যে মত ও পথ বিশেষ করিয়া রাজনীতির ন্যায় সদা গতিশীল বিষয়ে, মানুষের সমষ্টিগত শক্তিকে দুর্বল এবং স্থবির করিয়া ফেলে উহার সহিত আমার মানসিকতাকে কোনােদিন খাপ খাওয়াইয়া নিতে পারি নাই। মানবজাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানিতে পারিয়াছি এবং আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত যতটুকু শিক্ষা লাভ করিয়াছি উহাতে আমি স্থির সিন্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, অহিংসার বাণী ও অহিংস কৌশল মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে ভোঁতা করে মাত্র– দেশের শতকরা ৯৫ জনের চিরস্থায়ী কোনাে কল্যাণ সাধন করিতে পারে না। তাই যখনই দেখিতে পাই যে, দেশবাসী অহিংসার মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করিয়া মানবীয় কল্যাণের কথা ভাবিতেছে তখন সত্যিই আমার করুণা জাগে– কী আফিমই না তাহাদিগকে পাইয়া বসিয়াছে। দেশবাসীর এহেন বিনীত আরজির সুযোগে দেশের শতকরা মাত্র ৫ জন কী সুবিধাই না লুটিয়া থাকে! যে জনতা বিপ্লবের ঝাণ্ডা বহন করিয়া কৌশলীদের অপমৃত্যু ঘটাইয়া দিতে পারিত তাহাদিগের চোয়ালেই লাগাম আঁটিয়া দেওয়া হয়। তাহারা তখন কথা বলে ঠিকই কিন্তু যাহারা কোনােদিনই তাহাদের মুক্তিদান করিবে না তাহাদের দরবারেই বলে। সেই জনতা তখন একটি তত্ত্বের দিকে ধাবিত হয় বটে কিন্তু উহা তাহাদিগকে কত পিছনে লইয়া যায় তাহার খোঁজই রাখে না। মোট কথা, অহিংসা শোষণের একটি মহৎ কৌশল- এই সত্যটি কেউ বুঝিয়া উঠে না।
অহিংসার বাণী ও অহিংস কৌশল মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে ভোঁতা করে মাত্র- দেশের শতকরা ৯৫ জনের চিরস্থায়ী কোনাে কল্যাণ সাধন করিতে পারে না। তাই যখনই দেখিতে পাই যে, দেশবাসী অহিংসার মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করিয়া মানবীয় কল্যাণের কথা ভাবিতেছে তখন সত্যিই আমার করুণা জাগে– কী আফিমই না তাহাদিগকে পাইয়া বসিয়াছে!
শোষণ মুক্তির বলিষ্ঠ ধাপ তথা বিপ্লবের পথে পা বাড়াইবার মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা ধ্বংস করিবার মোলায়েম মত ও পথই হইলাে অহিংসা। তাই পূর্বেই আমি উল্লেখ করিয়াছি যে, অহিংসার মন্ত্র যতই আপাত মধুর হউক না কেন, যতই দর্শন সুলভ হউক না কেন– বাস্তবে উহাকে কোনােদিন বরদাশত করিতে পারি নাই। অহিংসার মন্ত্রকে ঘৃণাভরে পদাঘাত করিয়া বিপ্লবের কর্মসূচি যথাযথ রাখাতেই দেশের শতকরা ৯৫ জনের সার্বিক কল্যাণ নিহিত বলিয়া বিশ্বাস করি।
শুধু সমষ্টিগতভাবেই নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও অহিংসা মানুষের সমূহ ক্ষতি সাধন করে। অবশ্য যিনি অহিংসার মৌলিক চেতনায় গড়া প্রতিভা লইয়া জন্ম লইয়াছেন তাহার কথা আলাদা। তবে এমন প্রতিভা লইয়া প্রতি শতাব্দীতে কয়জনই বা জন্ম গ্রহণ করে। তাহাদিগকে লইয়া তো আর সমাজ কিংবা রাষ্ট্র চলিতে পারে না। অহিংসা ব্যক্তির আত্মশক্তিকে খর্ব করিয়া ফেলে। অন্যায়-অবিচারের সহিত আপস করাটা এক সময় তাহার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হইয়া দাঁড়ায়। তখন তাহার নিকট শান্তির দোহাই ও সহঅবস্থান নীতি অতি বড় হইয়া দেখা দেয়। এভাবে অহিংসার বাণী ব্যক্তির বেগবান সৃজন প্রবাহকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। ব্যক্তিগতভাবে অধঃপতিত হইয়াই সে বসিয়া থাকে না, অহিংসা বাণীর বদৌলতে নিরীহ জনসাধারণকে শোষণ করিবার পথও খুঁজিয়া বেড়ায়। ধার্মিকের বেশে দুনিয়াতে যেমন বহু রকমের ভণ্ডের আবির্ভাব ঘটিয়াছে তেমনি অহিংসাপরায়ণ সাজিয়া মোনাফেক শোষক গড়িয়া উঠিয়াছে। এই সকল পরিস্থিতির মোকাবিলা করিতে বিপ্লবী মহলকে সচেতন ও সক্রিয় থাকিতে হয়।
অহিংসায় ভালােবাসার বাণী থাকিলেও তাহা কোনােদিন বাস্তবায়িত হয় না, বিশেষ করিয়া ধনতন্ত্রবাদী সমাজ ব্যবস্থায় তাহা তো সম্ভব নয়ই। পক্ষান্তরে বিপ্লব যে আবেদন আর শক্তি লইয়া মানব সমাজে উপস্থিত হয় তাহা আর কিছু বহন করুক বা না করুক- কুসংস্কার ও শোষণের ধ্বংস প্রত্যক্ষভাবে লইয়া আসিবেই। তাই বিপ্লবে ভাওতাবাজির কোনাে দ্বার খোলা থাকে না, থাকে শুধু ব্যবস্থা বিশেষের মূল্যোৎপাটন– তা যে কৌশলেই হউক
অনেকে মনে করেন, অহিংসার রাজ্যে বিপ্লবী মহল কাজ করিতে পারে না। আমার মতে, ধারণাটি ভুল। কারণ বিপ্লবী মন সব সময় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর– শুধু মুখের ভাষাতেই নয়, স্থান-কাল-পাত্রভেদে অস্ত্রের ভাষায়ও। কারণ বৃহত্তর কল্যাণের প্রয়োজনে সে আশপাশে অপারেশন চালাইয়া থাকে- যেমনটি রোগীর একটি চক্ষু তুলিয়া ফেলিয়া অপরটিকে অক্ষত রাখেন কোনো দূরদর্শী ডাক্তার। অবশ্য ইহাও সত্য যে, বিপ্লবের নামে উদ্দেশ্যহীন ধ্বংস সাধন করিবার জন্য মহল বিশেষের আবির্ভাব ঘটিতে পারে। তবে তাহা একান্তই ক্ষণস্থায়ী হইয়া থাকে। খাঁটি বিপ্লবী দল তাহাদিগকে অচিরেই গ্রাস করিয়া ফেলিতে সক্ষম হয়। কিন্তু অহিংসার নামে সুবিধাবাদী মহল স্বার্থ উদ্ধার করিয়া সারিয়া উঠে এবং এমন কৌশলে জনতার ঘাড়ে চাপিয়া বসে যে, অনেক মাশুল দান করিয়া তাহার কবল হইতে মুক্তি পাইতে হয়। তাই অহিংসায় ভালােবাসার বাণী থাকিলেও তাহা কোনােদিন বাস্তবায়িত হয় না, বিশেষ করিয়া ধনতন্ত্রবাদী সমাজ ব্যবস্থায় তাহা তো সম্ভব নয়ই। পক্ষান্তরে বিপ্লব যে আবেদন আর শক্তি লইয়া মানব সমাজে উপস্থিত হয় তাহা আর কিছু বহন করুক বা না করুক- কুসংস্কার ও শোষণের ধ্বংস প্রত্যক্ষভাবে লইয়া আসিবেই। তাই বিপ্লবে ভাওতাবাজির কোনাে দ্বার খোলা থাকে না, থাকে শুধু ব্যবস্থা বিশেষের মূল্যোৎপাটন– তা যে কৌশলেই হউক।
রাজনৈতিক আন্দোলনে গান্ধীর অহিংসা নীতি প্রসঙ্গে আমরা বহুবার তর্ক-বিতর্ক করিয়াছি। বিশেষ করিয়া কারাগারে বিভিন্ন মতাবলম্বী নেতৃবর্গের মধ্যে অহিংস তত্ত্ব লইয়া তর্ক বাধিয়া যাইতে দেখিয়াছি। অহিংসবাদী নেতাগণ বরাবরই সম্রাট অশোকের সাফল্য ও মহত্ত্বকে আমাদের সামনে তুলিয়া ধরিতেন। আমি তখন বলিতাম, আজও বলি– সম্রাট অশোক অহিংসা বলে যে সাম্রাজ্য ও শাসন কায়েম করিয়াছিলেন উহা তাহার মৃত্যুর পর কয়দিনই বা টিকিয়াছিল? তদুপরি সম্রাট অশোক যতটুকু সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন তাহার অন্যতম কারণ ছিল যুগের পরিবেশ। তৎকালে একে অন্যকে শোষণ করিবার রকমারি কৌশল আবিষ্কার হয় নাই এবং প্রয়োজনও পড়ে নাই। তাছাড়া সম্রাট অশোকের নীতি ও ব্যবস্থাপনায় আন্তরিকতা ও অভিনবত্ব ছিল বলিয়া জনসাধারণের আস্থাভাজন হইয়াছিলেন তিনি। কিন্তু তাহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবই ঝুট মনে হইয়াছিল। এমন অনেক নেতার সাক্ষাৎ পাইয়াছি যাহারা ইসলামের নামে রাজনীতি করিতে নামিয়া অহিংসার দোহাই পাড়িয়া থাকেন। মাওলানা মুহাম্মদ আলী ঐসব নেতাকে লেখায়-ভাষণে খুব ধোলাই করিতেন। তিনি অসংখ্য নজির তুলিয়া ধরিয়া প্রমাণ করিতেন যে, ইসলাম যুদ্ধংদেহী নীতির স্বীকৃতি দান করিয়াছে। একবার মাওলানার এমনই একটি বক্তব্যের জবাবে তাহাকে গান্ধী লিখিয়াছিলেন- ‘আপনার নবী সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তলোয়ার ধরিয়াছিলেন সত্য। কিন্তু বিনা তলোয়ারে অর্থাৎ প্রেম দিয়া জয়লাভকে তিনি বেশি পছন্দ করিতেন- ইহাও সত্য।’
প্রকৃতপক্ষে মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে জয় করিতে অহিংসা একটি মহৎ মাধ্যম হইতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের সহিত মানুষের যে ধরনের বৃত্তিসমূহ জড়িত থাকে সেগুলিকে জয় করিতে অহিংসার নয়, মারমুখী কৌশলেরই প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে
প্রকৃতপক্ষে মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে জয় করিতে অহিংসা একটি মহৎ মাধ্যম হইতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের সহিত মানুষের যে ধরনের বৃত্তিসমূহ জড়িত থাকে সেগুলিকে জয় করিতে অহিংসার নয়, মারমুখী কৌশলেরই প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। ইসলামের সবচেয়ে সফল খলিফা হজরত ওমর-এর চরিত্রে বিনয় ছিল বটে কিন্তু তিনি যাহা অবলবম্বন করিয়া সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন তাহা আদৌ বিনয় নয়- শক্তি ও কাঠিন্যই ছিল সেক্ষেত্রে সম্বল। অবশ্য শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে ইসলাম নির্ধারণ করিয়া দিয়াছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি নীতি। তাহা হইলাে বর্ণে বর্ণে ইনসাফ বজায় রাখা। স্বীয় কার্যক্রমের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাহা বজায় রাখাও সম্ভব বটে তবুও কেন যেন আমার মনে হয়, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি মক্কা বিজয়ের দিন নবী সুলভ ক্ষমা প্রদর্শন না করিতেন তাহা হইলে ইসলামের গৌরবময় খিলাফত ৩০ বৎসরেই খতম হইয়া যাইতাে না। কারণ ঐ ক্ষমার মধ্য দিয়াই মোনাফেক মুসলমান শোষণের প্রশ্রয় পায় এবং সময় বুঝিয়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। পক্ষান্তরে মক্কার ধনিক-বণিক ও ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রপ্রিয় সম্প্রদায় নিহত কিংবা নির্বাসিত হইলে অঙ্কুরেই সব ধ্বংসপ্রাপ্ত হইতাে।
অনেকে মনে করেন, ইসলামের বিধান হইলাে শুধু আক্রান্ত হইলেই পাল্টা অভিযান শুরু করা যায়। কিন্তু মোটেই তাহা সত্য হইতে পারে না যদি সত্যিই ইসলাম মানুষের কল্যাণ সাধন করিতে চায়। এই দিক দিয়া কমিউনিস্টদের কৌশল ও বিশ্লেষণ খুবই বাস্তবানুগ হইয়া থাকে। তাই মহৎ উদ্দেশ্য লইয়া মহান আদর্শ কায়েম করিতে কমিউনিস্টদের অভিযান বিলম্বে হইলেও সর্বসাধারণে স্বীকৃত হয়। লেনিন ও মাও সেতুং ঐ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করিয়াছেন। পক্ষান্তরে গান্ধী ও টলস্টয়ের অহিংসা দর্শন লইয়া শিক্ষিত মহলে উন্নতমানের একটি সেমিনার জমিতে পারে- সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদ, ধনতন্ত্রবাদী শাসন–শোষণের অবসানকল্পে এবং সর্বহারা জনতার মুক্তিকল্পে কোনো বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা যাইবে না। মার্কিন নিগ্রোদিগকে ডক্টর মার্টিন লুথার কিং প্রাণ দিয়া ভালােবাসিয়াছেন- ইহাতে কোনাে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অহিংস নীতি নিগ্রোমুক্তি আন্দোলনের অনেক ক্ষতি করিয়াছে- ইহাও সত্য। আমার মতে, চপেটাঘাতের বদলে পাল্টা চপেটাঘাত তো বটেই, পারিলে পদাঘাতও করিতে হয়। মার্কিন ধনিক-বণিক সমাজ নিগ্রোদের যেমনভাবে শাসন-শোষণ করিয়াছে তাহার দাগ উঠাইতে অহিংসার দর্শন হাস্যকর ব্যাপার বৈকি! আব্রাহাম লিংকন যত মহান প্রেসিডেন্ট হউন না কেন, গৃহযুদ্ধ না বাধিলে চোখও হয়তো খুলিয়া যাইতাে না।
শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলমানদের যতই অগ্রগতি হউক না কেন, বিপ্লবী অভিযানে তখন হইতেই তাহারা যেভাবে পশ্চাৎপদ হইয়া পড়িয়াছিল উহার প্রতিক্রিয়া আজ পর্যন্তও বর্তমান।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি, শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ প্রমুখ যে বিপ্লবের বাণী ছাড়াইতেছিলেন তাহা ঐ শতাব্দীরই শেষভাগে স্তিমিত হইয়া শান্ত-শিষ্ট রূপ গ্রহণ করিয়াছিল। উহা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মানানসই ছিল বটে কিন্তু বিপ্লবী জাগরণের জন্য মোটেই যুৎসই ছিল না
১৮৫৭ সালে এই উপমহাদেশে বিদ্রোহ সংঘটিহ হইবার পর মুসলমানদিগকে শিক্ষার পথ দেখাইয়া স্যার সৈয়দ আহমদ উপকার সাধন করিয়াছেন সত্য। কিন্তু তৎসঙ্গে ইহাও মানিয়া লইতে হইবে যে, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমমার্ধ নাগাদ এই জাতিতে যে বিপ্লব চেতনা বিরাজমান ছিল তাহা ভোঁতা হইয়া সংস্কারধর্মী চেতনায় রূপান্তরিত হইয়া পড়িয়াছিল। শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলমানদের যতই অগ্রগতি হউক না কেন, বিপ্লবী অভিযানে তখন হইতেই তাহারা যেভাবে পশ্চাৎপদ হইয়া পড়িয়াছিল উহার প্রতিক্রিয়া আজ পর্যন্তও বর্তমান। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি, শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ প্রমুখ যে বিপ্লবের বাণী ছাড়াইতেছিলেন তাহা ঐ শতাব্দীরই শেষভাগে স্তিমিত হইয়া শান্ত-শিষ্ট রূপ গ্রহণ করিয়াছিল। উহা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মানানসই ছিল বটে কিন্তু বিপ্লবী জাগরণের জন্য মোটেই যুৎসই ছিল না। পেশোয়ার-এ সৈয়দ আহমদ বেরেলভি যে স্বাধীন রাষ্ট্র ও খেলাফত কায়েম করিয়াছিলেন তাহাই হয়তাে গোটা উপমহাদেশের মুক্তির জন্য কাজ করিয়া যাইতো। ঐ সংগঠনই হয়তো সর্বত্র বিপ্লবের বাণী ছাড়াইতাে। তাহা হইলে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইতাে না এবং স্যার সৈয়দ আহমদকে সংস্কারমুখী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতাে না। কিন্তু আফসোস, বিপ্লবী হইয়াও সৈয়দ আহমদ বেরেলভি বিশ্বাসঘাতক ও মোনাফেক চক্রান্তকে অহিংসার বাণী শুনাইলেন এবং ক্ষমার চোখে দেখিলেন। অবশেষে মুষ্টিমেয় কয়েক বিশ্বাসঘাতক রাতারাতি শত শত বিপ্লবী কর্মীকে হত্যা করিয়া এই উপমহাদেশে বিপ্লবী জাগরণের কবর রচনা করিয়াছিল। যে যাহাই বলুন না কেন, সৈয়দ আহমদ বেরেলভির সাময়িক দুর্বলতা অর্থাৎ মোনাফেক আফগানদের প্রতি অহিংসা প্রদর্শন গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি বদলাইয়া ফেলিয়াছিল বলিয়া বিশ্বাস করি।
যাহোক, আমি ইতিহাসবেত্তা নই, রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষ্যকারও নই। হাড়ে হাড়ে রাজনীতিবিদ থাকিতে চাই এবং অহিংসার বাণীতে নয়, বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্দীপিত হইয়া আন্দোলন চালাইয়া যাইতে চাই। ইতিহাসের পাতায় স্থান-কাল-পাত্রভেদে অহিংসার বাণী যেভাবে ব্যর্থ বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে তাহার প্রতি ইঙ্গিত এখানে করিলাম মাত্র। তবে যে পরিমণ্ডলে রাজনীতি করি তাহার অনুসারীদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা অহিংসার মন্ত্রে গদগদ হইয়া যাইবেন না। তাহা হইলে বিপ্লবী চেতনা হারাইয়া ফেলিবেন। তখন খুব বড় জোর শৌখিন দেশপ্রেমিক সাজিতে পারিবেন– সর্বহারা জনতার জন্য কাজের কাজ কিছুই করিত পারিবেন না।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর এ লেখাটি ‘হক-কথা’, শুক্রবার, ৩ চৈত্র ১৩৭৮; ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে প্রকাশিত