নব্বইয়ের নস্টালজিয়া

নব্বইয়ের নস্টালজিয়া

আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুখস্মৃতিগুলো শৈশব হাতড়ালেই পাওয়া যায়। ছবির মতাে মেলে ধরে কত ঘটনা, কত ছবি। তেমনি নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া তরুণ-তরুণীদের বর্ণিল শৈশবের সঙ্গী হয়ে আছে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)-তে দেখা কোনাে সুপারহিরোর সিনেমা কিংবা গলির মোড়ের দোকানে পাওয়া মিমি চকলেট। নব্বইয়ের দশকের এমন কিছু ব্যাপার চলুন দেখে নেয়া যাক যা আপনাকে স্মৃতিকাতর করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট–

গডজিলা (দি সিরিজ)

সাদা-কালো বিটিভিতে দেখা ‘গডজিলা’ সিরিজের কেন্দ্রে ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের ড্রাগনের মতাে বিশাল এক প্রাণী। ওই প্রাণী যখনই দরকার তখনই সমুদ্রের গভীরতম অংশ থেকে উঠে এসে মানব জাতিকে নানান ভয়ঙ্কর প্রাণীর হাত থেকে বাঁচায়, বাঁচায় অসংখ্য বিপদ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে নিজের জীবন বাজি রেখে। নাম তার গডজিলা। সম্ভবত বিটিভির আর কোনাে কার্টুন এতটা থ্রিল আর অভাবিত উত্তেজনা তৈরি পারেনি যতটা পেরেছিল টিকটিকি-র ডিম থেকে জন্ম নেয়া ওই অতিকায় প্রাণীটা। বিশেষ করে শুরুর থিম সংটা একাই যথেষ্ট ছিল গায়ের লোম দাঁড়ানোর জন্য। শুনলেই রক্তের ভেতর কাঁপন ধরতো, ছলকে উঠতাে বুকের ভেতরে, সুর শুনলেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম দেখার জন্য। প্রতি মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফিরেই জামাকাপড়বদল বা নাওয়া-খাওয়ায় ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড়ে টিভির সামনে বসতাম স্রেফ পাঁচ বিজ্ঞানীর ওই দলটা আর তাদের প্রিয় গডজিলা-কে দেখার জন্য। অসম্ভব জনপ্রিয় ওই কার্টুনটি এখনাে রোমাঞ্চ জাগায় দর্শকের হৃদয়ে।

মিমি চকলেট

মিষ্টি মিমি চকলেট! চকচকে বাদামি প্যাকেটে থাকা ওই চকলেটের আবেদন শুধু তারাই বুঝবেন যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছিলেন। গলির মোড়ের সর্বাধিক বিক্রীত ওই মিমি চকলেটের ঘ্রাণ ও স্বাদ- দুটিই ছিল অনন্য। সেকালে পরিবারের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে কিংবা বাসায় নতুন অতিথি এলে মিমি চকলেটের ছড়াছড়ি শুরু হয়ে যেত। শহরে এখন হাজারো দেশি-বিদেশি চকলেট, আইসক্রিম থাকলেও সেকালের মিমি চকলেটের স্বাদ এখনো জিভেই লেগে আছে নব্বইয়ের দশকের ঠোঁটে।

জুমানজি

তখন স্যাটেলাইট আসবে আসবে বলে শুনছি আমরা। ফলে সবকিছুর বাইরে বিটিভিতে প্রচারিত অন্যতম কার্টুন সিরিয়াল ছিল ‘জুমানজি’। আহা! এ যেন এক ভিন্ন জগৎ। চেনা-জানা আমাদের এ পৃথিবী ছেড়ে জুমানজি নামে ওই শ্বাসরুদ্ধকর খেলাটি যেন প্রতি বুধবারের ক্লান্ত দুপুরে আমাদের নিয়ে যেত অরণ্যে ঢাকা আদিম এক পৃথিবীতে যেখানে প্রতি মুহূর্তে ওতপেতে আছে একের পর এক বিপদ আর ত্রাস। অ্যালেন, জুডি আর পিটার-এর সঙ্গে যোগ হতাে ভ্যান পেল্ট, ট্রেডার স্লিক, প্রফেসর ইবসেন-এর মতাে ডাকসাইটের দুর্ধষ ভিলেইনরা। জুমানজি-তে গহিন দুর্গম অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া, প্রতি সেকেন্ড অজানা-অচেনা বিপদের শঙ্কায় গা শিউরে ওঠা আর অভিশপ্ত ওই দীর্ঘ অভিযান শেষে অ্যালান-এর ফিরে আসা! আহা, অ্যাডভেঞ্চারে ভরা ওই কার্টুনটি এখনো অম্লান স্মৃতির পাতায়।

 

ক্যাসেট প্লেয়ার

তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আজকের শিশুদের একদম পরিচয় নেই ক্যাসেট প্লেয়ার বা টেপ রেকর্ডার-এর সঙ্গে। অথচ এক সময় মানুষ ওই ক্যাসেট প্লেয়ার-এর জন্য ছিল পাগলপারা। মূলত ঈদ কিংবা পূজায় সবাই রাস্তার ধারে ওই ক্যাসেট প্লেয়ার উচ্চৈঃস্বরে বাজিয়ে আনন্দ করা হতো। বিটিভি-র বাইরে ভাড়া আনা ক্যাসেটে শোনা যেত নিজেদের ইচ্ছমেতো সিনেমার গান। ক্যাসেট প্লেয়ারে সঙ্গে আবার রেডিও সংযুক্ত থাকায় রাত জেগে বাংলাদেশ বেতার কিংবা অন্যান্য চ্যানেলের ছায়াছন্দ, কৌতুকধর্মী অডিও নাটকসহ নানান অনুষ্ঠান শোনার বেশ কদর ছিল। তবে কালের আবর্তে আজ ক্যাসেট প্লেয়ার হারিয়ে গেছে। ওই জায়গায় স্থান করে নিয়েছে কম্পিউটার ও স্মার্টফোন।

মীনার কার্টুন

নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল সবচেয়ে শিক্ষণীয় জনপ্রিয় কার্টুন মীনা (Meena)। আমাদের শৈশব যেন আটকে ছিল মীনা কার্টুন-এর ওই মোহনীয় সুরে। কার্টুনটির শুরুর গানটির সুরে কী যে এক মোহনীয়তা তা এখনো হৃদয়ে দোলা দেয়। আর তখনকার শৈশব মানে, ওই গান গড় গড় করে গেয়ে যাওয়া- হোক বেসুরো বা ভুল লিরিক। সামাজিক নানান অসঙ্গতি ও কন্যা শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সচেতনতামূলক ওই কার্টুনটি নির্মল বিনোদনের মধ্যেই অসাধারণ সব শিক্ষা দিয়ে যেত আমাদের অগোচরেই। মীনা, রাজু, মিঠু, রীতা কিংবা উত্যক্তকারী দীপু- সব চরিত্রই যেন এখনো চোখের কিনারে ঘুরপাক খায়।

আলিফ লায়লা

শুক্রবার এলেই বাড়িতে এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করতাে। একে তো ওইদিন স্কুল নেই, এর উপর দুপুরের খবরের পর পরই শুরু হতাে বাংলা সিনেমা আর রাতে ‘আলিফ লায়লা’- অন্য রকম উপভোগ্য ছিল সত্যিই। বিটিভিতে প্রচারিত অন্যতম জনপ্রিয় হাজার পর্বের সিরিয়াল-এর নাম আলিফ লায়লা। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও আলিফ লায়লা-র বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। তখন কিছু গ্রামে সবে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বা পৌঁছাবে। আলিফ লায়লার চেনা সুর কানে ভাসতেই চারদিকে হই হই পড়ে যেত।

ইকোনো বলপেন

আড়াই কিংবা তিন টাকার ওই ইকোনো বলপেন!! লাল, নীল কিংবা কালো রঙের ওই বলপেন ছিল নব্বইয়ের দশকের ছেলেমেয়েদের পহেলা স্কুলে যাওয়ার সঙ্গী। শুধু লেখাই নয়, স্কুলের টেবিলে ‘কলম-কলম’ খেলা থেকে শুরু করে কলমের একপাশ পোড়া দিয়ে বেলুন ফােলানোর মতাে সব কাজ-অকাজ হতোওেই বলপেন দিয়ে। মাঝে মধ্যে কলম থেকে বেরিয়ে আসা কালি আমাদের সাদা ইউনিফর্মের সর্বনাশ করে দিতো- বাড়ি ফিরতে ফিরতে ওই এক আতঙ্কে বুক ধড়ফড়। কিন্তু ওই কলমগুলোও হারিয়ে যায় আমাদের শৈশবের মতাে, আমাদের গল্পের মতাে, আনন্দের মতাে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করে ইকোনো কলমের একটি ক্লিপ খুলে নাকের কাছে ধরতে- শৈশবের একটু ঘ্রাণ পাই যদি!

সিন্দবাদ

নব্বইয়ের দশকে আমাদের শিশুতোষ হৃদয়ের কাছাকাছি কী ছিল তা নিয়ে কথা বলতে গেলে খুব বেশি দূরে যেতে হয় না। চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পাই বিটিভির ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অফ সিন্দবাদ’-এর মিভ, রঙ্গার কিংবা ডুবার-কে। ছিল চুল লম্বা সুদর্শন রবিনহুড, ‘থিফ অফ বাগদাদ’ কিংবা ‘টারজান’! এসব টান টান উত্তেজনার টিভি শো চলাকালেই পলকে চলে আসতো পটেটো ক্র্যাকার্স-এর বিজ্ঞাপন! শুধু বিটিভিতেই নয়, সিন্দবাদ-এর ছবি আঁকা নানান পোস্টার, স্টিকারও দোকানে কিনতে পাওয়া যেত। এসব স্টিকার পেন্সিল বক্স, টিভি, বইয়ের মলাটেও লাগিয়ে রাখার কাজে পিছিয়ে ছিলেন না কেউ।

তিন গোয়েন্দা

স্বর্ণকেশী এক কিশোরীর হাসি ঝলমলে চোখ, নীল সাগর সৈকতের নারিকেল গাছ, স্বর্ণের মোহর, একটি হলদে কুকুর, জংলি ও কিছু চিত্রকর্ম নিয়ে আঁকা বইটিই শৈশবের ‘তিন গোয়েন্দা’। আর একটার পর একটা ওই তিন গোয়েন্দার ভলিউম পড়ে রাত পার করে দেয়া নব্বইয়ের দশকের কিশোর-কিশোরীদের কাছে খুবই পরিচিত চিত্র। দারুণ সব  বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চার সমৃদ্ধ বইটি ওই দশকের সবার বুক শেলফেই দু’একটি পাওয়া যেত। এর সঙ্গে থাকতাে ভলিউম চুরির ভয়ও। এখনো মাঝে মধ্যে মনে হয়, তিন গোয়েন্দার ওই দক্ষিণের পলিনেশিয়া-র প্রবাল দ্বীপের নীল লেগুনে পা ডুবিয়ে একটু সুর্যাস্ত দেখা গেলে হয়তো জীবন বদলে যেত।

 

নানান কায়দার কগুজি চিঠি

হলুদ খামে পাওয়া চিঠি খোলার আনন্দ একমাত্র তারাই বুঝবেন যারা নব্বইয়ের দশকে শৈশবে পা রেখেছেন। জন্মদিন, ঈদ, এমনকি প্রিয় কোনাে চরিত্রের জন্মদিনেও প্রিয়জনরা খামের ভেতরে নানান নকশা বা ভাঁজ করে চিঠি পাঠাতেন। তখন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হাতে পাওয়া ওই চিঠির ভাঁজ খোলাও অদ্ভুত শিহরণ জাগাতো।