আসমা জাহাঙ্গীর : সংগ্রামী জীবনের প্রতিকৃতি

আসমা জাহাঙ্গীর : সংগ্রামী জীবনের প্রতিকৃতি

২০০৮ সাল। বাল ঠাকরের সঙ্গে পাকিস্তানের নারী আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের একটি ছবি খুব আলোচনার জন্ম দেয়। বাল ঠাকরে ছিলেন ওই সময়ের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শিব সেনা পার্টির ডাকসাইটে নেতা। পাকিস্তানি হওয়া সত্ত্বেও প্রচণ্ড পাকিস্তান বিরোধী নেতার সঙ্গে তার ওই বৈঠকের পর সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। অথচ পরে জানা গেল, তিনি আসলে ভারতের বর্তমান ধর্মীয় অবস্থা ও মুসলিমদের প্রতি সহিংসতা বিষয়ে কথা বলতেই ঠাকরের সঙ্গে বসেন।

এভাবেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইনসাফের পথে সর্বদা নিয়োজিত রাখতেন আসমা জাহাঙ্গীর। ১৯৫২ সালরে ১৭ জানুয়ারি জন্ম নেয়া ওই প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব শৈশবে পড়াশোনা সেরেছেন চার্চের বিদ্যালয়ে। ১৯৮০ সালে লাহোর আদালতে যোগ দিয়ে আইন পেশায় নাম লেখান তিনি।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)-এর প্রখ্যাত নেতা আলতাফ হুসাইনের বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন লাহোর হাই কোর্ট। তার বিরুদ্ধে আগেই জঙ্গিবাদী নানান কার্যক্রম ও মিডিয়ায় বিতর্কিত বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে তাকে আইনি সহায়তা দিতে সবাই অস্বীকৃত জানান। তবে ওই সময়ে তার পাশে দাঁড়ান আসমা জাহাঙ্গীর। কিন্তু ওই এমিকিউএম সংগঠন তাকে নানান সময় পিপিপি-র ‘দালাল’ বলে আখ্যায়িত করলেও তাদের নেতাকে আইনি সহায়তা দিতে পিছপা হননি আসমা। এর কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ইনসাফ ও কথা বলার স্বাধীনতার বিকল্প কিছু নেই।

ওই ঘটনার পর আসমার কয়েক আইনজীবী সহকর্মী তার বিরুদ্ধে মিছিল করেন আলতাফের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। এমনকি তার লাইসেন্স পর্যন্ত কেড়ে নেয়ার দাবি জানান তারা। কিন্তু এসবের কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তিনি লড়ে যান। এর কারণ জানতে চাইলে তার এক সমর্থক জানান, তিনি আসলে এমনই।

সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনে আসমা নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করলে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন গ্রুপ নানানভাবে তাকে পাকিস্তান বিরোধী ও ইসলাম বিরোধী প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন জং গ্রুপের আওতাধীন মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিক আনসার আব্বাসি। অথচ পরবর্তকালে সেই আনসার আব্বাসিই আসমা জাহাঙ্গীরকে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে তাদের দলের প্রধান করেন।

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বিরোধী একটি আন্দোলনে প্রতিবাদী আসমা জাহাঙ্গীর -হোয়াইট স্টার

 

বলতে গেলে অধিকার বিষয়ে আসমার সরব হওয়ার পথটি বেশ লম্বা। স্কুলে থাকাকালে দেখেন ক্লাসের দায়িত্বে থাকেন চার্চের সিস্টাররা। তিনি দাবি তুললেন, শিক্ষার্থীদের জন্যও একটি এমন পদ থাকা জরুরি। দশম শ্রেণির ছাত্রী আসমা ‘ভোটের মাধ্যমে দায়িত্বশীল’ বাছাই করার দাবি করলেন। সেটি পরে গৃহীত হয় এবং তা আজও আছে ওই স্কুলে।

মোটামুটি তরুণ বয়সেই বেশ আলোচিত হন আসমা জাহাঙ্গীর। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর আসমা জাহাঙ্গীরের পিতা মালিক গোলাম জিলানিকে গ্রেফতার করে ইয়াহিয়া সরকার। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন এবং ‘দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগে গ্রেফতার হোন। সেখান থেকে তিনি পরিবারের উদ্দেশে চিঠিতে কিসের ভিত্তিতে তার মুক্তির জন্য পিটিশন করা যায় এর সম্ভাব্য যুক্তিগুলো লিখে পাঠান। আসমা ওইসবের ওপর ভিত্তি করে তার পিতার পক্ষে পিটিশন দাখিল করেন। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে করা ওই পিটিশন বাতিল হয়।

এবার সংগ্রামের পথ আরো দীর্ঘায়িত হয়। আসমা তখন সুপ্রিম কোর্টে যান ইনসাফের জন্য। সেখানে তার পক্ষে লড়াই করেন ওই সময়ের বিখ্যাত আইনজীবী কাদের। ওই মামলাটি ‘আসমা জিলানি বনাম পাঞ্জাব সরকার’ শিরোনামে ওই সময় বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। আসমা বলেন, তখন ওই মামলার শুনানি শুনতে পুরো আদালত প্রাঙ্গণ জমজমাট থাকতাে। এরপরও তার পিতার মামলায় হেরে যান। তিনি বলেন, ওই সময় আদালতের তলায় তলায় দৌড়ে তিনি শিখেছেন কীভাবে আসলে মামলা চলে এবং চালাতে হয়।

লাহোর-এ নারী অধিকার সচেতনতা নিয়ে একটি মোটর শোভাযাত্রায় আসমা জাহাঙ্গীর -এএফপি

 

অবশ্য ইয়াহিয়া সরকারের পতনের পরই আসমা জাহাঙ্গীরের পিতা মুক্তি পান। মূলত পিতার মামলা জয়ের মধ্য দিয়েই তিনি আইন পেশায় আগ্রহ বোধ করেন। ফলে ভাবনা অনুযায়ী ১৯৭৮ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নেন। তবে এর কিছুদিন আগেই প্রতিবেশী ব্যবসায়ী তাহির জাহাঙ্গীরকে বিয়ে করেন। তবে তখন বিবাহিত মেয়েদের আইন কলেজে ক্লাস করার নিয়ম ছিল না। তার সহপাঠী ও বান্ধবী গুলরুখের কাছে বাসায় পড়তে শুরু করেন তিনি। অতঃপর সারা জীবন সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া আসমা ওই বছরই আইন বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস অর্জন করেন।

১৯৯৩ সালে ১১ বছরের ক্রিশ্চিয়ান বালক সালামাত মসিহ, তার চাচা মনজুর মসিহ ও রেহমাত মসিহ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে লাহোর-এর এক মসজিদের দেয়ালে তারা ইসলাম বিরোধী বক্তব্য লিখেছেন। মামলা চলাকালেই আদালতপাড়ায় খুন হন মনজুর মসিহ। নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে আসমা জাহাঙ্গীর ওই বালকের আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ওই বালকসহ বাকিদের বেকসুর খালাস দেন লাহোর কোর্ট। এর কিছুদিন পর খালাস দেয়া বিচারককে অজ্ঞাতনামা লোকজন হত্যা করে। পরে জানা গেছে, কেবল ক্রিশ্চিয়ানদের পক্ষে রায় দেয়ায় ওই খুন। ধারাবাহিকভাবে আসমা জাহাঙ্গীরের ওপরও হামলা হয়। এমনকি তার বাড়ি ভেবে তার মায়ের বাসায় হামলা হলে সামান্যর জন্য প্রাণে বেঁচে যান আসমার বোন।

১৯৮৩ সালে নারীদের সমান সাক্ষ্য প্রদানের অধিকার বিষয়ক আন্দোলনে আসমা জাহাঙ্গীর প্রথম জেলে যেতে বাধ্য হোন। জেল বিষয়ে তিনি বলেন, জেলের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন। একটি অদ্ভুত ভ্রমণ সেটি। পরে অবশ্য আবার ২০০৭ সালে তাকেসহ ৫০০ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করেন পারভেজ মোশাররফ।

২০১০ সালে আসমার সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের আগে দুটি গ্রুপ ছিল। একটির নিয়ন্ত্রণে ছিল তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি, আরেকজন বিখ্যাত আইনজীবী মালিক করিম। আসমা জাহাঙ্গীর প্রথমবার লড়াইয়ে নেমেই জয় পেয়ে পুরো সমীকরণ ঘুরিয়ে দেন। হয়ে যান পাকিস্তানের প্রথম নারী বার সভাপতি।

গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি রবিবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ওই মহীরুহ চিরবিদায় নেন। বাংলাদেশের প্রতি তার পিতার সমর্থন জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে আসমা জাহাঙ্গীরকে ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ সম্মাননায় ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।