যদিও চীনের অধিকাংশ নাগরিক ওই দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের পথে জাপানকে সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে থাকে তবুও বিশ্লেষকদের মতে, ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের হাত ধরে ভারতের ক্রমবর্ধমন উত্থান, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ধোঁয়াশা পরাষ্ট্রনীতি বর্তমানে চীনের জন্য অন্যতম হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বছরের শুরুতে চীনের পররাষ্ট্র বিশ্লেষকরা বিশ্বব্যাপী তাদের প্রতিপক্ষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে ২০১৭ সালের বিভিন্ন ঘটনা বিবেচনায় জাপান ও ভারতকে নিয়ে আলাদা করে ভাবছে চীন কর্তৃপক্ষ।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন’-এ ‘চীন কেন ভারতকে হুমকি হিসেবে দেখছে না’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে কলামিস্ট সঞ্জীব নায়ার বলেন, ‘চীনের এটি বোঝা উচিৎ চীনের জন্য ভারত সরকার কোনো হুমকি নয়, বরং তারা বিশ্বব্যাপী একটি সঠিক স্থান চান।’
এদিকে গত বছর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-র ভারত সফরের পর চীনের আধা সরকারি একটি সাময়িকীতেও বলা হয়, ‘ভারত-জাপানের বন্ধুত্ব চীনের জন্য বড় কোনো হুমকি নয়।’
অন্যদিকে ‘গ্লোবাল টাইমস-এর তরফ থেকে সব সময় ভারতের ব্যাপারে এক ধরনের উদাস দৃষ্টি দেয়া হয়ে থাকে। এমনকি ভারত গত বছর একটি ব্যালেস্টিক মিসাইল অগ্নি ১১-এর পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের পরও তারা দাবি করেন, চীনের জনগণের জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতি এখনো বড় কোনো হুমকির কারণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা নেই।
নতুন বছরে ওই সমীকরণ পুরোটিই উল্টে যাচ্ছে। চায়নিজ বিশ্লেষক ইয়ান গুওমিং বলেন, ‘জাপান নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পর চীনের জন্য এখন সব থেকে বড় হুমকি হলো ভারত।’ তিনি বলেন, ‘চীনকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে ভারত। বিশেষ করে দোকলাম যুদ্ধের পর ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র বিশদভাবে আমাদের সামনে এসেছে। এটি চীনের নীতি-নির্ধারকদেরকোছে পরিষ্কার, ভারতই হতে যাচ্ছে চীনের জন্য দ্বিতীয় বড় কোনো হুমকি যেটি আগে ছিল জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের পর জাপানকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হলেও ইদানীং তাদের জায়গাটি নিতে বসেছে ভারত। ফলে ভারতকেন্দ্রিক কৌশল নির্ধারণে বহুবিধ নিরীক্ষাও চালানো উচিৎ।’
চীনের নীতি-নির্ধারকরা বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারেও পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন তারা। কিন্তু ২০১৭ সালে ভারতীয় সেনারা হঠাৎ করেই দোকলাম-এ প্রবেশ করলে সব উলট-পালট হয়ে যায়। চীনের অধিকাংশ নাগরিক ওই ঘটনায় অবাক হয়ে পড়েন! তারা এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। চায়নিজ গবেষক লি ইয়াং বলেন, ‘কয়েক দশকে আমদের সব থেকে বড় ভুল ছিল ভারতকে হালকা ভাবে নেয়া। ওই বছরগুলোতেই ভারত ক্রমাগতভাবে এগিয়ে গেছে। ফলে শক্তি প্রদর্শনের জন্য তাকে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি।’
গত বছর চীন তাদের সব থেকে বড় প্রজেক্ট ‘ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট’ ঘোষণা দিতে বড়সড় এক সভার অয়োজন করে। ভারত অনুষ্ঠান শুরুর মাত্র একদিন আগে তা বর্জন করে। ভারতের ওই বর্জনের সিদ্ধান্তে চীন কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ ভূমিকা নিলেও অনেক বিশ্লেষক এ ঘটনাটিকে ভারতের নীরব কূটনৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে অবিহিত করেন।
গত বছর চীন-ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতায় দোকলাম হামলা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। দোকলাম সংঘর্ষ ছিল ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ ফোরাম-এর আলোচনা শুরুর কিছুদিন আগে। মূলত চীনের ওয়ান বেল্ট ফোরাম থেকে ভারত নিজেদের সরিয়ে নিতেই ওই ঘটনা ঘটায় বলে মনে করেছেন অনেকে।
চীনের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শেন দিংলি বলেন, ‘শি জিন পিং স্টাইল ডিপ্লোম্যাসি’র অধীন দোকলামের ঘটনাটি ছিল চীনের জন্য সবচেয়ে বড় পাঁচটি কূটনৈতিক পরাজয়ের একটি।’
ওইসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় অদূর ভবিষ্যতেই ভারত ও চীন নিজেদের একে অপরের শত্রু হিসেবেই হিসেবে দেখবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের মতে- জাপান নয়, ভারতই এখন সব থেকে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের জন্য।
জাপানের ব্যাপারে চীনের ওই মনভাবের পেছনে আরেকটি কারণ হলো ভূরাজনীতি বিবেচনায় চীন বিশ্বাস করে, তারা জাপান-এর থেকে ভালো অবস্থানে আছেন। জাপানের সমুদ্র সংশ্লিষ্টতার কারণে তাদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি- সবকিছুই সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া ভৌগােলিকভাবে জাপানের কোনো কিছু আমদানি-রফতানি করতে হলে দক্ষিণ চীন সাগর রুটটি সব থেকে সহজ রাস্তা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় চীন যদি দক্ষিণ সাগরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে (এ জন্য অবশ্য তাইওয়ান-এর ওপরও চীনের নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে যার স্বপ্ন চীন প্রতিনিয়ত দেখে থাকে)। তবে ওই অঞ্চলে সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এককভাবে চীনের কর্তৃত্ব বিস্তার সম্ভব হবে। চীনের সামনে জাপান যে বড় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না সেটি এক রকম নিশ্চিত।
অন্যদিকে চীন নিজের আমদানি-রফতানির জন্য ভারত সংশ্লিষ্ট সমুদ্রপথও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কিন্তু দোকলাম ঘটনার পর এটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে, চীনকে ওই পথে অনায়াসেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না ভারত। তবে ভারত এখনো পুরোপুরি হুমকি হয়ে উঠছে কি না সেটিও বলা মুশকিল।