতুন নতুন কারাগার, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কারাগার নির্মাণ করা হচ্ছে- উল্টো সেখানে বন্দির অভাবে কারাগারগুলো সুনসান পড়ে থাকছে দিনের পর দিন। নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন-এর মতাে ‘মানবাধিকার সচেতন’ দেশগুলােয় জনসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত কারাগার রয়েছে। তবে কারাগারে কয়েদির সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম থাকাটা স্বাভাবিক মনে হলেও কয়েদির অভাবে জেলখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি শুনতে অদ্ভতই লাগে। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও এমনটিই সত্য হয়েছে নেদারল্যান্ডস-এর কারাগারগুলোর ক্ষেত্রে। কয়েদি নেই দেখে এগুলো বন্ধের উপক্রম হচ্ছে। আর যেগুলো চালু রয়েছে এতে চলছে মানবিকতার সুন্দরতম এক আয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য, বিশেষ করে শিশুদের জন্য এগুলো খুলে দেয়া হয়েছে ঘরবাড়ির মতো করে। অপরাধীদের আখড়ায় ফুটে চলেছে মানবিকতার ফুল।

সাম্প্রতিক ‘ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফ’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডস-এ কারাবন্দির সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৪৬৩। পরে ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১০ হাজার ১০১ জনে। তাই ঘটনা এমন হয়েছে যে, প্রতিবেশী দেশগুলোকে অনুরোধ করেও কয়েদি পাওয়া যাচ্ছে না। কারাবন্দিদের জন্য উন্নত সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কয়েদি মিলতাে না কারাগারগুলােয়। পরিশেষে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

কারাগারের বিশেষ অনুষ্ঠান মুহূর্ত

হবেই বা না কেন! নেদারল্যান্ডসের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুনাম দুনিয়াজুড়ে। এখানে প্রত্যেক শিশু বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে, এমনকি শিল্প উন্নত ওই দেশটিতে রয়েছে প্রত্যেক তরুণের কর্মক্ষেত্রের নিশ্চয়তা। এ জন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি, হত্যা, গুম কিংবা অপহরণের মামলায় জড়িয়ে জেলে যাওয়ার ঘটনাটার সুযোগই নেই সেখানে। তাই নেদারল্যান্ডস সরকার বহুদিন ধরে নিজেদের কারাগারগুলো বেলজিয়াম ও নরওয়ে-কেও ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করে আসছে। অবশ্য বেলজিয়াম ও নরওয়ে-র কারাগারও বেশির ভাগই খালি। শোনা যায়, নেদারল্যান্ডস সরকার ২০১৩ সালে কয়েদির অভাবে তাদের ১৯টি জেলখানা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। ফলে জেলখানা রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২ হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়েন।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ক্ষেত্রে আলোচনাটা একটু ভিন্ন। সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, লেবাননসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে ভয়ার্ত শরণার্থীরা ক্রমাগত ধাবিত হচ্ছেন নিকটবর্তী ইউরোপের দিকে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে নৌপথে সীমান্ত অতিক্রম করে ইউরোপে এসেও তারা শিকার হচ্ছেন নানান হয়রানির। কেননা তাদের আশ্রয় দিতে নারাজ ইউরোপের কিছু উন্নত দেশ। আর ইউরোপের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ভাষাগত সমস্যা, আবহাওয়া কিংবা নিয়ম-কানুনে নানান ভিন্নতা থাকায় ভোগান্তির শেষ নেই শরণার্থীদের।

অবশ্য নেদারল্যান্ডস সরকার এক অভিনব কায়দায় ওই অসহায় শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। সেখানে থাকা কিছু অব্যবহৃত কারাগার ওই অসহায় শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য খুলে দেয় দেশটির কারা কর্তৃপক্ষ। এভাবে ২০১৫ সাল নাগাদ নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমান প্রায় ৬০ হাজার শরণার্থী। তারা আশ্রয় পেয়েছেন শরণার্থী শিবিরের পাশাপাশি দেশটির উন্নত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কারাগারে।

জেল দালান-এর রাতের দৃশ্য  -রয়টার্স

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য নেদারল্যান্ডস সরকার ব্যবস্থা করেছে রাষ্ট্রীয় নানান সুবিধার। চলুনতিা এক নজরে দেখে নিই–

♦ ওই শরণার্থী শিবিরের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হলাে শিশু। তাই শুরুতেই তাদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করছে দেশটির সরকার। এ দেশের অন্যান্য শিশুর মতাে শরণার্থী শিশুরাও যাতে বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এ উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ইতােমধ্যে শরণার্থী শিশুদের জন্য নেয়া এমন পদক্ষেপের জন্য বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে দেশটি।

♦ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মা-বাবার সঙ্গে অনেক শিশু পাড়ি জমিয়েছে নেদারল্যান্ডসে। তাই তাদের অনেকেই বেড়ে উঠছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ওই জেলখানাগুলোয়। ফলে জেলখানাগুলোয় শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করছে দেশটির সরকার।

♦ শরণার্থী শিবিরগুলোয় শিশুদের পাশাপাশি তরুণদের সংখ্যাটাও কম নয়। তাদের নানান কাজকর্মে দক্ষ করার জন্য কিছু প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। ওইসব ট্রেনিং নিয়ে তাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা অনেকটাই সুবিধাজনক হবে। এর পাশাপাশি এই তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহীদের সহায়তার জন্য দেয়া হচ্ছে শিক্ষা ঋণ। শরণার্থী হিসেবে আসা তরুণদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে নেদারল্যান্ডসের নিয়ম-কানুনও যাতে আইনভঙ্গ করে তারা সাজাপ্রাপ্ত না হন।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা শরণার্থীদের বন্দি অবস্থায় নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। তারা ইচ্ছা করলেই কারাগার থেকে বেরিয়ে বাইরে যেতে-আসতে পারবেন। কর্তৃপক্ষের ধারণা, তাদের দেয়া স্বাধীনভাবে বিচরণের ওই সুযোগ শরণার্থী শিশুদের আত্মিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে।