সাম্প্রতিক বিশ্বে ইরান বিপ্লবের প্রভাব

বিপ্লবের ৩৯তম বার্ষিকী

সাম্প্রতিক বিশ্বে ইরান বিপ্লবের প্রভাব

‘ইরানিয়ান বিপ্লব’ বা ’ইসলামি বিপ্লব’- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ১৯৭৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া ইরানের জনগনের কাছে ওই অভ্যুত্থান ছিল গত শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ পাশ্চাত্যের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মধ্য থেকে পাশ্চাত্যপন্থী ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করা তখন ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু ঠিক ওই অসাধ্যই সাধন করেছিল ইরানের জনগণ। তাই ওই বিপ্লবকে বলা হয়, ফরাসি ও বলশেভিক বিপ্লবের পর ইতিহাসের তৃতীয় ‘মহান বিপ্লব’। এসব হয়তো পোশাকি ভাষা। তবে সফল বিপ্লব হিসেবে ইরানের জাগরণ ও বিপ্লব-পরবর্তী থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ওই বিপ্লবের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা এটিকে দিয়েছে এক ভিন্নমাত্রা।

১৯৭৯ সালের ১২ বাহমান বা ১ ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খামেনি (রহ.) ১৫ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে তেহরান-এ ফিরে আসেন। তার দেশে ফেরার ১০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে। আর ক্ষমতাশীল শাহ রেজা পালিয়ে যান মিসরে।

ওই বিপ্লবটিকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তৎকালীন ইরানে যখন ক্ষমতায় ছিল রেজা শাহ পাহলবি। তিনি ছিলেন প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে পারস্য শাসন করে আসা শাসক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। সেখান থেকে ইরানের বের করে এনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং শাসনতান্ত্রিকভাবে ইরানকে নতুনরূপে হাজির করে দুনিয়াজুড়ে যে দৃষ্টান্ত ইরানিয়ান বিপ্লব স্থাপন করেছিল এর প্রভাব বিপ্লব-পরবর্তী দুনিয়াতেও দেখা গেছে।

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে কারারুদ্ধ অবস্থায় ইমাম খামেনি-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কাকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্লব করতে চান?’ এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন যারা দোলনায় শুয়ে আছে তারাই হবে একদিন আমার বিপ্লবের হাতিয়ার।’ বাস্তবে হয়েছিলও ঠিক তা-ই। ওই সময়কার শিশুরা যখন তারুণ্যে পৌঁছান তখন তাদের নিয়েই ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ঘটেছিল। আর ওই তরুণরাই ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের মূল কারিগর।

ইরানিয়ান বিপ্লব-পরবর্তী মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে আছড়ে পরেছিল।

ঔপনিবেশিক শাসনের পর মুসলিম প্যান-ইসলামিজম ধারণা প্রভাবিত হতে থাকে। ওই সময় আরব জাতীয়তাবাদের নামও বেশ জোরেশোরে শোনা যেতে থাকে। ঠিক ওই সময় ইরানিয়ান বিপ্লব ছিল আচমকা বজ্রপাতের মতো। মুসলিম বিশ্ব এই প্রথম কোনো সফল বিপ্লবের নজির দেখলো। এদিক দিয়েও ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ভূমিকা ছিল অনন্য।

বিপ্লব-উত্তর বিভিন্ন সময় ইমাম খামেনির নেতৃত্বে ইরান সরকার পুরো মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে যুগোস্লাভিয়া-য় বসনিয়ান মুসলিমদের ওপর সার্বীয় বাহিনী নির্যাতন শুরু করে। এ অবস্থায় ইরান প্রথম ওই গণহত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এছাড়া ওই গণহত্যার প্রতিবাদে সাবেক যুগোস্লাভিয়া-র কোনো রাষ্ট্রদূত তার দেশে নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় ইরান এবং বেলগ্রেড থেকে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করা হয়। যুগোস্লভিয়া-কে জাতিসংঘ, ওআইসিসহ সব বিশ্ব সংস্থা ও সংগঠন থেকে বহিষ্কারের জন্য ইরান দাবি তোলে। জাতিসংঘ-এর নিরাপত্তা পরিষদে যুগোস্লভিয়াকে নিষিদ্ধ করার দাবিও জানায় ইরান। এছাড়া যুগোস্লভিয়ার ইরানিয়ান সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নাকচ করে। ফলে পরবর্তীকালে বসনিয়া সমস্যার সমাধান হয়। এর পেছনে সব থেকে বড় ভূমিকা ছিল বিপ্লবী ইরান সরকারের।
অন্যদিকে আলজেরিয়া-র ইসলামি আন্দোলনের ব্যাপারেও ইরান বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (এফআইএস)-এর নেতৃত্বে ইসলামপন্থী জনতা ১৯৯০ সালে স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টের প্রথম দফার নির্বাচনে ২০৬ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে তারা বিজয়ী হন। ১৯৯২ সালের ১৬ জানুয়ারির নির্দিষ্ট দ্বিতীয় দফায় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ৫ দিন আগে ১১ জানুয়ারি দেশটির সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল বাতিল করে সামরিক জান্তা হাজারো এফআইএস নেতাকর্মীকে জেলে ঢোকায়, এফআইএস-কে নিষিদ্ধ করে, মসজিদ বন্ধ করে দেয় এবং বেশ কয়েক নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দেয়। এসব ঘটনা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝর তোলে। এ সময় ইরানের অন্যতম ইমাম আয়াতুল্লাহ কাশানি ওই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং আলজেরিয়ার মুসলিম জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে হুশিয়ারি দেন।

এদিকে আফগানিস্তানে সোভিয়াত বাহিনীর পতনের পর ইসলামপন্থী দলগুলো নিয়ে জোট গঠন করার ব্যাপারে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আফগানিস্তান পুনর্গঠনে তৎকালীন আফগান সরকারের প্রধান বুরহান উদ্দিন রব্বানির সঙ্গে দেখা করে ইরানের প্রেসিডেন্ট আলি আকবর হাশেমি রাফসানজানি সহযোগিতা করেন।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকা ছিল বেশ জোরালো। গাজায় হামাসের প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করার পেছনে ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট আব্বাস পর্যন্ত দাবি করেছেন, হামাস-এর অর্থদাতা ইরান এবং ওই দেশের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ-র সঙ্গে হামাসের রয়েছে সামরিক সম্পর্ক। তা ওই অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদ-ইহুদিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে এক নতুন স্রোতের সৃষ্টি করেছে। এভাবে মুসলিম দুনিয়াজুড়ে বিপ্লব-পরবর্তী ইরান গুরুত্বপূর্ণ নজির রেখে চলেছে।

ইরানের ওই বিপ্লবের আজ চলছে ৩৯তম বার্ষিকী। তেহরানের আজাদি স্কয়ারে বিপ্লবী সরকারের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি-র ডাকে ওই উদযাপনের কিছুদিন আগেই সংগঠিত হয় সরকার বিরোধী মিছিল-মিটিংয়ে। গত ২৮ ডিসেম্বর মাশাহেদ শহরে অনিয়ন্ত্রিত পণ্যের দামের প্রতিবাদে শুরু হলেও ওই আন্দোলন পরে বিপ্লব বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এ ছাড়া এর আগেও কট্টরপন্থী বিপ্লবী সরকারের বিপক্ষে নানান মানবাধিকার লুণ্ঠনের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। অন্যদিকে সউদি আরবের সঙ্গে ইরানের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব সমগ্র বিশ্বকে নতুন যুদ্ধ অবস্থার জন্ম দিয়েছে নানান সময়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের যুদ্ধাংদেহী সম্পর্ক বিশ্বকে নানান প্রক্সি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে বিভিন্ন সময় এবং এখনো দিচ্ছে। তবে এসব কিছুই ‘সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত’ দাবি করে অস্বীকারের এক ধরনের সংস্কৃতি আছে বিপ্লবী সরকারের।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আগে ও পরে এর সফলতার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষকে। ইরানের বিপ্লব বিরোধী অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদীরা বিপ্লবের প্রতি নিবেদিত অসংখ্য দেশপ্রেমিক নেতাকে গুপ্তহত্যা করা করে। ওই গুপ্ত হামলায় ১৯৭৯ সালের ১ মে আয়াতুল্লাহ মোতাহহারির শাহাদাত, ১৯৮১ সালের ২৮ জুন ড. বেহেশতিসহ গুরত্বপূর্ণ অনেক নেতা নিহত হন। তবুও এখন পর্যন্ত ইরানী বিপ্লব যেভাবে সফলতার সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে নিজেকে মেলে ধরছে তা আগামী দিনের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে কোনো সংগ্রামে অনুপ্রেরণা এবং কার্যকর ভূমিকা রাখবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।